কুরোসাওয়া কথা
ভয়ংকর এক অভিযান
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
এই প্রলয়কাণ্ড যখন প্রশমিত হয়ে এলো, ভাইয়া ব্যাকুল কণ্ঠে বললেন, ‘আকিরা, চলো ধ্বংসাবশেষ দেখতে যাই।’ স্কুলের পিকনিকের মতো এক ধরনের স্ফূর্তিবাজ মনোভাব নিয়ে, ভাইয়ার সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম আমি। যতক্ষণে বুঝে উঠতে পারলাম, এই ভ্রমণ কতটা ভয়ানক হবে, এবং তা আমাকে কতটা নাড়া দেবে—ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমার অস্বস্তিকে পাত্তা না দিয়ে, ভাইয়া আমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে গেলেন। অগ্নিকাণ্ডে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া বিস্তৃত এক এলাকায় সারাটা দিন তার সঙ্গে কাটাতে হলো আমাকে এবং আতঙ্কে আমি যখন কেঁপে-কেঁপে উঠছিলাম, তখন তিনি আমাকে দেখালেন থরেথরে পড়ে থাকা অগুনতি লাশ।
প্রথমে আমাদের চোখে কেবল খানিকটা পুড়ে যাওয়া একটি মৃতদেহ ভেসে উঠল, কিন্তু যতই কাছে যেতে থাকলাম সেই শহরতলি অঞ্চলটির, হাজারও মৃতদেহের পেলাম দেখা। কিন্তু ভাইয়া আমাকে হাত ধরে, এগিয়ে নিতে থাকলেন লক্ষ্যবস্তুর দিকে। পুড়ে যাওয়া ল্যান্ডস্কেপটি আমাদের চোখের সামনে এক ধরনের বাদামি লালরং নিয়ে ধরা দিল।
এই অগ্নিদাহে কাঠের তৈরি সবকিছুই পরিণত হয়েছিল ছাই-ভস্মে; এখন সেগুলো মৃদু-বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে কেবল। দেখে মনে হলো, এ যেন কোনো লাল মরুভূমি।
গা গুলিয়ে আসা এই বিস্তৃত লালরঙের ভেতর, সম্ভবপর সব ধরনের মৃতদেহই মিলেমিশে আছে। পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া লাশ, অর্ধদগ্ধ লাশ, নর্দমায় পড়ে থাকা লাশ, নদীতে ভেসে যাওয়া লাশ, ব্রিজের ওপর স্তূপ হয়ে থাকা লাশ, পুরো রাস্তার একটা সংযোগস্থলের পথরোধ করে দেওয়া লাশ এবং মানুষের পক্ষে যতভাবে মরা সম্ভব—তত রকমেরই ভঙ্গিমার অগুনতি লাশের দেখা পেলাম আমি। যখন আনমনে চোখ ফিরিয়ে নিতে গেলাম, ভাইয়া আমাকে তাড়া দিয়ে বললেন, ‘আকিরা, খুব খেয়াল করে দেখো এখন।’
ভাইয়ার উদ্দেশ্য কী—বুঝতে পারলাম না; এসব বীভৎস দৃশ্য দেখতে তিনি যে আমাকে বাধ্য করছেন—এ ব্যাপারটি তার ওপর আমাকে কেবলই ক্ষেপিয়ে তুলছিল। সবচেয়ে বাজে ব্যাপার ছিল, লাল-স্রোতের সুমিদাগাওয়া নদীটির তীরে আমাদের দাঁড়িয়ে থেকে, স্রোতে ভেসে যাওয়া লাশের স্তূপগুলো দেখতে থাকা। যখন মনে হলো, পা কাঁপছে আমার, মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাব এক্ষুনি; ঠিক তক্ষুনি ভাইয়া আমার কলারে দিয়ে আমাকে ধরে ফেললেন এবং আবারও নিজের পায়ে দাঁড় করিয়ে দিলেন আমাকে। আর আরো একবার বললেন, ‘খুব খেয়াল করে দেখো, আকিরা।’
দেখতে দেখতে, দাঁতে দাঁত লেগে যাচ্ছিল আমার। চোখ বন্ধ করে রাখার চেষ্টাও করেছি; কিন্তু এই দৃশ্যগুলো আমার চোখ পেরিয়ে, মগজে গেঁথে গিয়েছিল একেবারে। এ থেকে কোনো রেহাই নেই—এমন সান্ত্বনা নিজেকে দিতে দিতে, খানিকটা স্বস্তিবোধ করলাম। কিন্তু সেখানে যে নারকীয় ছবি আমি দেখেছি, সেটি বাক্যে লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। যতদূর মনে পড়ে, রক্তের যে স্রোত আমি দেখেছিলাম, আমার ধারণা, বুদ্ধধর্মমতে নরকের যে বর্ণনা—তাও বোধ করি এতটা ভয়ংকর নয়।
সুমিদাগাওয়া নদীটি লালরঙা হয়ে গিয়েছিল—এ কথা একটু আগেই লিখেছি; কিন্তু তার রং রক্ত-লাল ছিল না; বরং তা ছিল সেই ল্যান্ডস্কেপটির বাকি অংশের মতোই উজ্জ্বল বাদামি-লাল; মরা মাছের চোখের মতো সাদার সঙ্গে লালের একটা ঘোলাটে মিশ্রণ। নদীতে ভাসমান লাশগুলো হয়ে গিয়েছিল ফুলে ঢোল আর তাদের পায়ুপথগুলো ছিল বড় মাছের মুখের মতো খুলে হাঁ হয়ে। এমনকি যে শিশুগুলো ছিল নিজেদের মায়ের পিঠে বাঁধা, তাদের অবস্থাও ছিল একই রকম। আর লাশ সব সেই নদীটির স্রোতে মৃদু এক ছন্দময়তায় যাচ্ছিল ভেসে।
যতদূর চোখ যায়, কোনো জীবিত আত্মার অস্তিত্ব সেখানে দেখতে পাইনি। সেই ল্যান্ডস্কেপে জীবিত বলতে একমাত্র ছিলাম আমি ও আমার ভাইয়া। আমাদের দুজনকে আমার কাছে লাগছিল যেন এই অসীম প্রান্তরের ভেতর দুটি মটরদানার মতোই পুঁচকে। কিংবা আমরা দুজনেই যেন মৃত এবং দাঁড়িয়ে রয়েছি নরকের দরজার সামনে।
ভাইয়া এরপর আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন গার্মেন্টস অঞ্চলের ব্রড মার্কেট গ্রাউন্ডে। মহাপ্রলয়ংকরী কান্তো ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছিল এখানেই। এই ল্যান্ডস্কেপটির কোনো প্রান্তই ছিল না লাশবিহীন। কোনো কোনো জায়গায় লাশের ওপর লাশ জমে ছোট ছোট পাহাড়ের মতো হয়ে গিয়েছিল। এ রকম এক পাহাড়ের চূড়োয় পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া একটি মৃতদেহ বসে ছিল জেন মেডিটেশনের লোটাস পজিশনে। সেই লাশটিকে দেখতে একদম বুদ্ধের ভাস্কর্যের মতো লাগছিল। আমি আর ভাইয়া সেই লাশটির দিকে, একেবারেই পাথরের মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ। তারপর ভাইয়া, যেন স্বগতোক্তির মতো, নরমস্বরে বললেন, ‘চমৎকার, তাই না?’ তেমনটাই মনে হয়েছিল আমারও।
সে সময়ে আমি এত বেশি লাশ দেখেছি যে মাটিতে পড়ে থাকা লাশ আর পুড়ে যাওয়া ছাদের টাইলসের টুকরো ও পাথরের মধ্যে কোনো পার্থক্য তৈরি করতে পারিনি। এ ছিল অরুচির এক উদ্ভট অনুভূতি। ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আমার মনে হয়, এখন আমাদের বাড়ি ফেরাই ভালো।’ আমরা আবারও সুমিদাগাওয়া নদী পেরিয়ে, উয়েনো হিরোকোজি অঞ্চলের দিকে এগিয়ে গেলাম।
হিরোকোজি স্ট্রিটের কাছে পৌঁছাতেই আমরা পুড়ে যাওয়া এমন এক বিশাল এলাকায় দেখা পেলাম—যেখানে অসংখ্য মানুষ ছিল জড়ো হয়ে। পুরো এলাকার ধ্বংসস্তূপের ভেতর অবিশ্রান্তভাবে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছিল তারা। ভাইয়া তির্যক হেসে বললেন, ‘স্বর্ণ-ভাণ্ডারের এটুকু অংশই টিকে আছে। আকিরা, স্মারক হিসেবে আমরা একটা স্বর্ণের আংটির খোঁজ করব নাকি?’
কিন্তু সেই মুহূর্তটিতে আমার চোখ একদৃষ্টিতে নিবদ্ধ ছিল উয়েনো পর্বতের সবুজ চূড়ায়। আমি স্থির হয়ে গিয়েছিলাম। কতশত বছর পর কোনো সবুজ গাছের দেখা পেলাম আমি? এমনটাই মনে হলো আমার, যেন অগুনতি দিন পেরিয়ে অবশেষে নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো একটা জায়গা পাওয়া গেল। গভীর বড় করে একটা দম নিলাম আমি। আগুনের এই ধ্বংসযজ্ঞে সবুজের কোনো চিহ্নই তো খুঁজে পাইনি এতক্ষণ। সবুজ বৃক্ষের জন্য তাড়না এর আগে কখনোই এতটা অনুভব করিনি।
সেই ভয়ংকর ভ্রমণের শেষে রাতের বেলা আমরা যখন বাড়ি ফিরলাম, আমি পুরোপুরিই প্রস্তুত ছিলাম—হয় রাতে ঘুমোতে পারব না, কিংবা ভয়ংকর সব দুঃস্বপ্ন দেখতে থাকব।
কিন্তু বালিশে মাথা রাখার পরপর, কখন যে সকাল হয়ে গেল টেরই পেলাম না। বেহুঁশের মতো ঘুমিয়েছি আমি এবং কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছি কি না—মনে পড়ল না। ব্যাপারটা আমার কাছে এতই আজব লাগল যে ভাইয়ার কাছে ব্যাখ্যা জানতে চাইলাম। ‘তুমি যদি আতঙ্ক-জাগানিয়া কোনো কিছু দেখে চোখ বন্ধ করো, তাহলে ঘুমের মধ্যেও আতঙ্কে ভুগবে। যদি তুমি সবকিছু সোজা চোখে দেখো, তাহলে তাতে ভয় পাওয়ার কিছুই নেই।’ সেই ভ্রমণটির দিকে ফিরে তাকালে এখন আমি ঠিকই টের পাই, সেটি নিশ্চয়ই আমার ভাইয়ার কাছেও ভয়ংকরই ছিল। ভয়ের মোকাবিলা করার দুর্দান্ত এক অভিযান ছিল সেটি।
(চলবে)