আহমদ ছফার বাংলা!
উইল ডুরান্টের বই ‘দ্য স্টোরি অব ফিলোসফি’ বইয়ের কথা অনেকের জানা। অভ্যাস বশে বইটি নাড়াচাড়া করছিলাম। নামজাদা সব দার্শনিককে নিয়ে আলোচনা। কিন্তু ডুরান্টের বইটিতে সম্পাদনায় বেশ কজন দার্শনিকের কর্ম কথা বাদ গেছে। যদি লেখকের রুচির অভিপ্রায় ধরে নিই তাতে কোনো সমস্যা নাই। সমস্যা অন্যখানে, সক্রেটিস থেকে বার্টান্ড রাসেল সবই আছে, তবে রনে দেকার্ত, জ্য জাক রুশো, ভিলহেম হেগেল, কার্ল মার্কসের কথা নাই। এদের বাদ দিয়ে দর্শনশাস্ত্র দেখা এক চোখে দেখার তুল্য। কথাটা বললাম একটি কারণে, কোনো সমাজ বা ব্যক্তি যখন কোনো ‘মণীষী’কে না চেনে বা না দেখে তাতে বলতে হবে চিন্তার কাঠামোগত সমস্যা। কেন এই সমস্যা বাধে?
সমস্যা যেমন ডুরান্টের, ঠিক তেমনি আমাদের সমাজের। কেননা আপন মতের বাইরে অপর মতকে না বোঝার বা অগ্রাহ্য করার মাঝে এক ধরনের আহাম্মকি আছে। দর্শনের গ্রাহ্য বলতে অন্য মতকে আমলে নেওয়া বা প্রশ্ন করা বা উত্তর খোঁজার ভেতর সামাজিক সম্পর্ক উৎপাদন বোঝায়। চিন্তার সাথে সংস্কৃতির এই সম্পর্ক নির্ধারণ করতে না পারলে কোনো সমাজ টিকে থাকতে পারে না। মানে সমাজ অনৈতিক, রাজনীতি দুর্বৃত্তপনা আর রাষ্ট্র বা দেশ ধীরে ধীরে অকার্যকর হয়ে পড়ে। এটি কমবেশি সবাই জানে। কিন্তু আমাদের সমাজে নানা বিষয়ে চিন্তা বা নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানুষ নিতান্তই কম। আহমদ ছফার মতো চিন্তাশীল মণীষী দুই চারজন যা আছেন তাঁদের নিয়ে তেমন রা নাই। এটা সমাজ বা রাষ্ট্রের পশ্চাদপদের প্রতিচ্ছবি। যাক সেই বেদনার কথা!
আহমদ ছফা স্বভাবে একরোখা মানুষ। নানা সমাজ বা রাষ্ট্রের নানা বিষয়ে ভাবতেন। অন্যদের ভাবাতেন। প্রশ্ন তুলতেন। উত্তর খুঁজতেন। আমরা আজ কথা তুলব তাঁর অতুলনীয় লেখা ‘বাংলা ভাষা : রাজনীতির আলোকে’। সেখানে তাঁর জিজ্ঞাসা, ‘বর্তমানে যে সকল পণ্ডিত, লেখক, অধ্যাপক এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলা ভাষা চালুর পক্ষে কলম ধরেন, সভা-সমিতিতে বিবৃতি পাঠ করেন, মুখে মুখে বাংলা ভাষাপ্রেমিক বলে জাহির করেন, তাঁদের কাছে যদি জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনারা কোন ভাষাটি চালুর কথা বলছেন? কলকাতার যেই বাংলা ভাষাটি চালু আছে সেটি নয়তো?’ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছরের মাথায় ছফা এই প্রশ্ন তুলেছিলেন। তাঁর আরো জিজ্ঞাসা, ‘যদি বলেন, কলকাতার বাংলা ভাষাটি যদি ভাঙচুর না করা হয় তাহলে বাংলাদেশের মানুষের উপযোগী বাংলা ভাষা তো তৈরি হতে পারবে না। এই সম্পর্কে আপনার কী মত?’ এই ব্যাপারে ছফার শঙ্কা, ‘সম্ভবত তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারবেন না।’
এ কথা ঠিক, আহমদ ছফার ভাষায়ও তো কলকাতার বাংলার ছাপ স্পষ্ট! ছফা এটা কাটিয়ে উঠতে পারেন নাই ঠিক, কিন্তু রাষ্ট্রের এই ক্ষতের কথা তিনি প্রশ্ন আকারে জারি রেখেছেন। রাষ্ট্র যখন তার ভিত্তি নিয়ে দাঁড়াতে চাইবে তখন ভাষার প্রশ্ন সামনে আসবে। মানে রাষ্ট্রে তার ভাষার কাঠামো কি হবে? ছফার দুটো জিজ্ঞাসার ভেতরে বর্তমান বাংলা ভাষা নিয়ে হালের ভাষা বিতর্ক প্রোথিত আছে। দুই দিক থেকে এসব প্রশ্ন জারি আছে। প্রথমত রাষ্ট্রের দিক হতে। আর অপর দিক হতে সাহিত্যের ভাষার প্রশ্নে। আজকাল যে তরুণ নতুন সাহিত্যের ভাষা নিয়ে নানা কথা বলেন, তাঁর প্রশ্নটাই তো স্বাধীন বাংলাদেশে আহমদ ছফা তৈরি করেছেন। এ কথা অনেকেই জানলেও বলেন না। আবার অনেকে জানেন না। ছফার কৃতিত্ব এইখানে, তিনি সমাজ বা রাষ্ট্রের ভেতরকার সংকটগুলো সহজে ধরতে পারতেন।
কোনো রাষ্ট্রে ভাষা তার উৎপাদন কাঠামো, প্রথা, আচার-বিচার, সাংস্কৃতিক পালাবদলের ভেতর দিয়ে ভাষার রূপ বদলায়। ছফা এই বদলের রূপটাই বা সংকটটা সহজে চিহ্নিত করতেন। হয়তো কেউ কেউ বলবেন, ছফা তো দার্শনিক নয়! কিন্তু দর্শনের জ্ঞানগত রূপ বিচার করলে দেখা যাবে, ধারণা হতে চিন্তা, চিন্তা হতে প্রশ্ন, প্রশ্ন হতে উত্তরণের পথ দেখা। এটাই সমাজে একজন দার্শনিকের কাজ। ছফা এই অর্থে একজন দার্শনিক বা চিন্তাবিদ বটে। আহমদ ছফা ছিলেন বলি নাই, কারণ নিছক ব্যক্তির না থাকা মানে দৈহিকভাবে না থাকা। আর ব্যক্তিত্বের থাকা মানে ব্যক্তির চিন্তা বা প্রশ্ন সমাজে জারি থাকা। তিনি সমাজ, সংস্কৃতি আর চিন্তা কাঠামোয় বেঁচে আছেন। আছেন প্রশ্ন আকারে। কেন তিনি আছেন? আমরা যেদিন উত্তর খুঁজব সেদিন হয়তো বলা যাবে, আহমদ ছফার বাংলা কী জিনিস?