কুরোসাওয়া কথা
আমার অবাধ্যতা
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
মহাপ্রলয়ংকরী কান্তো ভূমিকম্পের পর, মিডল স্কুলে আমার দ্বিতীয় বর্ষের শুরুর দিকেই, আমি একজন বেপরোয়া পাঙ্কস্টার বা রংবাজ হয়ে উঠি। কেইকা মিডল স্কুলের বিল্ডিংটি পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল বলে, উশিগোমে-কাগুরাজাকা অঞ্চলের কাছাকাছি একটি টেকনোলজি স্কুলে ক্লাস করতে হতো আমাদের। তখনকার দিনে এটি ছিল একটি নাইট স্কুল; ফলে দিনের বেলায় সেটির বিল্ডিংগুলোর সাধারণত কোনো ব্যবহার হতো না। তবু দ্বিতীয় বর্ষের চারটি ক্লাসের সবকটিরই শিক্ষার্থীরা আলাদা আলাদা ক্লাসরুমের বদলে বরং অডিটরিয়ামে ঠাসাঠাসি করে ক্লাস করতাম। অডিটরিয়ামটির শেষের সারির সিটে যারা বসত, তাদের কাছে শিক্ষককে দেখতে শুধু বামনই লাগত না, বরং তার কণ্ঠস্বর শোনাও দুরূহ হয়ে পড়ত। আমার সিটটিও যেহেতু একেবারেই পেছনের দিকে ছিল, ফলে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়ার চেয়ে বরং বদমায়েশিতেই মত্ত থাকতাম আমি।
এক বছর পর, শিরায়ামা মন্দিরের কাছাকাছি যখন স্কুলটি পুনঃস্থাপন করা হয়ে গিয়েছিল, তখনো আমার মধ্যে বদমায়েশি করার প্রবণতা রয়ে গিয়েছিল বলে ভীষণ মুসিবতে পড়ে গিয়েছিলাম। আমরা যখন টেকনোলজি স্কুলটিতে ক্লাস করতাম, আমার বদমায়েশির অবস্থা তখনো যথেষ্ট প্রাথমিক পর্যায়ের ও অহিংস ধরনের ছিল। কিন্তু নতুন স্কুলে এসে আমি এমন কিছু কাণ্ড করে বসলাম, যা নিতান্তই বিপজ্জনক। একবার তো আমাদের রসায়ন ক্লাসে শেখা সূত্র ধরে, ডিনামাইটের ফর্মুলার সব উপাদান একত্র করেও ফেলেছিলাম। ল্যাবরেটরিতে আমি সতর্কতার সঙ্গে এই মিশ্রণ একটি বিয়ারের বোতলে ভরে নিয়ে, রেখে দিয়েছিলাম শিক্ষকের ডেস্কে। তিনি যখন এটির পরিচয় জানতে পারলেন, তার মুখ একদম কাপড়ের মতো সাদা হয়ে গেল; খুবই সাবধানে তিনি বোতলটি ডেস্ক থেকে সরিয়ে বাইরে নিয়ে গিয়ে, স্কুলের বাগানের পুকুরটিতে ডুবিয়ে দিলেন। যতদূর জানি, কেইকা মিডল স্কুলের পুকুরের তলানিতে এখনো শান্তিময় এক গভীর নিদ্রায় মগ্ন রয়েছে সেই বোতলটি!
আরেকবার আমি হিসাব করে দেখলাম, আমাদের ক্লাসে অঙ্ক শিক্ষকের যে ছেলেটি পড়ে, যে কি না নিজেই অঙ্কে খুব দুর্বল—নিশ্চয়ই সে বার্ষিক পরীক্ষার আগেভাগে প্রশ্নগুলো পেয়ে যাবে। আমি কয়েক বন্ধুকে সঙ্গী করে, সেই ছেলেটিকে স্কুল বিল্ডিংয়ের পেছনে ডেকে নিয়ে গেলাম। প্রথমদিকে সে জোরের সঙ্গেই বলল, এ ব্যাপারে তার কিছু জানা নেই; তবে শেষ পর্যন্ত আমরা তার কাছ থেকে শেষ পরীক্ষাটির সব প্রশ্নই বের করে নিতে পেরেছিলাম। আমরা সেগুলো ক্লাসের বাকি সব ছাত্রের মধ্যে বিলিয়ে দিলাম এবং পরীক্ষায় অলৌকিকভাবে ক্লাসের সবাই একশতে একশ পেল। অবশ্য এই রেজাল্ট স্বভাবতই শিক্ষকের মনে সন্দেহ জাগাল; ফলে তিনি তার ছেলেকে যে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন—ধারণা করে রেখেছিলাম। সে সম্ভবত সবকিছু স্বীকার করেও নিয়েছিল; কেননা, ক্লাসের সব ছাত্রকে সেই পরীক্ষাটিতে আবার বসতে হয়েছিল। এই দ্বিতীয়বারের পরীক্ষায় শিক্ষকটির পুত্র তো ফেল করেছেই, সঙ্গে করেছিলাম আমিও।
আমার মধ্যে এই বদমায়েশির কোনো লক্ষণ ফুটে উঠেছিল কি না, জানতাম না। প্রবল ক্রোধ নিয়ে, নিজের স্পাইকড বেসবল শু পায়ে দিয়ে, লেকচার হলের সব ডেস্কের ওপর উঠে ছুটে বেড়াতাম আমি। কিন্তু এ এমনই চরম এক আচরণ ছিল যে, সেটি আমি স্বীকার করিনি কখনো। পরে একসময় অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, আমার যোগাযোগ-ক্ষমতার প্রবল উন্নতি ঘটে গেছে!
মিডল স্কুলে তৃতীয় বর্ষের শেষভাগে, মিলিটারি ট্রেনিং হয়ে উঠেছিল একটি নিয়মিত পাঠ্যসূচির অংশ। আমাদের স্কুলে নিয়োগ পেয়েছিলেন একজন সত্যিকারের আর্মি ক্যাপ্টেন। তার সঙ্গে সম্পর্কটা মোটেও ভালো ছিল না আমার। একদিন আমার এক বদমায়েশি-অনুরাগী বন্ধু নিজের সঙ্গে নিয়ে আসা একটি টিনের পাত্র দেখাল আমাকে। মার্কসম্যানশিপ বা গুলি ছোড়ার প্র্যাকটিসে আমরা যে বুলেটগুলো ব্যবহার করতাম, সেগুলোর গান-পাউডারে ভরা ছিল সেটি। সে নিশ্চিত করে বলল, কেউ যদি এটি ফাটিয়ে দিতে পারে, তাহলে তুখোড় এক শব্দ শোনা যাবে; কিন্তু এ কাজটি করার মতো যথেষ্ট সাহসী কাউকে খুঁজে পাচ্ছিল না সে। আমি যখন বললাম, যেন সে নিজেই কাজটি করে দেখে, জবাবে জানাল, তারও সাহসে কুলোচ্ছে না; বলল, ‘তুই করে দেখ না, কুরো-চান?’
যেহেতু বিষয়টি তখন চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে, ফলে মানা করতে পারলাম না। বললাম, ‘আচ্ছা, ঠিক আছে’; এবং পাত্রটিকে বসিয়ে দিলাম স্কুল বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির তলায়। এরপর বড় এক পাথর নিয়ে, উঠে গেলাম তৃতীয় তলায়, আর ওপর থেকে ছেড়ে দিলাম পাথরটা। কানে তালা লাগিয়ে দেওয়ার মতো ভয়ানক এক শব্দ হলো; এ ছিল আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি জোরালো শব্দ।
কংক্রিটের দেয়ালে শব্দটির প্রতিধ্বনি তখনো থেমে যায়নি, আর্মি ক্যাপ্টেন রেগেমেগে ছুটে এলেন আমার দিকে। আমি তো কোনো সৈনিক ছিলাম না, ফলে গায়ে হাত তোলেননি তিনি; বরং আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গেলেন প্রিন্সিপালের অফিসে। সেখানে গিয়ে, অগ্নিশর্মা হয়ে আমাকে সুতীব্র ভর্ৎসনা করতে লাগলেন। পরের দিন আমার বাবাকেও ডেকে পাঠানো হলো। আমার ধারণা, বাবার মিলিটারি ক্যারিয়ার এ ক্ষেত্রে খানিকটা প্রভাব ফেলতে পেরেছিল। স্কুল থেকে বহিষ্কার হওয়ার ব্যাপারে মনে মনে আমি পুরোদস্তুর প্রস্তুত হয়ে ছিলাম; কিন্তু আমাকে বহিষ্কার করা হয়নি এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের জন্য দেওয়া হয়নি কোনো ধরনের শাস্তিও।
এ ব্যাপারে বাবাও আমাকে খুব একটা বকাঝকা করেছেন বলে মনে পড়ে না। আর প্রিন্সিপালের অফিসে আর্মি ক্যাপ্টেনটি যখন আমাকে ভর্ৎসনা করছিলেন, তখন প্রিন্সিপাল সেখানে উপস্থিত থাকলেও আমার ওপর রেগে গিয়েছিলেন বলে মনে পড়ে না। এ বিষয়টি নিয়ে এখন ভাবতে বসলে মনে হয়, বাবা ও প্রিন্সিপাল—দুজনের অবস্থান বোধহয় সেই বাধ্যতামূলক সামরিক শিক্ষার বিপক্ষেই ছিল।
নিয়মনীতির প্রশ্নে শিক্ষক আর সামরিক কর্তাদের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই কিছু পার্থক্য ছিল; তবে মেইজি যুগের মধ্যে—সেটির এলিট মিলিটারি ও বিজনেস ক্লাসের প্রভাব প্রতিপত্তি এবং চরম গোঁড়ামির জন্য চিহ্নিত এর পরবর্তীকালের তাইশো ও শোয়া সময়কালের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গিজনিত পার্থক্যটি ছিল সুবিশাল। আমার বাবা ছিলেন মেইজি যুগের একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব—সমাজতন্ত্রকে যিনি ঘৃণা করতেন। তবে ১৯২৩ সালে একজন উগ্রবাদী আর্মির হাতে [মাসাহিকো আমাকাসু] আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত ‘অ্যানার্কিস্ট’ ওসুগি সাকায়ে ও অন্যরা নৃশংসভাবে খুন হলে, এবং পরিণামে এই গুপ্তঘাতক মাত্র ১০ বছরের সাজা পেলে বাবা ফুঁসে উঠেছিলেন, ‘পাগলের কাজ-কারবার! তারা আসলে ভাবেটা কী?’
কেইকায় আর্মি ক্যাপ্টেনটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল একেবারেই কুরোদা প্রাইমারি স্কুলে মিস্টার তাচিকাওয়ার জায়গায় আসা শিক্ষকটির সঙ্গে আমার সম্পর্কের মতো। তিনি যা-ই শেখানোর চেষ্টা করতেন, সবগুলোতেই করে দেখানোর জন্য আমার নামটি বেশ তৃপ্তির সঙ্গে নিতেন বলে মনে হতো। নমুনা হিসেবে আমি কখনোই মানানসই ছিলাম না; এবং যখনই তালগোল পাকিয়ে ফেলতাম ও বেকুব হয়ে যেতাম—তিনি বেশ উপভোগ করতেন।
এই পরিস্থিতি নিয়ে আমি বেশ সতর্কতার সঙ্গে ভেবে দেখেছি এবং শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রতিনিধিত্বকারী নোটবুকটির ভেতর সেকেলে চায়নিজ-স্টাইলের গদ্যে লেখা একটি চিঠি লিখে রেখে দিয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, ‘এই বালকটি বুকের ব্যারাম আছে, তাই দয়া করে ওকে রাইফেলের মতো ভারি যন্ত্রপাতি বইতে দেবেন না।’ চিঠিতে বাবার সিল মেরে দিয়ে, তুলে দিয়েছিলাম আর্মি ক্যাপ্টেনের হাতে। চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গিয়েছিল তার; তবে মেনে নিয়েছিলেন। এর পর থেকে আর কোনোদিন তিনি ‘সোজা টার্গেট করে, তোমার হাঁটু বরাবর অবস্থা থেকে গুলি করো!’ কিংবা ‘শত্রু তোমার কাছে চলে এসেছে, শুয়ে পড়ে গুলি চালাও!’ এ জাতীয় কমান্ড দিয়ে আমাকে আর জ্বালাতন করেননি।
তবে রাইফেলের ওজন আমার বহনের তুলনা অনেক ভারী হলেও, আমার জন্য তা যথার্থই ধরা হলো। ক্যাপ্টেন আমাকে একজন প্লাটুন লিডার হিসেবে ট্রেনিং করাতেন। আমার কমান্ডে, পুরো ক্লাসই যেন অ্যাকশনে যেত। কিন্তু কমান্ড করতে গিয়ে গোলমাল পাকিয়ে ফেলতাম আমি কিংবা আচমকাই মুখের ভেতর থেকে শব্দ বের হতে চাইত না, আর তার ফল হলো আজব ধরনের। আমার সহপাঠীদের কাছে এ বিষয়টি বেশ মজার লাগত; ফলে আমি ডানে যেতে বলতে তারা উল্টোদিকে মার্চপাস্ট শুরু করত, এবং যখনই আমি কোনো ভুল কমান্ড দিতাম, তখন ওরা বেশ আমুদের সঙ্গে তা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মেনে নিত। যেমন ধরুন, একবার আমি যখন বললাম—‘ফরোয়ার্ড, মার্চ!’, তখন রাইফেল কাঁধে নিয়ে ওদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার কথা, অথচ ওরা রাইফেল নিচে নামিয়ে রেখে দিয়েই সোজা হাঁটা দিলো। সবাই একসঙ্গে মার্চপাস্ট করে সোজা দেয়ালের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় ওদেরকে বিশেষ রকমের উচ্ছ্বসিত দেখাল। আমি হতভম্ব হয়ে, মুহূর্তেই ডিরেকশন বদলের কমান্ডটি করতে পারলাম না; ওরা বেশ হাসিমুখেই দেয়ালটির সামনে গিয়ে, নিজেদের বুট দিয়ে ভয়ানক শব্দ করতে থাকল। আমি তখন কোনো উপায় না দেখে, হাল ছেড়ে দিলাম। আর্মি ক্যাপ্টেনটি কী বলছেন, তাতে কিছুই এলো-গেল না, বরং আমি নির্বাক মুখে না-দেখার ভান করে এড়িয়ে গেলাম। এ কাণ্ড দেখে, আমার সহপাঠীরা আমার নির্দেশ মানার ব্যাপারে আরও বেশি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠল, এবং কেউ কেউ তো দেয়ালটি পেরিয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করছিল। আমি আরেকটি কমান্ড করার আগপর্যন্ত, আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর্মি ক্যাপ্টেন।
আমার সহপাঠীরা অবশ্য দাবি করেছিল, আমাকে বিব্রত করার কোনো উদ্দেশ্যই নাকি ওদের ছিল না; বরং আর্মি ক্যাপ্টেনকে জ্বালাতন করার জন্যই এমনটা করেছিল। সামরিক শিক্ষার পরিদর্শক যখন এলেন এবং আমরা যখন তাকে দেখানোর জন্য একটা অ্যাটাকের প্র্যাকটিস করছিলাম, তখন এই সহপাঠীরাই নিজেদের দৃঢ়তার রূপ সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখিয়েছে। আমরা যখন পারফর্ম শুরু করার অপেক্ষারত, তখন সহপাঠীদের বলেছিলাম, ‘ঠিক আছে, কোনটা কীভাবে করতে হয়—এই ক্যাপ্টেনকে তা দেখানো যাক। ইন্সপেক্টর যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন, তার সামনেই বিরাট একটা কাদার গর্ত রয়েছে। আমরা যখন সেখানে পৌঁছাব, তখন তোমাদেরকে শুয়ে পড়ার নির্দেশ দেবো আমি, তোমরা সবাই সেটি ঠিকঠাক মতো পালন করবে।’ তারা সবাই মাথা নাড়াল। আমি ‘চার্জ!’ কমান্ডটি করতেই, তারা সবাই পড়িমরি করে ছুটতে শুরু করে দিল, এবং আমি ‘ডাউন!’ বলে চিৎকার করতেই, কাদার সেই গর্তটির ঠিক সামনে, সবাই ভয়ংকরভাবে নিজেদের সঁপে দিল। বাতাসে ছিঁটকাতে থাকল ব্যাপক এক ঝাপটা, আর আমরা সবাই পরিণত হলাম কাদার পুতুলে।
ইন্সপেক্টর গর্জে উঠলেন, ‘করছটা কী!’ আমি এক পলকে, ইন্সপেক্টরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাপ্টেনের মুখের দিকে তাকালাম। দেখে মনে হলো, যেন কোনো কীট তাকে দংশন করেছে; যেন তিনি আশা করেছিলেন বাষ্পে রাঁধা কোনো রাইস-কেকের, অথচ পেয়েছেন ঘোড়ার খাবার! মিডল স্কুল থেকে আমি গ্র্যাজুয়েট হয়ে বের হওয়ার আগপর্যন্ত আমাদের দুজনের মধ্যে এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কটি অব্যাহত ছিল।
আমার দ্বিতীয় বিদ্রোহী পর্যায়কালে এই সম্পর্ক ঠিক কীভাবে গড়ে উঠেছিল, তা এখন আমার কাছে অনেকটাই স্পষ্ট। টের পাই, এই একটি মানুষের বিরুদ্ধে নিজের তারুণ্যকে সম্পূর্ণভাবে নিয়োজিত করেছিলাম আমি। আমার এ কথা বলার কারণ, এ সময়কালটিতে নিজের পরিবার কিংবা অন্য কারও প্রতি আমি বিরুদ্ধাচারণ দেখাইনি; বরং আমার ক্রোধের সব আগুনে পুড়েছেন একমাত্র এই আর্মি ক্যাপ্টেনটিই।
কেইকা মিডল স্কুল থেকে পাস করার সময়, সামরিক শিক্ষায় ফেল করা আমাদের ক্লাসের একমাত্র ছাত্রটি ছিলাম আমিই। নিয়োগকৃত সেই অফিসারের কাছ থেকে পারদর্শিতার কোনো সার্টিফিকেট আমি পাইনি। সবচেয়ে বড় কথা, গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে আমাকে নিয়ে ক্যাপ্টেন ঠিক কী বলে বসেন—এই ভয়ে সেদিন আমি বাড়িতেই থেকেছি। তবে পরে যখন নিজের ডিপ্লোমা নিয়ে, স্কুল গেট পেরিয়ে বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম, দেখি, তিনি দাঁড়িয়ে আছেন অপেক্ষায়। আমাকে দেখে সামনে এগিয়ে এলেন, আমার পথ আটকালেন এবং রাগে কাঁপছিলেন। গর্জে বললেন, ‘দেশদ্রোহী!’ পথচারীরা কৌতূহলী হয়ে, থেমে, আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল তখন। তবে তাকে জবাব দেওয়ার জন্য আমিও ছিলাম প্রস্তুত। একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে বলে উঠলাম : ‘কেইকা মিডল স্কুল থেকে গ্র্যাজুয়েশন করে ফেলেছি আমি। স্কুলটিতে মিলিটারি অফিসার হিসেবে আপনি যেহেতু নিযুক্ত, ফলে আমাকে কিছু বলার আর কোনো অধিকার কিংবা দায়িত্ব আপনার নেই। সব খতম!’ গিরগিটির মতো তার মুখটা, মুহূর্তেই নানা রঙে বদলে যেতে থাকল। তার মুখের সামনে আমার সনদটি নাচিয়ে, সোজা ঘুরে হাঁটা দিলাম আমি। একটুখানি এগিয়ে আবার পেছন ঘুরে দেখি—তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন ঠায়।
(চলবে)