স্মরণ
অস্বস্তিকর আহমদ ছফা
আমাদের সভ্যতা-ভব্যতার আরেক নাম হচ্ছে অনেক কিছু ধামাচাপা দিয়ে রাখা। সিঁড়ির ক্ষয় না দেখার জন্য যেমন মাদুর পেতে রাখা। নগ্ন সত্যের চেহারা সহ্য করার মতো মানুষের সংখ্যা খুবই কম। সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক পরিসর- কেউই চায় না সব সময় দেদীপ্যমান সত্যের সাথে বসবাস করতে। শত শত বছর ধরে এই অভ্যাস তৈরি করে ফেলেছে মানবজাতি। সেই অভ্যাসের ব্যত্যয় ঘটা মানেই বিপত্তি। সেই বিপত্তি যিনি সৃষ্টি করেন, তাঁর বিরুদ্ধে এস্টাবলিশমেন্ট মুক্তকচ্ছ হয়ে নামবে এটাই স্বাভাবিক। যাঁরা কর্তৃত্বকারী প্রচলিত ব্যবস্থা এবং মসৃণ দিনযাপনকে অস্বস্তিকর সব প্রশ্ন এবং প্রসঙ্গ উত্থাপনের মাধ্যমে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন, তাঁরা যে নিগ্রহের শিকার হবেন, এ কথা বোঝার জন্য পণ্ডিত হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশের ইতিহাসে, একক ব্যক্তি এবং ব্যক্তিত্ব হিসেবে আহমদ ছফা এস্টাবলিশমেন্টের জন্য যতখানি অস্বস্তিকর ছিলেন, ততখানি আর কেউ ছিলেন না। এখনো হতে পারেননি।
প্রসঙ্গের আবতারণা করার আগে আমাদের জন্য এটা খোঁজ করাও জরুরি যে, আহমদ ছফা নিজেকে এভাবে অস্বস্তিকর করে তুললেন কোন মানসিকতার কারণে? আমাদের কাছে সস্তা একটা উত্তর সব সময় মজুদ থাকে। তা হচ্ছে স্টান্টবাজি করে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণের প্রবণতা। কিন্তু আহমদ ছফার ক্ষেত্রে এই খেলো জিনিসটা আদৌ খাটে না। জীবনব্যাপী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কেউ স্টান্টবাজি করে যেতে পারেন না। বাকি থাকে নিজেকে অন্য রকম চিন্তার মানুষ হিসেবে উপস্থাপনার প্রবণতা। অন্য রকম হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করার প্রবণতা আয়ত্ত করার প্রয়োজনই পড়েনি আহমদ ছফার। কারণ তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলেন অন্য রকমই। কোত্থেকে তাহলে অর্জন করলেন আহমদ ছফা এই প্রবণতা? তিনি এটা অর্জন করেছেন শ্রেণী দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সমাজের বিদ্যমান অসঙ্গতিগুলোর প্রতি ঘৃণা থেকে, বুদ্ধিবৃত্তির নামে ব্যবসা ফাঁদার প্রবণতার প্রতি ধিক্কার থেকে। তবে আমার মনে হয়, আহমদ ছফা সবচাইতে বেশি বিরোধী ছিলেন যে বিষয়টির, তার নাম ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং ব্রাহ্মণ্যতন্ত্র। সেটি আক্ষরিক এবং প্রতীকী, আদি এবং নয়া, এদেশি কিংবা বিদেশি- যে ব্রাহ্মণ্যবাদই হোক না কেন। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরেও যে সমাজে, পরিবারে, নানা ধরনের অসংখ্য ছোট-বড়-মাঝারি ক্ষমতাকেন্দ্র বিরাজমান, আহমদ ছফা সেই বিষয়ে সচেতন ছিলেন। এসব ক্ষমতাকেন্দ্রেও তিনি ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতার ছায়া নির্ভুলভাবে শনাক্ত করতে পেরেছেন। তাই তাঁর সকল উদ্যোগ বা তৎপরতার পেছনে কাজ করেছে এক বৃহত্তর রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক মানসিকতা। সেখানে তুচ্ছ হয়ে গেছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক। বিভিন্ন ব্যক্তির সাথে বিভিন্ন সময় যে বিতর্ক বা দ্বন্দ্বে জড়িয়েছেন আহমদ ছফা, সেখানে ব্যক্তিগত আক্রোশ বা স্বার্থের গন্ধ খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তিনি যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন, সেই ব্যক্তিকেও একটি প্রতিষ্ঠান বা ক্ষমতাকেন্দ্রের প্রতিনিধি হিসেবে গণ্য করেই তাঁর বিরোধিতা করেছেন। কখনো কখনো তাঁর বিবেচনা বা বিচার ভুল হয়েছে হয়তো। কিন্তু সেসব বিতর্ক যে সচেতন মানুষের সামনে অনেক নতুন চিন্তা এবং চিন্তাপদ্ধতির পথ খুলে দিয়েছে, সেকথা তো আর অস্বীকার করা যাবে না।
আমরা আহমদ ছফার অনেক অস্বস্তিকর কার্যকলাপ নিয়ে আলোচনা করব। প্রথমেই সাহিত্য। কারণ প্রথম ও শেষ বিচারে আহমদ ছফার বিচরণ-ক্ষেত্র সাহিত্যই।
০২.
বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পরে আহমদ ছফাও অন্যদের মতো আশায় বুক বেঁধেছিলেন যে এই ভূখণ্ডে সত্যিকারের রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। তবে অচিরেই তিনি এই সত্যটাও বুঝে নিয়েছিলেন যে সত্যিকারের মানবমুক্তির জন্য যে রেনেসাঁর স্বপ্ন তিনি দেখেছেন, সেই রেনেসাঁ পরিচালনা করার মতো রাজনৈতিক নেতৃত্ব তো নেই-ই, বুদ্ধিবৃত্তিক-সাহিত্যিক নেতৃত্বও অনুপস্থিত। ১৯৭২ সালে আহমদ ছফা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক। থাকতেন আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের ২০৬ নম্বর রুমে। কিন্তু আমরা সবাই জানি যে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। সম্ভব যে হয়নি, তার পেছনের কারণ তাঁর মেধার ঘাটতি নয়। কারণ হচ্ছে ডিগ্রি অর্জনের তুলনায় সেই সময়ের ডাকে সাড়া দেওয়াটাকে তিনি অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে ভেবেছিলেন। সাঈদ-উর-রহমানের স্মৃতিকথা থেকে আমরা পেয়েছি কারণটি- ‘মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের চাঞ্চল্য তাঁকে কখনো স্থির থাকতে দেয়নি- একটা কিছু করো- সেই আবেগ ও প্রেরণা পিএইচডি করার সামান্য সীমাবদ্ধ বৃত্ত থেকে তাঁকে বাইরে নিয়ে যায়। সংগঠন করা, পত্রিকা বের করা, বই লেখা, সেমিনার করা, প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিবৃত্তিক কাঠামো ভেঙে বিপ্লবের জন্য নতুনভাবে নির্মাণ করা- ইত্যাকার কাজে ও স্বপ্নে তিনি বিভোর থাকতেন।’
এই সময়টাতেই আহমদ ছফা আবির্ভূত হন সত্যিকারের অস্বস্তিকর ছফার ভূমিকায়। ১৯৭৩ সালে ‘গণকণ্ঠ’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হতে থাকে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’। সেই সময় দেশের প্রতিষ্ঠিত-অপ্রতিষ্ঠিত লেখক-বুদ্ধিজীবীরা প্রতি সপ্তাহের কিস্তির দিকে তাকিয়ে থাকতেন আগ্রহ এবং আতঙ্ক নিয়ে। যে দীর্ঘ রচনার শুরু হয় এমন একটি বাক্য দিয়ে, যার মাধ্যমে ঘোষণা করা হয়েছে এই দেশের প্রচলিত বুদ্ধিবৃত্তির অসারতা এবং অন্তঃসারশূন্যতা, সেই রচনা যে নিজেকেসহ দেশের তাবৎ বুদ্ধিজীবীর মননজগৎকে বেআব্রু করে দেবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আহমদ ছফার অনাস্থার ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। এই বইতেই তিনি ইতিহাস ঘেঁটে সেই সব বুদ্ধিজীবীদের চরিত্র উন্মোচন করার চেষ্টা করেছেন, যাঁরা রাষ্ট্রের সংস্কৃতি-সাহিত্যের ক্ষমতাশালী জায়গাগুলো দখল করে বসে থেকেছেন, কিন্তু জাতিকে পথ দেখানোর মতো কোনো সৃষ্টি উপহার দিতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা ‘পত্রিকার রবিবাসরীয় সংখ্যার জোগানদার, রেডিও টেলিভিশনের অঙ্গসজ্জা এবং বিকৃত রুচিহীন নীরস পাঠ্যপুস্তক প্রণেতার অধিক কিছু নন।’ আজকের দিন হলে ছফা যোগ করতেন যে এই বুদ্ধিজীবীরা হচ্ছেন টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোর অগভীর টক-শো নামক আলোচনার ক্লাউন, পত্রিকার উপসম্পাদকীয় নামক চর্বিত চর্বনের জোগানদার, চ্যানেলের নাটক নামক নর-নারীর কিম্ভূত কার্যকলাপ দেখানোর স্ক্রিপ্ট লেখক, তুমি-আমি মার্কা সংগীত নামক একঘেয়ে প্যানপ্যানানির লেখক। আহমদ ছফা সক্ষোভে পাকিস্তান আমলে তাঁদের কার্যকলাপের বিবরণ দিতে গিয়ে আইয়ুব খান প্রতিষ্ঠিত লেখক সংঘের উদাহরণ টেনে আনেন। ছফার ভাষায়- ‘লেখক সংঘ মানে লেখকেরা কী ভাববেন, কী চিন্তা করবেন, কীভাবে লিখবেন জঙ্গিলাট ঠিক করে দেবেন। তিনি যা বলবেন- এঁরা তা লিখবেন। বিনিময়ে লেখকদের দেওয়া হলো অঢেল সুযোগ-সুবিধা। তাঁদের জন্য আদমজী পুরস্কার, ঘন ঘন বিদেশ যাওয়া ইত্যাদির ব্যবস্থা করলেন। সেদিন বাংলাদেশে একজন লেখকও লেখকের সুস্থ এবং স্বাধীন মননশীলতার বিরোধী এই প্রতিষ্ঠান স্থাপনের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করেননি। বরং সবাই বগল বাজিয়ে আপনা থেকেই এগিয়ে এসে অংশগ্রহণ করেছেন।’
একই সঙ্গে ঢাকার মার্কিন দূতাবাস থেকে মোটা টাকা সম্মানী দিয়ে প্রগতিবিরোধী রচনাসমূহ অনুবাদের যে মাস্টার প্ল্যান করা হয়েছিল, তাতেও এদেশের প্রথম সারির লেখক-বুদ্ধিজীবীরা হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন। তাঁদের অনুবাদকর্ম যে জাতির মননের জন্য ভয়ানক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে, সেকথা ভেবে তাঁরা কেউই মোটা অঙ্কের টাকার লোভ সামলাতে পারেননি।
আহমদ ছফার ক্ষোভ তীব্রতর হয়ে ওঠে যখন দেখেন যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সেই একই বুদ্ধিজীবীরা রাষ্ট্রের বড় বড় আসনে অধিষ্ঠিত হচ্ছেন। স্বাধীনতার পরে যে দেশ সমাজতন্ত্র অভিমুখে যাত্রা করবে বলে দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা দিয়েছে, সেই দেশে চরিত্রহীন বুদ্ধিজীবীরা যে জাতিকে সমাজতন্ত্রের পথনির্দেশনা দিতে পারবেন না, তা দুগ্ধপোষ্য শিশুও বুঝতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্রের পরিচালকরা বুঝতে পারেন না। আসলে বুঝতে চান না। কারণ তাঁদের শ্রেণীস্বার্থ এক।
রেনেসাঁর পথে আচারসর্বস্ব এবং অনুশাসনমূলক ধর্মকে এক বড় বাধা মনে করা হয়। ছফা এই বাধা ঠিকই শনাক্ত করতে পেরেছেন। তাই সেদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে বলেছেন- ‘এই বাংলাদেশে যেখানে শতকরা আশিজন মানুষ মুসলমান- আশিজনের মধ্যে ঊনসত্তর জন সংস্কারান্ধ, সেই সমাজে আজকে যদি একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব সাধনের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়, তার চেহারা কী হবে? ধর্মীয় সমস্ত অনুশাসনের অনেকগুলো কি রদ করতে হবে না? যদি তাই হয়, জোর করে কি সেসব সম্ভব? জ্ঞানের সাহায্যে নিষ্কলঙ্ক মানবতার বাণী প্রচার করে তার কি একটা ক্ষেত্র রচনা করতে হবে না?’ কিন্তু ‘ধর্মের আওতাভুক্ত বিধি, আচার, বিশ্বাস, সংস্কার, রীতি-নীতি, নিয়ম-কানুন এসব অস্বাস্থ্যকর জেনেও কোনো লেখক শৈল্পিকভাবে বা বিজ্ঞোচিত অথবা মানবোচিকভাবে এ সবকে চ্যালেঞ্জ করেননি। যেখানে পুরনো বিশ্বাস, পুরনো মূল্যবোধের প্রতি সজ্ঞান মেধাবী চ্যালেঞ্জ নেই, সেখানে মহত্তরো সৃষ্টির সম্ভাবনা কোথায়? যে যুথবদ্ধ প্রথায় প্রশস্তি রচনা করে, সে তো দাসত্ব করে, তার অন্তরাত্মা পরাধীন। এই পরাধীন অন্তর থেকে কেমন করে স্বাধীন চিন্তা যা মহত্তরো সৃষ্টি শোণিত হবে? আবার সমাজকে পিঠ দিয়ে একা আনমনে নিজের ভাবনা চিন্তা নাড়াচাড়া করার মধ্যেও ব্যক্তির সাধনার পূর্ণতার অভিলাষ কোথায়? পূর্ণতার সাধনা যেখানে নেই, সেখানে ব্যক্তির একান্ত অন্তরঙ্গ আবেগ কীভাবে খেলা করে? এখনো পর্যন্ত কোনো বাঙালি মুসলমান লেখক তাঁর সমাজের প্রাণহীন আচার পদ্ধতি, মূঢ়তা, স্থূলবিশ্বাস এসবকে চ্যালেঞ্জ করেননি।’
তাহলে কীভাবে রেনেসাঁ আসবে? রেনেসাঁ মানে তো শুধু সাহিত্য নয়, শুধু রাজনীতি নয়, জ্ঞানের এবং চিন্তার সকল শাখায় উত্তুঙ্গ অভিযাত্রা। শিক্ষা ক্ষেত্রে, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে, বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে, মননশীলতা চর্চার ক্ষেত্রে যে চিত্র দেখতে পেয়েছেন আহমদ ছফা, তা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। বিলেত-আমেরিকাফেরত ডিগ্রিধারীদের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সেই সব ডিগ্রিধারী সমাজের সম্পদ না হয়ে সমাজের বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছেন। তাঁরা তিন বা চার বছর উচ্চশিক্ষার্থে বিলেতে অবস্থান করে যে গবেষণাপত্র প্রণয়ন করছেন, শাহবাগের পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে তিন মাসের মধ্যে সেই গবেষণাপত্র তৈরি করা সম্ভব। তার মানে, উচ্চতর বিদ্যার্থীরা জ্ঞানচর্চা নয়, বিদেশি ডিগ্রির জন্য এবং বিদেশে অবস্থানের জন্য লালায়িত।
এই নিরেট সত্য উচ্চারণ কারো জন্যই স্বস্তিকর ছিল না। ঢালাওভাবে সকল লেখক-বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে এই রকম অভিযোগ তোলার বিরুদ্ধে অবশ্যই প্রতিবাদ করা সম্ভব। সম্ভব এমন দু-চারজন লেখককে খুঁজে বের করা, যারা এই সব প্রবণতা থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু সাধারণভাবে এই অভিযোগ তো সত্য। কিন্তু আহমদ ছফা ছাড়া আর কেউ কেন এই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলি উত্থাপন করতে এগিয়ে এলেন না? আরো বেশ কয়েকজন নিশ্চয়ই ছিলেন, যাঁরা একই রকমভাবে না হলেও ছফার মতোই অনুভব করছিলেন যে বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস প্রয়োজন? এই জায়গাতেই অনন্য আহমদ ছফা। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন, বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধার জন্য আর কাউকে প্রয়োজন হয়নি।
সমসাময়িক কোনো বড় এবং প্রতিষ্ঠিত লেখকের সঙ্গে যে আহমদ ছফার তেমন সদ্ভাব ছিল না, জীবন এবং সৃষ্টির পুরো সময়টাতেই যে তাঁকে প্রায় নিঃসঙ্গ থাকতে হয়েছে, তার পেছনের কারণ আহমদ ছফার এই সব দুঃসাহস এবং তার প্রয়োগ।
রাজনীতিকে খুব বড় স্থান দিতেন আহমদ ছফা। কারণ হিসেবে বলতেন- নতুন প্রজন্মের সামনে কোনো রাজনৈতিক আদর্শ না থাকলে তার সবচাইতে বড় শিকার হয় শিল্প-সাহিত্য। আবার লেখক-কবিকে সব সময় তার মতাদর্শ দিয়ে না মেপে সাহিত্যে তার অবদান দিয়েও বিচার করার ক্ষেত্রে আহমদ ছফা মাঝে মাঝেই সোচ্চার হয়ে উঠতেন। যেমনটি ঘটেছিল ফররুখ আহমদের ক্ষেত্রে। কবি ফররুখ আহমদ পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। পাকিস্তান ছিল তাঁর স্বপ্নে ছিল পঞ্চম খোলাফায়ে রাশেদিনের আমল হিসেবে। সেই পাকিস্তান তাকে হতাশ করলেও তিনি পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার পক্ষেই মতামত পোষণ করেছেন। যদিও কোনোদিন কোনো পাকিস্তানি শাসক তাঁকে দিয়ে কোনো সুবিধাবাদ গেলাতে পারেনি, তবু মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনি অনেকের কাছে ব্রাত্য হয়ে পড়েন। রোগজর্জর, দারিদ্র্যজর্জর ফররুখ আহমদের পাশে সোচ্চারভাবে দাঁড়িয়েছিলেন তখন আহমদ ছফা। আবার সেই আহমদ ছফাই ছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের কট্টর সমালোচক। বঙ্কিম-বিচারের ক্ষেত্রে আহমদ ছফা তাঁর সাহিত্যকে সূচক হিসেবে না ধরে হিন্দু-ভারতীয় জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক পিতৃপুরুষ হিসেবেই দায়ী করে গেছেন। অস্বস্তি আরো বেড়ে যায়, যখন তিনি ভূদেব, রামমোহন এমনকি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকেও রেনেসাঁর পথিক না বলে রিভাইভিলিজমের প্রবক্তা হিসেবে উল্লেখ করেন। আহমদ ছফার নিজের ভাষায়, ‘বিদ্যাসাগর তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করেছেন বিধবা বিবাহ সমাজ সংস্কারমূলক আন্দোলনে। সাহিত্যের কাজে সময় দিয়েছেন অনেক কম। এ কথা রামমোহন এবং তাঁর সহমরণ নিবারণ সম্পর্কেও। এসব মুসলমান সমাজের সমস্যা ছিল না। শুধু মুসলিম সমাজ নয়, নিম্নবর্ণের হিন্দুদেরও সমস্যা ছিল না। এটাকে কেউ শখ করে জাগরণ বললে বলতে পারেন। কিন্তু এটা ছিল অত্যন্ত স্মল গ্রুপের জাগরণ। তার বাইরে এর কোনো প্রভাব ছিল না এবং জাগরণ তারা এমনভাবে ঘটিয়েছিলেন যাতে অন্যরা অবহেলিত এবং লাঞ্ছিত থাকেন।’
প্রায় শত বছরের প্রচার-প্রচারণায় বাঙালির ধ্যান-ধারণায় যারা প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে উঠেছেন, তাদের সম্পর্কে এই রকম কালাপাহাড়ি মন্তব্য সমাজে শুধু অস্বস্তি নয়, রীতিমতো অসন্তোষও সৃষ্টি করে। আবার বঙ্গীয় রেনেসাঁর ফলাফল দেখে এই ধরনের প্রশ্ন ওঠার যুক্তিযুক্ততাও তো অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
পশ্চিমবঙ্গীয় সাহিত্যিক সমাজ তথা বিদগ্ধ সমাজের প্রতি আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা কাজ করে এসেছে দীর্ঘকাল। তার যৌক্তিক কারণও রয়েছে অনেক। কিন্তু আহমদ ছফা যখন তীব্রভাবে আক্রমণ শানান এই অতিভক্তি এবং হীনমন্যতার ওপর, তখন এতদিনের অভ্যস্ততার প্রতিফল হিসেবে নিজেদের ভেতর থেকেই আসে প্রতি-আক্রমণ। আহমদ ছফা মনে করিয়ে দেন যে- ‘ঐতিহাসিক কারণে দীর্ঘদিন ধরে এখানে কোলকাতার বইয়ের একটা বাজার ছিল এবং কোলকাতার বইয়ের বাজারকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো বইয়ের বাজার এখানে গড়ে ওঠেনি। বই লেখা তো যথেষ্ট নয়, বই প্রমোট করা, বইয়ের আলোচনা করা, নানা কারণে এখানে সেসব হয়নি। স্বাধীনতার পরে নানা রকম রাজনৈতিক দুর্বিপাকে পড়ে আমাদের গ্রন্থশিল্পটা বিকশিত হতে পারেনি। কিন্তু কোলকাতার গ্রন্থশিল্প অনেকদিন আগে থেকেই বিকশিত। সেই সূত্রে কোলকাতার বই বাংলাদেশের সমস্ত বইয়ের বাজার দখল করে নিল। এর মধ্যে আনন্দবাজারের বইই ছিল শীর্ষে। পুলিশ দিয়ে এটা বন্ধ করা যায় না। ১৯৯৪ সালে আমি বুকে পোস্টার দিয়ে এর প্রতিবাদ করলাম। অন্য কোনো প্রকাশকের বিরুদ্ধে নয়। আমার প্রতিবাদ শুধু আনন্দবাজারের বিরুদ্ধে। যে বইয়ের জন্য আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে আনন্দ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, সেই বইতেই আনন্দবাজারকে বলা হয়েছে বাঙালি জাতির শত্রু। বাংলা ভাগ করার পেছনে এই পত্রিকাটির ভূমিকা অনেক। আমরা যখন ভাষা আন্দোলন করছি, সমর সেনের ‘বাবুবৃত্তান্ত’ পড়ুন, তখন রায়ট লাগাবার জন্য ইলিশের পেটে হিন্দু রমণীর মস্তক পাওয়া গেছে বলে সংবাদ লিখে আনন্দবাজার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়িয়েছে। এবং তসলিমাকে নিয়ে আনন্দবাজার যা করেছে, গোটা দুনিয়ার কাছে আনন্দবাজার বাংলাদেশকে তুলে ধরল একটি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী দেশ হিসেবে। কিন্তু কে মৌলবাদী, ভারত না বাংলাদেশ? মৌলবাদী উত্থান হচ্ছে ভারতে, বিজেপি এবার দিল্লির ক্ষমতায় আসছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের সংসদে জামায়াত এবার পেয়েছে মাত্র তিনটি আসন।’
এটা ছিল ১৯৯৬ সালের মূল্যায়ন। আহমদ ছফার একটা মূল্যায়ন কেবলমাত্র ভুল প্রমাণিত হয়েছে। সেটা বাংলাদেশের প্রসঙ্গেই। জামায়াতে ইসলামী ক্ষমতায় গেছে ২০০১ সালে বিএনপির কাঁধে চেপে। ক্ষমতার বাইরেও বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের ধ্বংসাত্মক তৎপরতা জনজীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। অন্য সব ভবিষ্যৎ-আশঙ্কাও ফলে গেছে। বিশেষ করে ভারতে। কলকাতা সম্পর্কে আহমদ ছফার সত্য অভিযোগের অন্ত নেই। অস্বস্তিকর সব সত্য তিনি তুলে ধরেছেন প্রবন্ধে, বক্তৃতায়, আলোচনায়, সাক্ষাৎকারে। তাঁর ভাষায়- বাংলা হচ্ছে ভারতীয় রাজনীতিতে আন্ডার ড্রেইন। দিয়েছে বেশি পেয়েছে বঞ্চনা। বাংলাতেই প্রথম ব্যাংক, শিপিং কোম্পানি, ইন্সুরেন্সের ব্যবসা শুরু হয়েছিল। বাংলাতে প্রখম বুর্জোয়া অর্থনীতি বিকাশের সূত্রপাত ঘটেছিল। বাঙালিরা সেসব কিছুই ধরে রাখতে পারেনি। কর্নওয়ালিস বাঙালিকে নকল ভূস্বামী বানিয়ে দিল। তখন বাঙালির ব্যবসা-বাণিজ্য সব চলে গেল। এবং বাঙালি একদিকে হলো বাবু অন্যদিকে কেরানি। দেশভাগের সময় আবুল হাশিম একটা চমৎকার কথা বলেছিলেন, পশ্চিম বাংলার হিন্দুদের হলোটা কী? ১৯০৫ সালে যারা মাতৃঅঙ্গ বিচ্ছেদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন, অবাঙালির অর্থে, অবাঙালির চিন্তা ও মতামতের বাহক হয়ে, তারাই আজকে বাংলাকে ভাগ করছেন।’
আহমদ ছফা আরো আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘দিল্লি-হিন্দির আধিপত্যের গুণগান কোলকাতার শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদরা যত করে থাকেন, ভারতের অন্য কোনো শহরে এ চিত্র আপনি পাবেন না। কারণ অন্য শহরের মানুষের নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে শিকড়ের যে সম্পর্ক আছে কোলকাতার তা নেই। তাই হিন্দির সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য কোলকাতাই বেশি মেনে নিচ্ছে। আবার কোলকাতার সাহিত্যিক বা রাজনৈতিক নেতারা ঢাকায় এলে, তাদের বাংলা ভাষাপ্রেম আকাশ স্পর্শ করে। এই দ্বিচারিতা কোলকাতার মজ্জাগত। কারণ কোলকাতা শহরটা হচ্ছে কলোনাইজেশনের প্রথম ডিচ।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পর এই ধরনের কথাবার্তা কেবলমাত্র কোলকাতামুখী লেখক-শিল্পীদেরই নয়, বিভিন্ন সরকারকেও অস্বস্তিতে ফেলার জন্য যথেষ্টই ছিল।