মহাশ্বেতা দেবী ও তাঁর ‘অরণ্যের অধিকার’
বাঙালি কথাসাহিত্যিক, আদিবাসী ও মানবাধিকারকর্মী মহাশ্বেতা দেবীর প্রয়াণ দিবস গেল গত ২৮ জুলাই। গত বছর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। সামাজিক আন্দোলনে তিনি যেমন সক্রিয় ছিলেন, তেমনি লেখনীর মাধ্যমেও তিনি সোচ্চার থেকেছেন সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে।
মহাশ্বেতা দেবীর জন্ম ঢাকায় ১৯২৬ সালের ১৪ জানুয়ারি, বিখ্যাত এক সাহিত্যিক পরিবারে। তাঁর পিতা মণীষ ঘটক ছিলেন ‘কল্লোল’ সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি অধিকাংশ লেখা লিখতেন ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মানামে। মহাশ্বেতা দেবীর কাকা ছিলেন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটক এবং মা ধরিত্রী দেবী ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও সমাজকর্মী। মহাশ্বেতা দেবীর বিদ্যালয় শিক্ষা শুরু হয়েছিল ঢাকা শহরেই। ভারত বিভাজনের পর তিনি পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। তারপর তিনি ‘শান্তিনিকতনে’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ ভবনে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
বঙ্গবিভূষণে ভূষিত এই মহান ব্যক্তির জীবনকে আমরা প্রধানত দুটি ধাপে বিভক্ত করতে পারি। প্রথমত তাঁর সামাজিক আন্দোলনের একটি পর্যায় এবং দ্বিতীয়ত সাহিত্যিক জীবনের একটি অধ্যায়। একাধারে তিনি একজন সংস্কৃতি কর্মীও বটে।
সামাজিক আন্দোলনের মধ্যে তাঁর বিশেষ কিছু আন্দোলন চোখে পড়ে যেমন : ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী, সিপিআইএম) নেতৃত্বাধীন সরকারের শিল্পনীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন, নন্দীগ্রামে আন্দোলন নেতৃত্ব দিয়ে তিনি ‘সিন্ধুর ও নন্দীগ্রামের’ বিতর্কিত জমি অধিগ্রহণ নীতির বিরুদ্ধে বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, লেখক ও নাট্যকর্মীকে একত্রিত করেন। এ ছাড়া তিনি সারাজীবনই আদিবাসীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে একজন সক্রিয় কর্মী ও নেত্রী।
সামাজিক আন্দোলনের মূল ভাবটি সব শ্রেণির মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য তিনি কলম ধরলেন এবং লিখলেন ‘হাজার চুরাশির মা’ (১৯৭৪), ‘অরণ্যের অধিকার’ (১৯৭৯), ‘অগ্নিগর্ভ’ (১৯৭৮), ‘চোট্টি মুন্ডা এবং তার তীর’ (১৯৮০) এর মতো উপন্যাস। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিসগড় রাজ্যের আদিবাসী (বিশেষত লোধা ও শবর উপজাতি) অধিকার ও ক্ষমতায়নে কাজে করেছিলেন। আর এরই প্রেক্ষাপটে তিনি ‘ঝাঁসির রাণি’ (১৯৫৬) উপন্যাসটি রচনা করেন। তিনি ‘ঝাঁসি’ অঞ্চলের আদিবাসীদের কাছ থেকে তথ্য ও লোকগীতি সংগ্রহ করেছিলেন। ১৯৬৪ সালের দিকে মহাশ্বেতা দেবী বিজয়গড় কলেজে শিক্ষকতা শুরু করেন। এই সময়ে তিনি একজন সাংবাদিক ও একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবে কাজ চালিয়ে যান। লেখনীর একপর্যায়ে তিনি রচনা করেন ঔপনিবেশিক শক্তি ও সমকালীন সামন্তবাদী সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে মুন্ডা জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ সংবলিত ‘অরণ্যের অধিকার’ (১৯৭৯)। ঔপন্যাসিক এ উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে নিম্নবর্গীয় মানুষের আত্মশক্তির জাগরণকেই।
মহাশ্বেতা দেবী উপন্যাসটি লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন মুন্ডা বিদ্রোহ (১৮৮৫) ও আন্তোনিও গ্রামশির সাবঅল্টার্ন বা নিম্নবর্গ সংক্রান্ত লেখাপত্র থেকে। আন্তোনিও গ্রামশির এই ধারণাটি থেকে মহাশ্বেতা দেবী মুন্ডা জনগোষ্ঠীর সাথে একটা মেলবন্ধন তৈরি করতে চেয়েছেন।
মহাশ্বেতা দেবীর প্রসারিত কথাসাহিত্যে তিনি প্রায়ই ক্ষমতাশালী জমিদার, মহাজন ও দুর্নীতিগ্রন্থ সরকারি অধিকারীদের হাতে আদিবাসী ও অস্পৃশ্য সমাজের অকথ্য নির্যাতনের চিত্র অঙ্কন করেছেন। তাঁর অনুপ্রেরণার উৎস সম্পর্কে তিনি লিখেছেন : “আমি সর্বদাই বিশ্বাস করি যে, সত্যিকারের ইতিহাস সাধারণ মানুষের দ্বারাই রচিত হয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সাধারণ মানুষ যে লোককথা, লোকগীতি, উপকথা ও কিংবদন্তিগুলি বিভিন্ন আকারে বহন করে চলেছে, তার পুনরাবির্ভাবের সঙ্গে আমি ক্রমাগত পরিচিত হয়ে এসেছি। আমার লেখার কারণ ও অনুপ্রেরণা হলো সেই মানুষগুলো যাদের পদদলিত করা হয় এবং ব্যবহার করা হয়, অথচ যারা হার মানে না। আমার কাছে লেখার উপাদানের অফুরন্ত উৎসটি হলো এই আশ্চর্য মহৎ ব্যক্তিরা, এই অত্যাচারিত মানুষগুলো। অন্য কোথাও আমি কাঁচামালের সন্ধান করতে যাব কেন, যখন আমি তাদের জানতে শুরু করেছি? মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমার লেখাগুলো আসলে তাদেরই হাতে লেখা।”
মহাশ্বেতা দেবীর এই কথার প্রতিফলন পাওয়া যায় ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসে। উপন্যাসটি শুরুই হচ্ছে একটি জেলখানার মধ্যে মুমূর্ষু একজন ব্যক্তির আর্তনাদের আর্তস্বরের মাধ্যমে। তার জীবন শুরু অরণ্য থেকে এরপর শিক্ষা গ্রহণের নিমিত্তে মিশনে ভর্তি, সেখান থেকে আস্তে আস্তে বিপ্লবী ও বিদ্রোহী হয়ে ওঠা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে ভগবানে রূপ নেওয়া। এরপর বীরসার ফাঁসির হুকুম। সব মিলিয়ে রিমান্ডে বীরসার মৃত্যু। এই উপন্যাসটির কেন্দ্রবিন্দু অরণ্য। অরণ্যে বসবাস এবং একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দিকুশ্রেণির (এলিট বা প্রভাবশালী) মধ্যে মুন্ডা জনগোষ্ঠীর যে প্রতিবাদ এবং সংগ্রাম সেটি চিত্রায়িত করেছেন মহাশ্বেতা দেবী। মুন্ডা জনগণ ধর্মান্তরিত হয়েছে ক্ষুধার দায়ে, কিন্তু লাভ হয়নি। কারণ তারা যে বিদ্রোহটা করতে চেয়েছিল এবং যে অধিকার নিয়ে তাদের চিরদিনের পীড়ন সেটা চূড়ান্তরূপ লাভ করে নাই। তাই আবার নিজের ধর্মে, নিজের সংস্কৃতিতে ফিরে এসেছে। কারণ স্বভাষায়, স্বজাতীয় সংস্কৃতিতে যেকোনো বিষয় যতটা খুব গভীর এবং যৌক্তিক ভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় ততটা অন্য ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে বা অন্য ভাষায় সেটা প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
আসলে মুন্ডারা তাদের সংস্কৃতিকে ভালোবাসে, সেই সঙ্গে তারা জানত যে নিজেদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য তাদের একজন ভগবান দরকার। আর সেই ভগবানের রূপ নিয়ে এলো বীরসা মুন্ডা।
মুন্ডাদের এই সংগ্রাম, প্রতিবাদ শুধু অরণ্যের নয় বরং ধর্ম ও সংস্কৃতি রক্ষার, বেঁচে থাকার। প্রকৃত অর্থে অন্যায় শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদই হলো ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসটি। মহাশ্বেতা দেবী এই প্রতিবাদী, সংগ্রামী, বিপ্লবীদের কথাই তুলে ধরেছেন উপন্যাসটিতে। যাদের কথা কেউ বলে না, যাদের হয়ে কেউ কাজ করতে চায় না তাদের হয়েই মহাশ্বেতা দেবী কলম হাতে নিয়েছেন।
তাঁর কলমে উঠে এসেছে বীরসার জবানীতে বিপ্লব ও বিদ্রোহের প্রতিচ্ছবি। বীরসার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে :
‘আমি তাদের দুলাই না ভুলাই না, তাদের বাঁচাতে শিখাব, মরতে শিখাব। আবার মারতেও শিখাব।’
বীরসার এই বিদ্রোহী কণ্ঠস্বরের মধ্য দিয়ে সে ‘উলগুলানের’ ডাক দেয়। কিন্তু ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পড়ে সে ধরা পড়ে এবং বীরসার মৃত্যু ঘটে। অপরদিকে বীরসার এই বিদ্রোহ ও বিপ্লবের চেতনা সমগ্র মুন্ডাদের মধ্যে যে ছড়িয়ে পড়েছিল তা আর অলীক নয়। তাই সুগানা মুন্ডা বিশ্বাস করে : ‘উলগুলানের শেষ নেই! ভগবানের মৃত্যু নেই!’
মুন্ডারীদের নিয়ে মহাশ্বেতা দেবী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন :
‘নিচু জাত বা দরিদ্রদের ব্যাপারে কেউ নমনীয় নয়। সবাই যেকোনোভাবে প্রান্তিক জনমানুষকে শোষণ করতে চায়, তাদের শরীরের রক্ত শুষে নিয়ে যেতে চায়। ভাগ্যাহত মানুষগুলোর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে প্রতিবাদ করার ভাষা হয়তো তারা ভুলে যাচ্ছে। মৌলিক অধিকারগুলো যেখানে প্রতিনিয়ত পদদলিত সেখানে কোনো রকমে বেঁচে থাকাটাই তাদের কাছে মুখ্য। প্রতিবাদ প্রতিরোধ করতে সাহস পায় না। ভয় তাদের সাহসকে নির্বাসনে পাঠায়। এসব অবস্থা দেখে আমি বসে থাকিনি, দারিদ্র্যকে প্রণাম করে তার কাছে বন্দি হয়ে থাকিনি। কীভাবে ওই জায়গা থেকে সমাজের নিপীড়িত ব্যক্তিদের মুক্ত করা যায়, সেই প্রস্তুতি নিয়েছি, লিখেছি। যারা রাষ্ট্রের দ্বারা বা উচ্চশ্রেণির মাধ্যমে ক্রমাগত নানা নির্যাতনের মধ্যে পড়ে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না, তাদের কথাই আমি লিখতে চেয়েছি।’
আরেকটি সাক্ষাৎকারে মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন, ‘তাদের গল্পই রক্ত-মাংসের মতো আমার লেখায় স্থান পায়।’
মহাশ্বেতা দেবী দক্ষতার সঙ্গে ইতিহাসকে আশ্রয় করে নির্মাণ করেছেন ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাস ও এর বীরসা নামক বিদ্রোহী চরিত্র। ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসের কাহিনী ব্যপ্ত ২৫ বছরের মধ্যে। কিন্তু এই ২৫ বছর মুন্ডাদের জীবনের হাজার হাজার বছর ধরে শোষিত বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত হয়ে আসার ইতিহাসকে বহন করে। উপন্যাসজুড়ে অস্তিত্ববাদের চিরায়ত লড়াইটাই ফুটে উঠেছে। এ লড়াই চিরকাল ধরে চলছে, চলবে।
‘জীবন মানে এক নিরবচ্ছিন্ন স্রোত, তা কখনো এক স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে না। অতীতে কখনো ফিরে যায় না। অজানা ভবিষ্যতের দিকে তার গতি। মানুষ নিয়তির অধীন। সংসার পরিবেশে মানুষ জন্মায় আর ভেসে চলে তবু মানুষ হার মানে না, মানতে চায় না। নিঃসঙ্গ মানুষ একাকী সংগ্রাম করে। বাধার পর বাধা ডিঙিয়ে যায়, প্রাণ দেয় তবু হার মানে না, সেই মানুষ জীবনকে দেয় নতুন মাত্রা।’
এই উপন্যাসে ঔপন্যাসিক বীরসার মতো বিপ্লবীকে সেই দ্যোতনাতেই ফুটিয়ে তুলেছেন। অবশেষে বীরসার আত্মাহুতির মাধ্যমেই যবনিকা টেনেছেন ‘অরণ্যের অধিকারে’র লেখক মহাশ্বেতা দেবী।