আমাদের ছফা ভাই
বাড়ির আলমারিতে রাখা বই। উপন্যাসের ভাগে রাখা। বইয়ের নাম—‘সূর্য তুমি সাথী’ আর প্রবন্ধের বই ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। আহমদ ছফার লেখা বই। প্রকাশক সম্ভবত মুক্তধারা। বই দুটো দেখতে দেখতে আহমদ ছফার নামটা মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল কলেজের শুরুতেই। কিন্তু কোনোদিন তাঁকে দেখব, এমন আশা ছিল না।
কবি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহার সঙ্গে কোনোকালে দেখা হবে কখনোই ভাবিনি। গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু কলেজে পড়াকালীন পরিচয় হলো বন্ধু কবি মারজুক রাসেলের সঙ্গে। রাসেল সৎ ও সাহসী। যেকোনো পরিস্থিতিতে দাঁড়াতে পারে। শ্রেণিহীন দুস্তর মানুষ ছিল রাসেল। ঢাকা থেকে গিয়ে বলত সব লেখকের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। শামসুর রাহমানের বাসায় ভাত খেয়েছে, আহমদ ছফার সঙ্গে সিগারেট। ওর কথা শুনে বিস্মিত হতাম। রাসেল গল্প মারার লোক না। তারপরও হোঁচট খেতাম। অনুরোধ করতাম ঢাকায় গেলে যেন আমাদের সঙ্গে সব মহান মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেয়।
ঢাকায় এসে আরেক বাস্তবতায় পড়লাম, কিচ্ছু চিনি না। কাউকে জানি না। শুধু উদীচী আর প্রেসক্লাব চিনি, চিনি ২১/১ পুরানা পল্টন কমিউনিস্ট পার্টির অফিস। রাসেলের সঙ্গে মাঝেমধ্যে কথা হয় টিএসসি এলাকায়। এভাবে দু-একজন বন্ধুর সংখ্যা বাড়ে। আজিজ সুপারমার্কেটে যাই কবিতার আলাপ শুনি। শুক্রবারের সাময়িকী দেখি। আর হতাশ হই। কোনো পত্রিকা অফিসে আমার পরিচিত কেউ নেই। কার কাছে লেখা পাঠাবো জানি না। প্রাচ্যবিদ্যা প্রকাশনীতে যেতে যেতে পরিচয় হয় অমিত হোসেনের সঙ্গে। প্রমিত হোসেন তাঁর বড় ভাই। একদিন বললেন, তুমি সবখানে সাহিত্য সম্পাদকের নামে লেখা পাঠাও। আর দোতলায় মেজবাহ কামাল স্যারের ‘সমাজ চেতনা’ ও আহমদ ছফার ‘উত্থান পর্ব’ আছে, ওখানে লেখা দাও। ‘সমাজ চেতনা’য় গিয়ে লেখা দিলেই ছাপা হতো। কিন্তু ‘উত্থান পর্বে’ এত মানুষজন থাকত যে ঢুকতে সাহস হতো না। ওই দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে দেখতাম আমার মতো দু-একজন তরুণের সঙ্গে আহমদ ছফা সাবলীলভাবে কথা বলছেন। চেয়ারের চেয়ে অনেক উঁচু মানুষটার তাকানো দেখে ভয় পেতাম। কোনো ঝামেলায় পড়ি এ জন্যই এড়িয়ে যেতাম।
একদিন সাহস করে ঢুকেই পড়লাম। ছফা ভাইয়ের সে কী বিনয়! সে কথা এখনো ভাবলে মনে হয়, মানুষের প্রতি যে দায় তিনি অনুভব করতেন, সে তুলনা আর কারো সঙ্গে হয় না। আমার মতো সদ্য মফস্বল থেকে আসা এক তরুণের ভালো লাগায় গলে যাওয়ার কথা। এমন একটা বটবৃক্ষের জন্যই তো প্রার্থনা করছিলাম। শুরুতেই তিনি আমাকে প্রশ্ন করলেন, আপনার জন্য আমি কী করতে পারি? আমি বললাম, লেখা দিতে এসেছি। তিনি বললেন, লেখা দিয়ে যান। টাকার অভাবে ওটা বের হতে একটু দেরি হবে। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আর কোন কাগজে লেখেন? বললাম, কাউকে চিনি না তো, ঠিকানাও জানি না। তিনি বললেন, আপনার লেখা আমার কাছে দিন, আমি খামে করে পাঠিয়ে দেবো। লেখা ছাপার জন্য চিন্তা করতে হবে না। আপনি আমার এখানে আসবেন। জিজ্ঞেস করলাম, কবে? তিনি বললেন প্রতিদিন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছেন? বললাম, মধুর ক্যান্টিন। আবার বিনয়ের সঙ্গে তাঁর জিজ্ঞাসা, দুপুরে খেয়েছেন? বললাম, না। তিনি বললেন, দরজা আটকে দেন। দিলাম। টিফিন ক্যারিয়ারে বাসা থেকে ভাত এসেছে। আমার সঙ্গে খেতে আপত্তি না থাকলে বসেন। খর চৈত্রের দুপুর। পিচ গলা গরম। ফ্যানের বাতাসকে রসিকতা মনে হয়। তার মধ্যে খাওয়ার আমন্ত্রণ অগ্রাহ্য করার শক্তি ছিল না।
ভাত খেয়ে চা খেলাম। তাঁর হাতে সিগারেট জ্বলছেই। অবাক হলাম তাঁর ম্যাচের দরকার হয় না। একটার আগুনে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে টানুন না টানুন হাতে থাকতেই হবে। অনেকক্ষণ বাড়ির গল্প শুনে তিনি মনে হচ্ছিল আমার সম্বন্ধে একটি ধারণাচিত্র নির্মাণ করছেন। আমি একের পর এক উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাম। ছফা ভাই তা গোগ্রাসে গিলছিলেন। সব শেষে জিজ্ঞেস করলেন, আমার কোনো লেখা পড়েছেন? বললাম, হ্যাঁ। বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, তাই? কী বই? বললাম, আমাদের বাড়িতে দুটো বই আছে, ‘সূর্য তুমি সাথী’ উপন্যাস আর প্রবন্ধের বই ‘জাগ্রত বাংলাদেশ’। তবে হালে ‘অলাতচক্র’ পড়েছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত লেখক দানিয়েল ও ক্যানসারে আক্রান্ত তাইয়্যেবার মধ্যকার অস্ফুট ভালোবাসা, মানসিক টানাপড়েন, যুদ্ধ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে লেখা একটি উপন্যাস। মুক্তিযুদ্ধের এ উপন্যাসে দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা অন্যান্য উপন্যাসে এসেছে বলে আমার জানা নেই।
‘পুষ্প বৃক্ষ বিহঙ্গ পুরাণ’ পড়ে খুব ভালো লেগেছে। বিশেষত উপন্যাসের দুটো জায়গা আমার মাথায় গেথে আছে। বইটির ভাষাচিত্র নির্মাণশৈলী আমাকে খুব টেনেছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কোন দুটি? আমি মুখস্থ বলে ফেললাম, ‘এই প্রাচীন বৃক্ষটির সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আকাশের কাছাকাছি তার অবস্থান, ডালে শঙ্খচিলের বাসা, আষাঢ় মাসের পাকনা আম সবকিছু একযোগে আমার হদয় হরণ করে নিয়েছিল। এই বৃক্ষের সংসারের প্রতি বিস্ময়মিশ্রিত নয়নে তাকাতাম। যতই তাকাতাম অনুভব করতাম, এই বৃক্ষের বিহঙ্গকুলের সংসারে আমিও একটা স্থান করে নিতে পেরেছি এবং বৃক্ষটিও সেটা বুঝতে পারে। দাদু-নাতির সম্পর্কের মধ্যে যে একটি প্রচ্ছন্ন প্রপ্রয় এবং স্নেহের স্থান আছে আমার সঙ্গে বৃক্ষের সেরকম একটি সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেছে। আমি ভাবতে থাকতাম বিরাট সংসারসহ এই বিশাল বৃক্ষটি একান্ত আমার। তার শাখায় যে আমগুলো দোলে সেগুলো সব আমার। যেসব পাখি আসে, যেসব পাখি বাস করে সব আমার।’
একই উপন্যাসে তিনি লিখেছেন, ‘মাটির মানুষের জগতে হিংস্রতা এবং হানাহানি দেখে আকাশের পাখির জগতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানেও হিংস্রতা এবং জাতি বৈরিতার প্রকোপ দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং, মানুষের কর্তব্য পালন করার জন্য আমার মানুষের কাছে ফিরে না গিয়ে উপায় কী? আমি বৃক্ষ নই, পাখি নই, মানুষ। ভালো হোক, মন্দ হোক, আনন্দের হোক, বেদনার হোক আমাকে মানুষের মতো মানুষের সমাজে মনুষ্যজীবনই যাপন করতে হবে। মনুষ্যলীলার করুণ রঙ্গভূমিতে আমাকে নেমে আসতে হবে।’
আমি বলতে বলতে দেখলাম, ছফা ভাই কাঁদছেন। খুব অপ্রস্তুত হলাম। ছফা ভাই আমাকে ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ ও ‘ফাউস্ট’ বই তিনটা আমাকে দিয়ে দিলেন। আসার সময় বললেন, আপনি নিয়মিত আসবেন। ছফা ভাইয়ের বই নিয়ে নামলাম। তারপর আরেক ইতিহাস। সে ইতিহাসের ধাক্কায় ছফা ভাইয়ের কাছে না যাওয়ার যুক্তি এলো। যেখানেই যাই বই দেখলেই বলে, এ লোকের কাছে তুমি যাবে কী করে? সে তো প্যান ইসলামী ধারার লোক। একসময় জার্মানের টাকায় চলত, এখন বোধ হয় পাকিস্তানি লাইনেও আছে। বেশ কয়েক দিন এমন বিভ্রান্তির মধ্যে রইলাম। ইতিমধ্যে আজকের কাগজে চাকরি হলো। কাজ সম্পাদকীয় বিভাগে। লেখকদের সঙ্গে যোগাযোগ, লেখা আদায়, সম্পাদকীয় লেখা মূল কাজ। আজকের কাগজের থেকে আমার দায়িত্ব ছিল ছফা ভাইয়ের লেখা আদায় করা। ছফা ভাইয়ের লেখা আমি লিখে আনতাম। আমি তখন ছফাময়। ছফা ভাইয়ের বই, টাকা সব আমার। ছফা ভাইয়ের লেখা আনা মানে দিন শেষ। গল্প খাওয়া সবই তো মুডের ব্যাপার। আমারও ভালোই লাগত। কিন্তু সমস্যা হলো একদিন।
আজকের কাগজের সম্পাদক কাজী শাহেদ আহমেদকে আমরা খুব সমীহ করতাম। তিনি আমাকে ডেকে বললেন, তোমাকে আর আহমদ ছফার লেখা আনতে যেতে হবে না। আমি ভয় পেয়ে গেলাম, তাহলে চাকরিটাই বুঝি গেল। আহমদ ছফার ঘরে যেতেও ভয় হচ্ছিল। ছফা ভাই আমাকে দূর থেকে ডাকলেন। ডেকে বললেন, তোমাকে আমার লেখা অনুলিখন করার জন্য পাঠাতে নিষেধ করেছি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন? তিনি হেসে বললেন, কারো ডিক্টেশন নিলে লেখায় তার প্রভাব থাকে। এতে লেখকের ক্ষতি হয়। তোমার মতো একজন সম্ভাবনাময় লেখককে আমি একজন লেখক হয়ে ধ্বংস হতে দিতে পারি না। ছফা ভাইকে বললাম, কিন্তু লিখলে আপনি তো একশ টাকা দিতেন, তা তো আর পাব না। ছফা ভাই বললেন, তোমার টাকাতেই তো বাঁচি। ওখান থেকে রেখে দিও। মানে লেখার বিল থেকে। ছফা ভাইয়ের কত স্মৃতি যে, আমার সঙ্গে তা বলে শেষ করা যাবে না।
আরেক দিন ছফা ভাই আমাকে দেখে উত্তেজিত হয়ে বললেন, আজ আমি খুন করব। বললাম, কাকে? তিনি প্রয়াত এক লেখকের নাম বললেন। আমি বললাম, আপনি ওপরে চলেন। আমি তাকে পিতা সম্মানে শাসন করতাম। তাই জোড়াজুড়ি করলেও তিনি অনড়। তিনি খুন করবেন। পরে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী দিয়ে করবেন? বললেন, ছুরি দিয়ে। বললাম, ছুরি কোথায়? তিনি বললেন, আমার ব্যাগে। বললাম, দেখি। খুঁজে ছুরি পাওয়া গেল না। পরে ছুরি আনতে আজিজের দোতলায়। ততক্ষণে রাগ জল।
ছফা ভাইয়ের পাগলামির অন্ত ছিল না। একদিন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক নির্মল সেন ও সন্তোষ গুপ্ত দুজনে ফোন করে বললেন দেখা করতে। প্রথমে নির্মল সেনের অফিসে গেলাম। তিনি বললেন, আগামীকাল ভোরে বাসায় আসিস, একটু কমিউনিটি হাসপাতালে যাব। জিজ্ঞেস করলাম, কেন? বলল, বাসায় এসে ছফা হুমকি দিয়ে গেছে, তাকে দেখতে না গেলে সে খুন করবে। তারই দুদিন আগে তাকে ভর্তি করে এলেও তিনি সিটে থাকেন না বুঝলাম। সন্তোষ গুপ্তর বাসায় রাতে খেতে খেতে একই কথা শুনলাম। তো আগে নির্মল সেনকে নিয়ে যাব, সেটাই ঠিক হলো। ভোরে নয়াপল্টন থেকে আমরা রওনা হলাম। হাসপাতালের ভেতরে ঢুকতেই রিকশা থামাতে বললাম। নির্মল সেন, বললেন আরেকটু সামনে যাই। আমি বললাম আপনার রোগীকে দেখবেন না? তিনি অবাক বিস্ময়ে বললেন, তা গেটে কেন? দারোয়ানের সাজে রোগী ছফা ভাই। রিকশা, গাড়ি ঢুকলেই স্যালুট দিচ্ছেন।
নির্মল সেন জিজ্ঞেস করলেন, একি ছফা? বেড ছেড়ে এখানে কেন? ছফা ভাই বললেন, সকালের বাতাস স্বাস্থ্যের জন্য ভালো। দারোয়ানকে তাই ছুটি দিয়েছি। এই ছফা ভাইকে শ্রাবণের এক অঝোর রাতে আমরা সমাহিত করে এসেছি। শহর ছফাশূন্য হয়ে বেড়ে উঠছে। আমরা আশ্রয়হীন। ছফা ভাইয়ের মতো মানুষকে যাঁরা জেনেছেন, তাঁরা সবাই তাঁর অভাব বোধ করেন। এটাও একধরনের বেঁচে থাকা।