নিবিড় অবলোকনে হাসান আজিজুল হক
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের সামগ্রিক সাহিত্য ও মানস মূল্যায়ন নিয়ে সম্পাদিত গ্রন্থের নাম ‘হাসান আজিজুল হক নিবিড় অবলোকন’; সম্পাদক এই প্রজন্মের কথাসাহিত্যিক চন্দন আনোয়ার; প্রকাশকাল-২০১৪, প্রকাশক কথা প্রকাশ। চন্দন আনোয়ার সম্পাদিত ‘গল্পকথা’ সাহিত্যকাগজ থেকে ইতোপূর্বে হাসান আজিজুল হকের ওপর একটি বিশেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এবং সেই সংখ্যার পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত সংস্করণ এই গ্রন্থখানা।
৪৬৪ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে হাসান আজিজুল হকের সামগ্রিক সাহিত্যসৃষ্টির ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। এর সঙ্গে বোনাসপ্রাপ্তি হলো হাসানের মানস মূল্যায়ন, যেটি করেছেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, অশ্রুকুমার সিকদার, সনৎকুমার, দেবেশ রায় ও যতীন সরকারের মতো প্রমুখ পণ্ডিত।
হাসান আজিজুল হকের মূল সৃষ্টি হলো তাঁর গল্পসাহিত্য। বাংলা সাহিত্যে তাঁর টিকে থাকার জন্য গল্পগুলোই যথেষ্ট। হাসানের গল্প নিয়ে লিখেছেন বেশ কয়েকজন কথাসাহিত্যিক-প্রাবন্ধিক। উপন্যাস মূল্যায়ন করেছেন গোলাম মুরশিদ ও সাধন চট্টোপাধ্যায়ের মতো সাহিত্যজনরা। এর পর পর্যায়ক্রমে হাসান আজিজুল হকের স্মৃতিকথা, প্রবন্ধ সাহিত্য, শিশুসাহিত্য ও বক্তৃতার ওপর মূল্যায়নধর্মী প্রবন্ধ ও নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
বইটির বিশেষত্ব অনেক। মোটাদাগে, হাসান আজিজুল হককে জানার ও বোঝার জন্য এ বইয়ের বিকল্প বই এখন পর্যন্ত বাজারে দ্বিতীয়টি প্রকাশিত হয়নি। বইটির নামকরণেই বোঝা যাচ্ছে, এ বই হাতে নেওয়া মানেই ব্যক্তি হাসান আজিজুল হক ও লেখক হাসান আজিজুল হককে পরীক্ষাগারে নিয়ে বসা; একটা একটা গদ্য পড়া আর হাসানের একটা একটা দিক উন্মোচিত হওয়া।
সম্পাদনা নিয়েও কিছু কথা বলা প্রয়োজন। আমাদের এখানে দক্ষ সম্পাদকের বড্ড অভাব। বেশির ভাগ সম্পাদক লেখা চাওয়া আর সেগুলো পড়ে, না-পড়ে প্রকাশ করা ছাড়া আর কিছুই করেন না। এ ক্ষেত্রে সম্পাদক চন্দন আনোয়ারের লেখক-লেখার বিষয় নির্বাচন ও বিন্যাস-পরিকল্পনা অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। তবে হাসান আজিজুল হকের সৃজনশীল সাহিত্যের ওপর বিষয়ভিত্তিক আলোচনা যুক্ত হলে সংকলনটি আরো ঋদ্ধ হতো। হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্যে দৃশ্যত পক্ষপাত পেয়েছে নারীজীবন। বায়োলজিক্যালি তিনি পুরুষ হলেও তাঁর সমগ্র সাহিত্যে বাংলাদেশ তথা সমগ্র ভারতীয় নারীদের জীবনবেদনা যেমন নির্মমভাবে ফুটে উঠেছে, তেমন করে সমসাময়িক আর কারো কলমে তা উঠে আসেনি। কাজেই নারীবাদী হাসান আজিজুল হক অথবা হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে নারীবাদ বা নারীজীবন শীর্ষক আলাদা করে একটি গদ্য থাকতে পারত। এমনি করে তাঁর সাহিত্যপাঠে প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় পুঁজিবাদ ও অস্তিত্ববাদের প্রসঙ্গ ধরে আলাদা আলাদা গদ্য থাকা দরকার ছিল। কেননা, হাসান আজিজুল হক যাঁদের কথা বলছেন, তাঁরা একটি শ্রেণিহীন শ্রেণির (ক্লাসলেস ক্লাস) মানুষের প্রতিনিধিত্ব করছে। এবং তাঁদের সব ধরনের ভোগান্তির সঙ্গে সমাজের অর্থকাঠামোর পরিষ্কার যোগসূত্রতা রয়েছে। শেষ পর্যন্ত অনেক চরিত্র ব্যক্তিজীবনে হেরেও যাচ্ছে; আবার কেউ কেউ এই হারটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, এখানে এসে চরিত্রগুলোর মনস্তাত্ত্বিক টানাপড়েনও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কাজেই হাসান আজিজুল হকের কথাসাহিত্য বিষয়ে জানতে হলে তাঁর সাহিত্যের এই প্রবণতাগুলো বোঝা দরকার।
এখানে হাসান আজিজুল হকের বিষয়-ভাবনা নিয়ে সকলেই কমবেশি বলেছেন, কারো কারো বলার মধ্যে রিপিটেশনও চলে এসেছে। কারণ, মোটাদাগে আমরা সকলেই হাসান আজিজুল হককে একভাবে জানি। অনেক গদ্যকার তাঁদের সেই জানাটার কথাই বলতে চেয়েছেন, নতুন করে কিছু উদ্ধার করতে যাননি। ফলে বইটি আগাগোড়া পড়তে গেলে একটু ক্লান্তি আসবে।
সব মিলিয়ে হাসান আজিজুল হককে নিবিড়ভাবে জানতে হলে এটি একটি অপরিহার্য বই। সম্পাদক চন্দন আনোয়ার ও প্রকাশনী সংস্থা কথা প্রকাশকে ধন্যবাদ জানাতে হয় এত সুন্দর কাজের একটি প্রকাশনা আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য।