কুরোসাওয়া কথা
স্টোরিটেলার
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
আগেই বলেছি, আমার বাবার আচার-আচরণ ছিল চরম কঠোর রকমের। আমার মা ছিলেন ওসাকা অঞ্চলের [শহর] বণিক পরিবারের সন্তান; ফলে সামুরাই শিষ্টাচারের সূক্ষ্ম দিকগুলোর প্রতি তার সংবেদনশীলতা ছিল তুলনামূলক কম; ফলে প্রত্যেকের খাবারের মাছ আলাদা আলাদা ট্রেতে সাজানোর কারণে তাকে নিয়মিতই বকা শুনতে হতো। ‘বেকুব! তুমি কি আমাকে আত্মহত্যা করাতে চাও নাকি?’ দৃশ্যতই খাদ্য পরিবেশনের একটি সবিশেষ প্রক্রিয়া ছিল সেখানে, যা কি না একটি ধর্মশাস্ত্রীয় আত্মহননের পরিচায়ক। বিষয়টি খালায় মাছের অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল। আমার বাবা তার চুলে শিশুদের মতো করে একটা সামুরাই টপনট পরতেন, এবং এমনকি যখন তিনি রাগ ঝাড়তেন, তখনো বসার ঘরে পিঠ ঠেকিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় বসে থেকে শান দেওয়ার পাউডার দিয়ে নিজের তলোয়ারটি ধারাল করতে থাকতেন। ফলে তার রেগে যাওয়ার সময়টিও যথেষ্ট স্বাভাবিক অবস্থা হলেও, মায়ের জন্য কিছুই করতে পারছি না বলে অসহায় লাগত আমার। ভাবতে থাকতাম, মাছের মাথা নিয়ে কী ঝামেলাটাই না তাকে পোহাতে হয়। তবু মা একই ধরনের ভুল বারবারই করতে থাকতেন। প্রতিবারই বাবার সামনে ভুলভাবে পরিবেশন করতেন মাছ, আর বাবা তার ওপর ক্ষেপে যেতেন। এ বিষয়টি নিয়ে এখন যখন ভাবি, মনে হয়, বাবা সবকিছুতেই এত খুঁত ধরে বেড়াতেন যে, মা এ সব আর কানে নিতেন না; তার অবস্থা হয়ে গিয়েছিল যেন, 'পুবের বাতাসে বধির হয়ে যাওয়া ঘোড়া'র মতো।
আমি এখনো ভেবে পাই না, কোনো খাবারের ট্রে পরিবেশন করার ভেতর দিয়ে কাউকে কীভাবে আত্মহননে প্রলুব্ধ করা যায়? আমি আমার সিনেমায় ধর্মীয় আত্মহননের কোনো দৃশ্য এখনো রাখিনি। কিন্তু আপনি যখন কোনো খাবারের পাত্রে মাছ পরিবেশন করবেন, স্বাভাবিকভাবেই সেটির মাথা থাকবে বাম দিকে, আর পেট থাকবে আপনার দিকে মুখ করা—যেন সহজে পাতে তুলে নিতে পারেন। এ কারণে যদি আপনাকে আত্মহননে প্রলুব্ধ করা হয়, তাহলে আমি বরং মাছের মাথাটি ডান দিকে রেখে, পেটটি আপনার বিপরীত দিকে রাখব; কেননা, কেননা তাহলে একটা রান্না করা মাছের পেট এমন কারো দিকে সরাসরি বাড়িয়ে দেওয়া হবে—যে কি না নিজেরই পেট কেটে ফেলতে উদগ্রীব! এটা আমার ধৃষ্টতা; তবে ধৃষ্টতার চেয়ে অধিক কোনো মাহাত্ম এতে নেই।
তা ছাড়া আমি মনে করি না, আমার মা এমন কিছু করে থাকবেন—যা অন্য কোনো জাপানি ভাবতেও পারে না; যেমন ধরুন, রান্না করা মাছ এমনভাবে পরিবেশন করা—যেন গ্রহীতা সেটি সহজে পাতে নিতে না পারে, অর্থাৎ সেটির পেট সেই লোকটির বিপরীতমুখী রেখে দেওয়া। তার মানে, তার একমাত্র ভুলটি সম্ভবত ছিল, মাছের মাথাটি ডানপাশের বদলে বামপাশে রাখা! আর এ কারণটিই বাবাকে তার ওপর ক্ষেপিয়ে তুলত।
খাবারের সময় শিষ্টাচারবহির্ভূত স্বভাবের জন্য আমাকেও রাগের শিকার হতে হতো। আমি যদি চপস্টিক ভুলভাবে ধরতাম, বাবা তার চপস্টিকগুলো হাতে তুলে নিয়ে, আমাকে আচ্ছামতো বকা দিতে দিতে দেখিয়ে দিতেন। এসব ব্যাপারে বাবা ভীষণ কড়া ছিলেন; এর বাইরে, আগেই বলেছি, তিনি আমাদের নিয়মিতই নিয়ে যেতেন সিনেমা দেখাতে।
সেগুলোর বেশিরভাগই ছিল আমেরিকান ও ইউরোপিয়ান সিনেমা। কাগুরাজাকা পর্বতে উশিগোমেকার নামে একটা সিনেমাহল ছিল, যেখানে শুধু বিদেশি সিনেমাই দেখানো হতো। সেখানে প্রচুর পরিমাণ অ্যাকশন সিরিয়াল ও উইলিয়াম এস হার্টের সিনেমা দেখেছি আমি। সেই সিরিয়ালগুলোর মধ্যে আমার বিশেষ মনে আছে "দ্য টাইগার'স ফুটপ্রিন্টস", 'হারিকেন হাচ', 'দি আয়রন ক্ল' ও 'দ্য মিডনাইট ম্যান'-এর নাম।
উইলিয়াম এস হার্টের সিনেমাগুলোতে পরবর্তীকালে জন ফোর্ডের বানানো সিনেমাগুলোর মতোই একটি পুরুষালি স্পর্শ ছিল, এবং সেগুলোর বেশিরভাগেরই প্রেক্ষাপট ওয়াইল্ড ওয়েস্ট নয়, বরং আলাস্কা। আমার মনে উইলিয়াম এস হার্টের চেহারার একটি ইমেজ শোভিত হয়ে রয়েছে। তিনি দু'হাতেই পিস্তল ধরে আছেন, তার চামড়ার আর্মব্যান্ডটি স্বর্ণ-শোভিত, এবং ঘোড়ায় চড়া অবস্থায় তার মাথায় পরা একটি প্রশস্ত আকারের হ্যাট। কিংবা পশমের হ্যাট ও পশমের জামা-কাপড় পরে তুষারাচ্ছন্ন আলাস্কা বনাঞ্চল দিয়ে ছুটে যাচ্ছেন তিনি। এই ফিল্মগুলোর যা কিছু আমার আত্মায় জমা হয়ে রয়েছে, তা হলো—সেই বিশ্বাসযোগ্য পুরুষালি মেজাজ এবং পুরুষের ঘামের গন্ধ!
সেখানে চ্যাপলিনেরও কিছু সিনেমা হয়তো দেখে থাকব, কিন্তু যেহেতু আমার সেই বয়সে চ্যাপলিনের কোনো ভঙ্গিমাই মনে করতে পারি না, ফলে না দেখার সম্ভাবনাও রয়েছে। সিনেমা ঘিরে সে সময়কার কিংবা তার চেয়ে একটুখানি পরের সময়ের একটি অমোচনীয় স্মৃতি আমার মনে গেথে আছে। টোকিওর আসাকুসা অঞ্চলে, সাউথ পুলে অভিযানের ওপর নির্মিত একটি সিনেমা দেখাতে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন বড় আপু, তখনকার ঘটনা।
স্লেজ-ডগ বা কুকুরে-টানা-গাড়ির ক্যাপ্টেনটি পড়ে গিয়েছিল অসুখে, আর অভিযাত্রী দল তাকে ফেলে রেখেই, টিমের বাকিদের নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রধান কুকুরটি তাদের অনুসরণ করে, বিস্ময়করভাবে, নিজেকে মৃত্যুর কিনারে নিয়ে যায়; এবং লোকটিকে আবারও টিমের প্রধান হিসেবে অভিষিক্ত করে। এই প্রধান কুকুরটির কম্পমান পা দেখে, মনে খুব চোট পেয়েছিলাম আমি। পুঁজে ভরে গিয়েছিল তার চোখ; শ্বাস নিতে এতই কষ্ট হচ্ছিল যে, জিহ্বাটা মুখ থেকে বেরিয়ে, ঝুলে গিয়েছিল। মর্মস্পর্শী, লোমহর্ষক ও উদার এক মুখ ছিল সেটি। কান্নায় আমার চোখ এতই ভারি হয়ে গিয়েছিল, আমি আর দেখতে পাইনি।
সেই ঘোলাটে দৃশ্যটিতে, অভিযাত্রী দলের একজন এই কুকুরটিকে একটি খাড়ের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত সে হয়তো এই প্রাণীটিকে মেরে ফেলেছে; কেননা, আমরা রাইফেলের একটি গুলির শব্দ শুনতে পাই, আর বাকি কুকুরগুলোকে আতঙ্কে লাফালাফি করতে দেখি। আর আমি ভেঙে পড়ি কান্নায়। আপু আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। ফলে তিনি আশা ছেড়ে দিয়ে, আমাকে নিয়ে সিনেমা-হল থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু তাতেও কান্না থামেনি আমার। বাড়ি ফেরার পথে, গাড়িতে, পুরোটা রাস্তায় কেঁদেছি আমি; এমনকি বাড়িতে ঢুকেও কান্না থামাইনি। এমনকি আপু যখন হুমকি দিলেন, আর কখনো আমাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবেন না, তখনো থামিনি। এখনো কুকুরটির মুখ আমি ভুলতে পারিনি; যখনই ওর কথা ভাবি, শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে আমার।
জীবনের এ সময়টিতে, বিদেশি সিনেমার তুলনায় জাপানি সিনেমার প্রতি আমার তেমন মুগ্ধতা ছিল না। তবে আগ্রহের জায়গাটি তখনো ছিল শিশুর মতোই। বাবা শুধু আমাদের সিনেমা-হলেই নিয়ে যেতেন না। কাগুরাজাকার কাছাকাছি মিউজিক হলগুলোতেও নিয়ে যেতেন স্টোরিটেলার বা কাহিনী-কথকদের পরিবেশনা শোনাতে। কোসান, কোকাৎসু ও এনিউর কথা মনে আছে আমার। এনিউ ছিলেন সম্ভবত আমার শিশুতোষ মনের খোড়াক যোগানোর সবচেয়ে উপযুক্ত মানুষ। কোকাৎসুর ভূমিকাপর্ব আমার ভালো লাগত; তবে কোসান—যাকে কিনা স্টোরিটেলিং আর্টের একজন মাস্টার হিসেবে গণ্য করা হয়, তার পরিবেশনা সত্যিকারঅর্থেই আমি পছন্দ করতাম। তার দুটি রুটিনের কথা আমি ভুলতেই পারি না—'নাইটটাইম নুডলস' ও 'দ্য হর্স ইন মিসো সস'। কোসান মূকাভিনয় করে দেখাতেন নুডলস বিক্রেতার ভঙ্গিমা, এবং তার কণ্ঠ থেকে একটা অদ্ভুত ঘোঙানির শব্দ বেরিয়ে আসত; আর এখনো মনে পড়ে, এক মুহূর্তেই তুষারাচ্ছন্ন শীতের সন্ধ্যার মেজাজে ডুবে যেতাম আমি।
'হর্স ইন মিসো সস' কিচ্ছাটি কোসানের মতো আর কারো কণ্ঠে কখনোই শুনিনি। নাশতা কেনার জন্য রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে মালবাহী ঘোড়াটি থামাল চালক। মিসো সল্টেড-বিন পেস্ট পিঠে ভরা ঘোড়াটিকে বাইরে বেঁধে রেখে এগিয়ে গেল সে। কিন্তু যখন সে পানাহার করছিল, সেই সুযোগে বাঁধন খুলে হারিয়ে গেল ঘোড়াটি, আর সে সেটিকে এখানে-সেখানে খুঁজে বেরাল। সামনে যাকে পেল, তাকেই জিজ্ঞেস করল; তার কণ্ঠস্বর হয়ে উঠল কাঁদো-কাঁদো ও অধিকতর অসংলগ্ন। সবশেষে রাস্তায় দেখা মেলা এক মাতালের কাছে জানতে চাইল সে, 'মিসো বহনকারী আমার ঘোড়াটি দেখেছ নাকি?' মাতাল জবাব দিলো, 'কী বললে? দেখা তো দূরের কথা, ঘোড়া কখনো রান্না করতে পারে—এ কথা আমি জন্মেও শুনিনি!' তারপর মালবাহী ঘোড়াটির সেই চালক বৃক্ষশোভিত রাস্তা ধরে নিচে নামতে থাকল; তার এই অনুসন্ধানে তাকে সঙ্গ দিলো শুষ্ক বায়ু। এই কিচ্ছা শুনতে শুনতে আমি বাস্তবিকঅর্থেই নিজের বুকের ওপর শুষ্ক হাওয়ার স্পর্শ অনুভব করতাম; আমার ধারণা, অসাধারণ ছিল সেটি।
স্টোরিটেলিং-হলে এই মাস্টারদের মুখে শোনা এই কিচ্ছাগুলো আমার খুব প্রিয় ছিল; তবে তার চেয়েও বেশি প্রিয় ছিল বাড়ি ফেরার পথে বাকহুইট নুডলসের টেম্পুর খাওয়া। শীতের রাতে এই টেম্পুর-সোবা খাওয়ার স্বাদটি বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে আমার কাছে। এমনকি বছর কয়েক আগেও, আমি যখন বিদেশ থেকে দেশে ফিরছিলাম, প্লেনটি টোকিও এয়ারপোর্টের কাছাকাছি পৌঁছুতেই আমার মনে হচ্ছিল, 'আহ! টেম্পুর-সোবার স্বাদটা এবার নেওয়া যাবে!'
তবে টেম্পুর-সোবার স্বাদ এখন আর আগের মতো নেই। আমি আরোএকটা জিনিস খুব মিস করি। পুরোনো দিনের নুডলসের দোকানগুলো—যেখানে সদর দরজায় বিশেষ স্ফুলিঙ্গ রাখা হতো, তুষারকণা থেকে নিজেকে শুকিয়ে নেওয়ার জন্য; বারবার ব্যবহার করা যেত সেগুলো। আপনি যখনই পাশ দিয়ে যাবেন, সেই স্ফুলিঙ্গ আপনাকে একই ধরনের অনুভূতি দিতে থাকবে। এ বিষয়টি নিয়ে মারাত্মক নস্টালজিয়ায় ভুগি আমি। বলছি না, নুডলসের দোকানগুলোর সদর দরজায় এখন আর সে ধরনের স্ফুলিঙ্গের ব্যবস্থা রাখা হয় না; বরং বলছি, সেটির ঘ্রাণ এখনকারগুলোর তুলনায় ছিল একেবারেই আলাদা।
(চলছে)