ষোলো সমাচার
সাহিত্যে কেমন গেল বছরটি
সাহিত্যের সালতামামির কথা বিস্তারিত বলতে গেলে প্রথমেই আসে দুঃখের কথা। ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি তাদের ভূমিকাকে বিতর্কিত করেছে বলা যায়। সাহিত্যের সঙ্গে এই প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্ক অতি গভীর। কেবল ভাষা আন্দোলন ও একুশের চেতনায় গ্রন্থমেলা নয়, এই প্রতিষ্ঠান থেকে সাহিত্যিকরা স্বীকৃতি পেয়ে নিজেকে গৌরবান্বিত মনে করেন। বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারসহ অন্য কতগুলো স্বীকৃতিমূলক অনুষ্ঠান পরিচালনা করে, যেখানে কবি-সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণ থাকে উৎসাহব্যঞ্জক। এ জন্য যখন শ্রাবণ প্রকাশনীকে স্টল বরাদ্দ না দিয়ে বরং দুই বছরের জন্য একুশের মেলাতে নিষিদ্ধ করা হয় কিংবা অক্টোবর মাসে প্রায় ৮০টি গ্রন্থের লেখক রতন তনু ঘোষের মরদেহ সেখানে নিতে না দেওয়া হয়, তখন আমরা দুঃখে কাতর হই স্বাভাবিক কারণে।
পক্ষান্তরে, একাডেমির অর্জনও বিপুল। এই প্রতিষ্ঠানটি বর্তমান সরকারের অকুণ্ঠ সমর্থন পেয়ে গ্রন্থমেলার পরিসর বৃদ্ধি এবং মেলা প্রাঙ্গণের মধ্যে লেখকদের নিরাপত্তা জোরদার করে প্রশংসা অর্জন করেছে। যদিও চেতনা নির্মাণে এবং মুক্তবুদ্ধির চর্চাকে উৎসাহ দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটি পিছু হটেছে; বরং নাস্তিক ব্লগার আর বিজ্ঞানমনস্ক ব্যক্তিদের কাছে টানার পরিবর্তে দূরে ঠেলে দিয়েছে। তবু এবার বিশ্বখ্যাত মানুষদের পদচারণায় মুখরিত ছিল একাডেমি-অঙ্গন।
বাংলা একাডেমিতেই ঢাকা লিট ফেস্ট তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো। ১৭ অক্টোবরে শুরু হওয়া সেই অনুষ্ঠানে ২০০১ সালে নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক ভি এস নাইপলকে আমরা কাছে পেয়েছি। ভারতীয় বংশোদ্ভূত এই সাহিত্যিক বলেন, ‘ঢাকা এসে খুব ভালো লাগছে আমার। উৎসব উদ্বোধন করেও আমি আনন্দিত।’ ৯০টি অধিবেশনে সাজানো এ সাহিত্য সম্মেলনের প্রথম দিনে অনুষ্ঠিত হয় ১৫টি অধিবেশন। এ ছাড়া ছিল সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক স্মরণে নাট্য প্রদর্শনী। তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘নীল দংশন’ নাটকটি ইংরেজি অনুবাদে মঞ্চস্থ হয়। দেখানো হয় ভি এস নাইপলকে নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র। এই উৎসবে অংশ নেন দুই শতাধিক শিল্পী, সাহিত্যিক, লেখক, গবেষক, সাংবাদিকসহ আরো অনেকে। ছিলেন ভ্রমণপিপাসু অস্ট্রেলিয়ান লেখক টিম কোপ এবং পুলিৎজার বিজয়ী ভারতীয় বংশোদ্ভূত কবি বিজয় শেষাদ্রি, ছিলেন জেফরি ইয়াংসহ আরো অনেকেই।
২০১৬ সালের সাহিত্যের নোবেল ছিল অবাক করার মতো। মার্কিন গায়ক ও গীতিকার রবার্ট অ্যালেন জিমারম্যান, সংগীতবিশ্ব যাকে চেনে বব ডিলান নামে, তাঁর পুরস্কার আমাদের মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছে। সত্তর দশক থেকে বর্তমান প্রজন্মের কাছেও সমান জনপ্রিয় এই শিল্পী। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন, গেয়েছিলেন একাত্তরে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ কনসার্টে। যুক্তরাষ্ট্রের সংগীত ঐতিহ্যে নতুন কাব্যিক ধারা সৃষ্টির স্বীকৃতি হিসেবে ডিলানকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয় বলে জানিয়েছে রয়েল সুইডিশ আকাডেমি অব সায়েন্সেস। সুইডিশ আকাডেমি বলছে, ‘আমেরিকার সংগীত ধারায় নতুন কাব্যিক দ্যোতনা সৃষ্টির' জন্য রক, ফোক, কান্ট্রি মিউজিকের এই কিংবদন্তিকে নোবেল পুরস্কারের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে সাহিত্যের সম্মানজনক ম্যান বুকার পুরস্কার পেলেন মার্কিন লেখক পল বিটি। বর্ণবাদ নিয়ে লেখা ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস ‘দ্য সেলআউট’-এর জন্য তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। ম্যান বুকার পুরস্কার (অথবা সংক্ষেপে বুকার পুরস্কার) বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। প্রতিবছর (বিচারকদের মতে) গত এক বছরে প্রকাশিত শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য উপন্যাসকে এই পুরস্কারটি দেওয়া হয়। ‘দ্য সেলআউট’ উপন্যাসটির গল্প একজন কৃষ্ণাঙ্গ তরুণকে নিয়ে। এই তরুণ লস অ্যাঞ্জেলেসের শহরতলিতে বর্ণবাদ ও দাসপ্রথা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। বিচারকরা উপন্যাসটিকে বর্তমান সময়ে কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার আদায়ে অত্যন্ত যুগোপযোগী বলে উল্লেখ করেন। সম্মানজনক আন্তর্জাতিক ‘ম্যান বুকার পুরস্কার’-২০১৬ পেয়েছেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হ্যান ক্যাং। ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসের জন্য তাঁকে এ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। উপন্যাসটি নিরামিষভোজী এক নারীকে নিয়ে লেখা। অন্যদিকে, এপ্রিল মাসে ঘোষিত হয়েছে পুলিৎজার সাহিত্য পুরস্কার-২০১৬। এ পুরস্কার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ছাপা সাংবাদিকতা, সাহিত্য এবং সংগীতের সর্বোচ্চ পুরস্কার হিসেবে বহুল সমাদৃত। ভিয়েতনামিজ-আমেরিকান লেখক ভিয়েত থান নগুয়েন ২০১৬ সালে ‘দি সিম্প্যাথাইজার’ বইয়ের জন্য পুলিৎজার পুরস্কার লাভ করেন। ভিয়েতনামের যুদ্ধই এ বইয়ের উপজীব্য। আরো আছে রাজনীতি আর ইতিহাসের গল্প। ২০১৬ সালের ২৮ জানুয়ারি ২০১৫ সালের জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ ঘোষণা করা হয়। ১১ জন সাহিত্যিককে দেওয়া হয়েছে পুরস্কার। তাঁরা হলেন—আলতাফ হোসেন (কবিতা), শাহীন আকতার (কথাসাহিত্য), আবুল মোমেন (প্রবন্ধ), আতিউর রহমান (প্রবন্ধ), মনিরুজ্জামান (গবেষণা), আবদুস সেলিম (অনুবাদ), তাজুল মোহম্মদ (মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সাহিত্য), ফারুক চৌধুরী (আত্মজীবনী, স্মৃতিকথা ও ভ্রমণকাহিনী), মাসুম রেজা (নাটক), শরীফ খান (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও পরিবেশ) এবং সুজন বড়ুয়া (শিশুসাহিত্য)।
সাহিত্যের উৎসব এবং পুরস্কারের আনন্দের পাশে বেশ কিছু মৃত্যুসংবাদ আমাদের শহীদ মিনার এবং বাংলা একাডেমির বটতলায় টেনে নিয়ে গেছে। এমনকি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও দুটি কাব্যগ্রন্থের কবি মাহবুবুল হক শাকিলের আকস্মিক মৃত্যু ছিল স্তম্ভিত করে দেওয়ার মতো। কেবল দেশে নয়, বিশ্বসাহিত্যের অনেককে আমরা ২০১৬ সালে হারিয়েছি। হারিয়েছি পুঁথি সাহিত্যবিশারদ ও অনুবাদক আ ক ম যাকারিয়া (মৃত্যু ২৪ ফেব্রুয়ারি), কবি কায়সুল হক (১৩ ফেব্রু), কবি রফিক আজাদ (১২ মার্চ ), বেগম পত্রিকার সম্পাদক ও সাহিত্যিক নূরজাহান বেগম (২৩ মে), কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী (২৮ জুলাই), কবি শহীদ কাদরী (২৮ আগস্ট), সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক (২৭ সেপ্টেম্বর), প্রাবন্ধিক রতন তনু ঘোষ (৩ অক্টোবর)। মার্কিন কথাসাহিত্যিক ও পুলিৎজার পুরস্কারজয়ী বেস্টসেলার ‘টু কিল এ মকিংবার্ড’ (১৯৬০)-এর জন্য সুপরিচিত হার্পার লি। এ বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি ৮৯ বছর বয়সে মারা যান। এ ছাড়া ইতালীয় লেখক উমবার্তো একো (মৃত্যু ১৯ ফেব্রু.), নোবেলজয়ী হাঙ্গেরীয় সাহিত্যিক ইমরে কার্তেস (৩১ মার্চ), ব্রিটিশ কবি স্যার জিওফ্রে হিল (৩০ জুন), আইরিশ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, গল্পকার উইলিয়াম ট্রভর (২০ নভেম্বর), কানাডার কবি ও ঔপন্যাসিক লিওনার্ড কোহেন (৭ নভেম্বর) প্রমুখকে হারিয়েছি আমরা। ২০১৬ সালে ইতিহাস সৃষ্টিকারী শিল্পসাহিত্য জগতের আরো যাঁদের হারিয়েছি তাঁরা হলেন জর্জ মাইকেলের আসল নাম জর্জিওস কাইরিয়াকোস প্যানাইওতু। ৫৩ বছর বয়সে এ বছর ২৫ ডিসেম্বর, বড়দিনেই তিনি মারা গেলেন। রক মিউজিকের কিংবদন্তি ব্রিটিশ তারকা ডেভিড বাওয়ি এ বছরের ১০ জানুয়ারি ৬৯ বছর বয়সে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আশির দশকের জনপ্রিয় মার্কিন গায়ক, গীতিকার, বহু-বাদ্যযন্ত্রী ও রেকর্ড প্রডিউসার প্রিন্স রজার্স নেলসন। এ বছর ২১ এপ্রিল মারা যান তিনি। চলতি বছর ৪ এপ্রিল ঢাকাই চলচ্চিত্রের বরেণ্য নির্মাতা শহিদুল ইসলাম খোকন চিরদিনের জন্য না-ফেরার দেশে চলে গেছেন। ‘তোমারে লেগেছে এত যে ভালো’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’, ‘পিচঢালা এই পথটারে’সহ অসংখ্য গানের সুর স্রষ্টা রবিন ঘোষ। ১৩ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই সংগীত পরিচালক প্রয়াত হন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ এবং ‘সীমানা পেরিয়ে’ ও ‘সূর্যকন্যা’র মতো কালজয়ী চলচ্চিত্রের বরেণ্য চিত্রগ্রাহক জেড এম এ মবিন ২৫ জুলাই পরলোকগত হন।
প্রতিবছর প্রায় পাঁচ হাজারের বেশি বাংলা ভাষার গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে বিপুলসংখ্যক তরুণের বই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গতিপ্রকৃতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। ২০১৬ সালে ‘দেশ পাবলিশার্স’ তরুণদের শতাধিক বই প্রকাশ করে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। সেই প্রকাশিত গ্রন্থের অনেকগুলোর আবার দ্বিতীয়-তৃতীয় মুদ্রণ হয়েছে। অর্থাৎ তরুণদের প্রথম বই নাড়া দিয়েছে পাঠকগোষ্ঠীকে। সাহিত্যের জন্য এটা সুখবর বৈকি। বইমেলা, সাহিত্য উৎসব আর নিভৃতে সাহিত্য চর্চা সব মিলে ২০১৬ সাল ছিল প্রাণবন্ত। আগামী বছর সাহিত্যের ক্ষেত্রে আরো বেশি সৃষ্টিশীলতা ও ভাষার কারুকার্য দেখতে চাই আমরা।