রাগে অনুরাগে
কেমন আছেন অনুরাগ কশ্যপ?
ছবিটা না দেখলেও কথা শোনাতে ছাড়েননি কেউ। রাগ করে অনুরাগ কশ্যপ এখন ভারত ছাড়ার পথে। বলিউডে এখন পর্যন্ত অনুরাগের শেষ ছবি ‘বোম্বে ভেলভেট’। আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেনি ছবিটি। তাঁর একমাত্র বিগ বাজেট ফিল্ম। ছবিটি নিয়ে মানুষের নানা কথা, সমালোচনা শুনে প্রথমে খেপে গিয়েছিলেন অনুরাগ। প্রতিক্রিয়ায় ইচ্ছেমতো গালমন্দ করেছেন সমালোচকদের। পরে সিদ্ধান্ত নিলেন আর দেশেই থাকবেন না। প্যারিসে একটা স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্ট নিয়েছেন। বোঝাই যাচ্ছে সেখানেই নিয়মিত হতে যাচ্ছেন তিনি। নিজ দেশে সমাদর না পেলেও ফ্রান্সে কিন্তু তিনি বেশ সমাদর পেয়েছেন। সিনেমায় অবদানের জন্য ফ্রান্স সরকার ২০১৩ সালে অনুরাগকে ‘অখদ দেজাখত এ দে লেতখ’ ( Ordre des Arts et des Lettres) সম্মানে ভূষিত করে।
১৯৯৩ সালে অনুরাগ মুম্বাই এসেছিলেন অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে। ওয়েটারের কাজ নিয়েছিলেন পৃথ্বি থিয়েটারে। বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে পড়েছিলেন প্রাণিবিদ্যা। কলেজে পড়ার সময় থিয়েটারে জড়িয়ে পড়েন। যোগ দেন ‘জননাট্য মঞ্চ’ দলে। এদের হয়ে বেশ কয়েকটি পথনাট্যে অভিনয় করেন। এর মধ্যে বন্ধুরা একদিন ধরে নিয়ে যায় চলচ্চিত্র উৎসবে। ১০ দিনে ৫৫টা ছবি দেখা হয়ে যায় এই সুযোগে। সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে ভিত্তোরিয়ো দো সিকার ‘বাইসাইকেল থিফ’। মাত্র পাঁচ হাজার রুপি নিয়ে চলে আসেন মুম্বাই। টাকা শেষ হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যেই। তারপর ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ান, শেষে কাজ জোটে পৃথ্বি থিয়েটারে কিন্তু অভিনয়টা আর করা হয়নি।
সেই অনুরাগ লেখালেখি থেকে চলে আসেন ডিরেকশনে। ‘ডেভ ডি’ এবং ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ তাঁকে জায়গা করে দেয় বলিউডে।
কিন্তু ‘বোম্বে ভেলভেট’-এর ১০০ কোটি রুপি ক্ষতির পর অনেকেই বলছেন অভিনেতা রণবীর কাপুর ছবিটি নিয়ে ঠিকমতো প্রচারণা চালাননি। পরিচালক রামগোপাল ভার্মাও বেশ খুঁচিয়েছেন টুইটারে। এদিকে ট্যাক্স নিয়ে ঝামেলায় অনুরাগের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে অনুরাগ বেশ বিপাকেই আছেন। তবে সিনেমা ছাড়ার কথা একবারও বলেননি। সিনেমা ছাড়া তিনি বাঁচতে পারবেন না, সেটা তিনি যেমন বলেন তেমনি তাঁর কাছের মানুষরাও বলেন।
রণবীর কাপুর অনুরাগ সম্পর্কে বলেছেন, ‘খুবই ভুল বুঝেছেন তাঁকে সবাই।’
অনুরাগের এই প্যারিসযাত্রা নিয়ে ভারতীয় সাময়িকী ইন্ডিয়া টুডে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাদের ২৫ মে সংখ্যায়, যার শিরোনাম ছিল পলায়নপর পরিচালক (দ্য রানঅ্যাওয়ে ডিরেক্টর)। প্রতিবেদনটি লিখেছেন গায়ত্রী জয়ারমন। সেখানে অনুরাগের নিজের রাগ-ক্ষোভ যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের পক্ষ থেকে অনুরাগের জন্য শুভকামনা।
অনুরাগের সদ্য সাবেক স্ত্রী কালকি ককলিন বলেছেন, ‘বলিউডে এমন কোনো সিনেমাটোগ্রাফার বা অ্যাসিসটেন্ট ডিরেক্টর পাবেন না, যাঁরা অনুরাগের সাথে কাজ করতে চায় না।’
ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-বিরক্ত অনুরাগ ইন্ডিয়া টুডেকে বলেছেন, “আমি সব সময় নিজে যা করতে চেয়েছি তাই করেছি। ‘নো স্মোকিং’ (২০০৭) বা ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’ (২০১২)-এর থেকে ‘বোম্বে ভেলভেট’ (২০১৫) আলাদা কারণ এটা বিগ বাজেটের ছবি, স্টার কাস্টওয়ালা ছবি। এ ধরনের ছবি রিলিজ পাওয়ার আগে থেকেই বিক্রি করা শুরু হয়ে যায়।”
এতটা পথ একা এসে শেষে ক্ষান্ত দিচ্ছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে অনুরাগ বলেন, ‘বলিউড আমাকে শেষ করে দিয়েছে। আমার ব্যক্তিগত জীবন বলে কিছু নেই। এই যে এখন মানুষজন আমাকে গালাগাল দিচ্ছে, এরাই একসময় আমার কাছে এসেছিল তাদের ছবি প্রোডিউস করার প্রস্তাব নিয়ে। সেটা করতে পারিনি। সবার ছবি প্রোডিউস করা আমার পক্ষে সম্ভব না।’
অনুরাগের প্রথম ছবি ‘পাঁচ’ (২০০১) সেন্সর বোর্ডের আপত্তির কারণে অনেকদিন আটকে ছিল। কিন্তু মানুষ বিনামূল্যে ইন্টারনেটে দেখেছে ছবিটি এবং প্রশংসা করেছে।
নিজের কাজের ধরন সম্পর্কে অনুরাগ বলেন, ‘কড়া নোয়া (hard boiled noir) হচ্ছে সবচেয়ে বাস্তব দর্শন, যেটা নিয়ে মানুষ কথা বলতে পারে। ব্যাপারটা অনেকটা খোলা রাস্তায় থাকার মতো। এ বিষয়টি আমাকে সব সময় ভাবিয়েছে। রাস্তায় থাকা একটি মানুষ এমন জগতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেটাকে সে সব সময় ঘৃণা করে।’
বাকস্বাধীনতার বিষয়ে সবার ভণ্ডামি নিয়েও বিরক্ত অনুরাগ, ‘বাকস্বাধীনতার ব্যাপারটা এই দেশে আসলে খুব জটিল। এ দেশের মানুষের সাথে আপনি পারবেন না। ওর অনেক পয়সা, ও একটা সার্কাস, ও গাঁজাখোর, ওর ইংরেজি উচ্চারণ হাস্যকর-অন্যদের সম্পর্কে মানুষের এ রকম হাজারটা অভিযোগ থাকবেই।’
অনুরাগ যোগ করেন, ‘বর্ণবাদের ভিত্তিতে ভারত আজকে ঠিক করছে কার স্বাধীনতা থাকবে, কার থাকবে না। কারণ আমরা একটা মাফিয়া চক্র তৈরি করেছি। এখানে একজন মানুষ যা করছে, সেটা করেই তার জীবন পার হয়ে যাবে। সে আর অন্য কিছু করতে পারবে না।’
সুশীলসমাজ বা নারীবাদীদের ওপরও ভীষণ খ্যাপা তিনি, ‘তারা নিজেরাই নিজেদের সীমাবদ্ধতা থেকে বের হতে পারছে না। আমরা কোনো কিছু নিয়ে মজা করতে পারব না, তাতে ঈশ্বর গোস্যা হবেন। এসব কৌতুক তাদের মুখোশ খুলে দেবে সবার সামনে, তাই তাদের এত ভয়।’
শেষপর্যন্ত ঘুরেফিরে ‘বোম্বে ভেলভেট’-এর কথা চলেই আসে। আসে লাভ লোকসান, ভালো-মন্দের হিসাব। কী বলবেন অনুরাগ?
‘এই দেশে (ভারতে) সিনেমার হিসাব হয় এখন কোটি আর শূন্য দিয়ে। ভালো বা খারাপ সিনেমার মানদণ্ড হচ্ছে ব্যবসা। যে ছবিটা ব্যবসা করতে পারল না সেটা খারাপ ছবি আর যেটা পয়সা কামাল সেটাই ভালো ছবি। আপনি যদি এই ধারণার বাইরে গিয়ে ছবি বানাতে চান, তাহলে আপনাকে অনেক কিছু বাদ দিতে হবে। অনেক যুদ্ধ করতে হবে। আর সে কারণেই এগুলো ছেড়ে দিচ্ছি। অনেক দেখেছি এসব, আর ভালো লাগে না।’
এবার আশা যাক অনুরাগের শুভাকাঙ্ক্ষীদের কথাবার্তায়। অনুরাগের ভারত ছাড়ার ব্যাপারে পরিচালক জয়া আখতার বলছেন, ‘অনুরাগ দুদণ্ড শান্তি খুঁজছেন। ফ্রান্স হচ্ছে সিনেমাবান্ধব দেশ। ওখানে সব সময় নতুন ধরনের সিনেমা নিয়ে কাজ হয়, মানুষ নতুন ছবি নিয়ে আলোচনা করে। সেখানে গেলে অনুরাগ হয়তো কিছুটা শান্তি পাবেন।’
জয়া আখতারের জন্য ‘তালাশ’ (২০১২) ছবির সংলাপ লিখেছিলেন অনুরাগ। অনুরাগের সিনেমা নিয়ে জয়া বলেন, “অনুরাগ সবার থেকে আলাদা। সে হিন্দি সিনেমার ন্যারেটিভটা পাল্টে দিয়েছে। ১৯৯৮ সালের ‘সত্য’ ছবির স্ক্রিপ্ট দিয়ে যেটা শুরু করেছিল, ২০০৪ সালে ‘যুবা’ ছবির স্ক্রিপ্টে সেটা অব্যাহত ছিল। নিজের মতোই কাজ করে গেছে সে। ২০০১ সালের ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ আর ‘পাঁচ’ ছবিটা অনেকদিন আটকে ছিল। অনুরাগের কাছে তখন ছবি করার মতো টাকা ছিল না।”
অনুরাগের প্রথম ছবিতে তিনি ছিলেন। ছিলেন ‘গুলাল’ ছবিতেও। অনুরাগ সম্পর্কে কে কে মেনন বলেন, ‘প্রথম ছবি থেকেই অনুরাগ আলাদা। সেই জেদ সে ঠিকই ধরে রেখেছে।’
অনুরাগের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান অনুরাগ কশ্যপ ফিল্মস প্রাইভেট লিমিটেড (একেএফপিএল)-এর প্রধান নির্বাহী গুণীত মঙ্গা বলেন, ‘অনুরাগের গায়ে আপনি কোনো লেবেল লাগাতে পারবেন না। সে সব সময়ই আলাদা। অনুরাগ আসলে এমন একজন গল্পকার যে পুরো বিশ্বের জন্যই গল্প বলে।’
রণবীর কাপুর বলেছেন, ‘হিন্দি সিনেমার একজন অন্ধভক্ত অনুরাগ। এটাই তাঁর নেশা।’
কালকির কথা দিয়েই শেষ করা যাক, ‘অনুরাগ ওতপ্রোতভাবে হিন্দি সিনেমার সাথে জড়িয়ে আছে। ওর বানারসি রক্তের মধ্যেই এটা আছে। ও ফ্রান্সে গেলেও ভারতীয় সিনেমাই বানাবে। ও-ই এখন ভারতীয় সিনেমার প্রতিনিধি।’
নিন্দুকেরা যাই বলুক অনুরাগভক্তরা বলেন, কশ্যপ নোয়া (noir) বানায় না, ও নোয়া নিয়েই বেঁচে আছে।