গল্প পড়ার গল্প
জনজীবনের লেখক মহাশ্বেতা দেবী
কত আশ্চর্য সব গল্প লিখেছেন মহাশ্বেতা দেবী। কত মানুষ, কত রকম মানুষ তাঁর গল্পের বিষয়। আমি তাঁকে দেখেছি ১৯৭৭-এর অক্টোবর কিংবা নভেম্বর থেকে। তিনি ডেকে পাঠিয়েছিলেন অমৃত পত্রিকায় আমার একটি গল্প পড়ে। হ্যাঁ, এমন কতজনের খোঁজ করেছেন তিনি গল্প পড়ে, উপন্যাস পড়ে। তখন মহাশ্বেতাদিকে পড়ে আমরা উদ্দীপ্ত হয়েছি বারবার। সেই ৭২-এ প্রসাদ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘হাজার চুরাশির মা’ তারপর ১৯৭৬-৭৭ নাগাদ কৃত্তিবাস পত্রিকায় ‘অপারেশন বসাই টুডু’, অমৃত পত্রিকায় ‘জগমোহনের মৃত্যু ও তারপর’, মহাশ্বেতাদিকে আমরা পড়েই চলেছিলাম। বহুদিনের এক অচলায়তনে যেন ঘা মেরেছিলেন তিনি, জনজীবনের লেখক হয়ে ওঠে।
মহাশ্বেতাদি তাঁর রাজনৈতিক গল্প ও উপন্যাসের জন্য বহুপাঠকের কাছে অতিদ্রুত পৌঁছে গিয়েছিলেন। দ্রৌপদী, বিছন, জল, রুদালি, বেহুলা, শিশু, স্তনদায়িনী, ভাত, কত গল্প। কোনো গল্পই ভুলবার নয়। ক্ষুধার্ত আর বিপন্ন মানুষের জীবন বৃত্তান্ত তিনি লিখেই চলেছিলেন। ‘দ্রৌপদী’ গল্পটি বহু পঠিত। দ্রৌপদী মেঝেন জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকা কজন বিপ্লবীর জন্য ভাত নিয়ে যাচ্ছিল। মাঝপথে অস্ত্রধারী রিজার্ভ পুলিশ তাকে ধরে ফেলে। তারা ক্যাম্প করে বসেছিল জঙ্গলে অপারেশন চালাবে বলে। দ্রৌপদীকে তারা ধরে নিয়ে আসে ক্যাম্পে। এবং সমস্ত রাত ধরে তাকে ধর্ষণ করে। আদিবাসী মেয়ে, তার ওপর সন্দেহজনক গতিবিধি, তাকে ধরা হবে, এবং রাষ্ট্ররক্ষীরা তাকে ধর্ষণও করবে। গণধর্ষণ। রাতভর দ্রৌপদী রক্তাক্ত হতে থাকে। একের পর এক রক্ষীরা তার দেহের ভিতরে পিষ্টন প্রবেশ করিয়েই যায়। মহাশ্বেতা এইভাবে বর্ণনা করেছিলেন অনেকটা।
দ্রৌপদী নগ্ন অবস্থায় পড়ে থাকে। তার যৌনাঙ্গ, ঊরুতে রক্তের দাগ শুকিয়ে যায় সমস্ত রাত ধরে। পরদিন আসে সেই রক্ষী বাহিনীর মাথা লোকটি। তিনি কমান্ডার। একটি মেয়ে জঙ্গলে ধরা পড়েছে, তাকে জেরা করে তিনি সব সুলুকের সন্ধান নেবেন। রক্তাক্ত নগ্ন দ্রৌপদীকে রক্ষীদের একজন নিতে আসে। বলে কাপড় পরে বড় সায়েবের কাছে যেতে। দ্রৌপদী কাপড় পরে না। বসে থাকে। রক্ষী যখন বলে সে তাকে কাপড় পরিয়ে দিয়ে নিয়ে যাবে, দ্রৌপদী তাকে প্রত্যাখ্যান করে, বলে, তারা কাপড় খুলতে জানে, পরাতে না। দ্রৌপদী মেঝেন ওঠে। বড় সায়েবের কাছে যাবে। রক্ষীদের কিছু করার থাকে না, তারা দ্যাখে ধর্ষিতা রক্তাক্ত দ্রৌপদী মেঝেন নগ্ন দেহ নিয়ে তাঁবু থেকে বেরিয়ে বড় সায়েবের দিকে এগোতে থাকে। তাকে দেখে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে থাকে সেই কমান্ডার লোকটি। নগ্নতা দিয়েই দ্রৌপদী তার ওপর রাতভর অত্যাচারের শোধ নেয়। গল্পটি ১৯৭৭-৭৮ নাগাদ বেরিয়েছিল, এর বহু বছর বাদে মনিপুরে ধর্ষিতা কন্যাদের মায়েরা নগ্ন হয়ে এক অভিযান করেছিল বিশেষ নিরাপত্তা আইন তুলে দেওয়ার দাবিতে। সেই খবর পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে গিয়েছিল দ্রৌপদী মেঝেনের গল্প। মহাশ্বেতাদির গল্পে আদিবাসী, নিম্নবর্গের মানুষ রক্তমাংস নিয়ে উঠে আসে। নিম্নবর্গের মানুষের অধিকার নিয়ে তিনি সমস্ত জীবন যেমন ব্যয় করেছেন, তাঁর গল্পেও এসেছে তারা তাদের হারানো অধিকারের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে যেন।
এই আমাদের ভারত দেশটি, মহাশ্বেতাদির গল্পে তা আমরা বারবার টের পেয়েছি। ‘শিশু’ গল্পে অপুষ্টিতে মানুষগুলো বাড়তেই পারেনি। কোনো পাহাড়ের গুহায় আত্মগোপন করে থাকে পুলিশের ভয়ে। তারা একবার চাল লুট করেছিল। মহাশ্বেতাদির ‘বেহুলা’ গল্পে ইটের পাঁজায় সাপের চাষ করা হয়। কী বিচিত্র জীবন আর মানুষের কথা তাঁর গল্পে আছে। আমি ‘ভাত’ গল্পের উৎসব নাইয়ার কথা বলি। ঝড় আর নদীর রোষে তার ঘর ভেঙেছে, বউ ছেলে মেয়ে ভেসে গেছে নদীর টানে। উচ্ছব তার পর থেকে বউ বাচ্চার খোঁজ করে করে সরকারের দেওয়া খিচুড়ি ভুলে ছিল। তারপর খিদের টানে, কাজকম্মের আশায় কলকাতার এক বনেদি বাড়িতে কাজে লাগে। সেই বাড়ির বুড়ো কত্তা মরছে ৮২ বছরে। তাদের আবাদে জমি। কলকাতায় শিবমন্দির। আঠেরখানা ভাড়াটে দেবত্র বাড়ি। তারা বসে খায়। আবাদ থেকে কত রকমের চাল আসে তাদের বাড়িতে। ঝিঙেশাল, রামশাল, কনকপানি, পদ্মজালি...। আর কাজের লোকের জন্য মোটা চাল।
ঝিঙেশাল চালে নিরিমিষ রান্না খেয়ে সুখ, রামশাল চালের ভাতে আমিষ, কনকপানি চালের ভাত খান বড় কত্তা, পদ্মজালি চালের ভাত খায় এবাড়ির বড় আর ছোট বউ। এমনি তাদের সংসারে ভাতের আয়োজন। উচ্ছব তিন দিন ভাত খায়নি। বলে কয়ে তাকে এখানে কাজে লাগিয়েছে বাসিনী। ডাক্তার জবাব দিয়েছে, শিয়রে মরণ, তবুও তান্ত্রিক এনে হোম-যজ্ঞি করে বড়কত্তাকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। এদিকে বড়কত্তার বউ বিধবা হবে সেই কারণে কত রকম মাছ রান্না নিয়ে হেঁসেলে ঢুকে আছে মেজ বউ। বড় ইলিশ, ডিম ভরা ট্যাংরা, পাকা পোনার পেটি, চিতলের কোল, ভেটকি, শেষ মাছ খাওয়া খাইয়ে দেবে। উচ্ছব ভাবে, সেও তো আবাদের মানুষ, আবাদে অন্ন নেই বলে সে কলকাতায় এসেছে, আবাদে কোথায় এত রকম ধান?
ভয়ানক এক ক্ষুধার গল্প লিখেছেন মহাশ্বেতাদি। লোকটাকে খেতে না দিয়ে কাজ করাচ্ছে ও বাড়ি। তান্ত্রিক নিদেন দিয়েছে, যজ্ঞি না শেষ হলে কেউ অন্ন গ্রহণ করতে পারবে না । বাসিনী তাকে একটু ছাতু দিয়ে যায় লুকিয়ে, সে বাইরে গিয়ে জলে গুলে খেয়ে আবার কাজে লাগে। দক্ষিণের ঝড়ে তার সব গেছে। এখন শুধু ভাত ছাড়া সে কিছুই চায় না। কত দিন সেদ্ধ ভাত খায়নি। হোমের কাঠ কেটে দিয়ে উচ্ছব আর করবে কী? যজ্ঞি চলছে, ভাত হবে না এখন। ক্লান্ত উচ্ছব শিবমন্দিরের চাতালে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তার ঘুম ভাঙে যখন, প্রায় সন্ধে। সমস্ত বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল। বড় কত্তা মরেছে। মরেছে যজ্ঞের ভিতরেই। তাই পাঁচ রকম চালের পাঁচ রকম ভাত, মাছ সব ফেলে দিতে হবে। অশূচি হয়ে গেছে সব। বড় কত্তা শেষ যাত্রায় হরিনাম শুনতে শুনতে চললেন শ্মশান ঘাটে। বাসিনী এক ডেগ ভাত নিয়ে এসে উচ্ছবকে বলে, যা ফেলে দিয়ে আয়। ফেলে দিয়ে আসবে এত ভাত, পথে ঢেলে দিতে হবে? কাক কুকুরে খাবে? বাসিনী তাকে বলে, অশুচ বাড়ি ভাত খেতেনি দাদা। সে বাদার হিংস্র কামটের মতো তাকায়। ডেগ নিয়ে উচ্ছব স্টেশনে চলে যায়। দুহাতে ভাতে খাবল মারে। নিজে খায়, আর বলতে থাকে, চন্নুনির মা খাও, ছোট খোকা খা...। তার মরে যাওয়া বউ ছেলে মেয়েকেও সে ভাত খাওয়ায়। ভাত জল পেট পুরে খেয়ে ডেগটি জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। পরের দিন সেই পেতলের ডেগ চুরির দায়ে উচ্ছব ধরা পড়ে। মারতে মারতে তাকে থানায় নিয়ে যায়। গল্পটি এই।
মহাশ্বেতাদি তাঁর গল্পে আমাদের লৌকিক আচার, আমাদের নানা সংস্কার এমন পরিহাসের ভঙ্গিতে বলেন, যার অভিঘাত গল্পে প্রবল হয়ে ওঠে। ছোটগল্প নিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন।