কুরোসাওয়া কথা
পরিবারপুঞ্জি
ভূমিকা
জাপানি মাস্টার ফিল্মমেকার আকিরা কুরোসাওয়া (২৩ মার্চ ১৯১০-৬ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮)। বিশ্ব সিনেমার ইতিহাসের অন্যতম স্বতন্ত্র ও প্রভাববিস্তারী নির্মাতা। ৫৭ বছরের ক্যারিয়ারে নির্মাণ করেছেন ‘রশোমন’, ‘সেভেন সামুরাই’, ‘ড্রিমস’সহ ৩০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ ফিল্ম। নিজ জীবনের একান্ত কথা তিনি জাপানি ভাষায় লিখে গেছেন যে গ্রন্থে, সেই আত্মজীবনীটির ইংরেজি অনুবাদ ‘সামথিং লাইক অ্যান অটোবায়োগ্রাফি’ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮০ দশকের শুরুতে। সেই গ্রন্থের পূর্ণাঙ্গ বাংলা অনুবাদ, ‘কুরোসাওয়া কথা’ শিরোনামে, ধারাবাহিকভাবে দেওয়া হচ্ছে এখানে। অনুবাদ করেছেন রুদ্র আরিফ।
আমি তখন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে, আমাকে নিজের আত্মীয়দের কাছে থাকার জন্য পাঠানো হয়েছিল তোয়োকাওয়া গ্রামে। বাড়িঅলা ছিলেন আমার বাবার বড়ভাই; তবে তিনি তখন আর জীবিত ছিলেন না, ফলে তার বড় ছেলেই তখন গৃহকর্তা।
বাড়িটি এর আগে ছিল এক ধানের গুদামঘর। আসল বাড়িটি আমার দাদার আমলে এ এলাকার সবচেয়ে ধনী লোকটির কাছে বেচে দেওয়া হয়েছিল। আমার সময়ে এসে, সেই বাড়িটির কোনো ফুটো-ইটেরও অস্তিত্ব ছিল না আর। তবে বাগানটিতে অতীতের খানিকটা ছায়া তখনো চাইলে খুঁজে পাওয়া যেত।
একটা চমৎকার আঁকাবাঁকা নালা বয়ে যেত সেখানে। রান্নাঘরটির ঠিক মাঝখান দিয়ে গিয়ে, শহরটির মূল প্রবেশপথের পাশের ছোট নদীটির বুকে গিয়ে পড়ত। তারা বলে, পুরোনো দিনগুলোতে নাকি সেই নালার ভেতর ব্যাঙ ধরা যেত। রান্নাঘরের স্রোতধারা আটকে দেওয়া ব্যাসিনের মধ্যেও নাকি চলে আসত ব্যাঙগুলো।
যে দালানটি একদা ধানের গুদামঘর ছিল, সেটির সিলিংগুলোকে ঠেস দিয়ে রেখেছিল সাধারণ কোনো বাড়ির তুলনায় বরং যথেষ্ট বড় আকারের পিলারগুলো। এই বাড়িটির মোটা ও শক্ত সেন্ট্রাল পিলারটি কড়িকাঠের অনুভূমিক-দণ্ড হিসেবেও কাজ করত; দেখতে কালো চিকচিকে এক আভা বের হতো সেটি থেকে।
আমাকে এখানে পাঠানোর আইডিয়াটি ছিল বাবার। তিনি ঠিক করেছিলেন, এ জায়গাটি আমার শারীরিক দুর্বলতা সারানোর পাশাপাশি আমাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতেও শেখাবে। আমার প্রতিদিনকার প্রশিক্ষণের একটি কর্মতালিকা বাবা এই গৃহকর্তার কাছে লেখা তার চিঠিটিতে খসড়ারূপে লিখে দিয়েছিলেন। বাবার নির্দেশনাগুলো একেবারেই যথাযথভাবে আমল করার বাধ্যবাধকতা ছিল আমার।
আমার মতো এক শহুরে বালকের কাছে এ ছিল রীতিমতো এক নিষ্ঠুর শাসন। খুব ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে পড়তে হতো আমাকে, আর যতদ্রুত সম্ভব সকালের নাস্তা সেরে, বেরিয়ে যেতে হতো বাড়ি থেকে। দুই স্তরের একটি লাঞ্চবক্স দেওয়া হতো আমার জন্য। তাতে রাখা থাকত দুজন মানুষের জন্য দুই ভাগের খাবার। প্রতিটি ভাগে ছিল শুধু ভাত, মিসো বিন পেস্ট আর কাসুন্দি। আমাকে একটি কাস্ট-আয়রন পটও বয়ে নিয়ে যেতে হতো। বাড়ির বাইরে এসে, আমার স্থানীয় এক আত্মীয়ের বাড়ির, প্রাইমারি স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া এক বালকের সঙ্গে দেখা করতে হতো। এই ছেলেটি বরাবরই নিয়ে আসত মাছ ধরার বিশাল এক জাল আর বিরাট এক ছিপ।
আইডিয়া ছিল এ রকম—যদি আমরা কাসুন্দি ও ভাতের বাইরে মধ্যাহ্নভোজে ও সান্ধ্যভোজে অন্য কিছু খেতে চাই, তাহলে আমাদের নিজেদেরই মাছ ধরে খেতে হবে। ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া সেই ছেলে যে ছিপটি বহন করত, সেটির এক মাথায় একটি আংটা ছিল। সেই দণ্ডটি স্রোতের মধ্যে ধরে রেখে, মাছকে জালের দিকে তাড়িয়ে নেওয়া হতো। আমার সঙ্গী সেই ছেলেটি দৈহিক আকারে এতই বড় ছিল, ছিপটি তার কাছে খড়ের টুকরোর মতো মনে হতো; তবে ছিপটি আমি ওঠানোর চেষ্টা করতে গেলেই টের পেতাম, বেশ ভয়ংকর রকম ভারি। ফলে স্রোত আটকে দিয়ে, মাছকে জালের দিকে চালিত করানোর কাজটি বেশ কঠিনই ছিল। কিন্তু আমরা কাসুন্দি ও ভাতের চেয়ে মাছ খেতেই চাইতাম বেশি; ফলে করতাম এটিকে ব্যবহারের যারপরনাই চেষ্টা।
ষষ্ঠ শ্রেণিপড়ুয়া ছেলেটি মাছ ধরার জালটি বেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ব্যবহার করতে পারত। কিন্তু ছিপ নাড়াতে একদমই রাজি ছিল না সে। বলেছিল, ‘না। নির্দেশ আছে।’ তার মানে, আমার বাবার নির্দেশনাবলি এই ছেলেটির মগজেও অদ্ভুতভাবে ঢুকে গিয়েছিল। ফলে সে বন্ধ করে দিত আমার মুখ।
গ্রীষ্মকাল ছিল তখন। তাই খাওয়ার সময় আমরা সাধারণত এক ঠান্ডা বনাঞ্চলে চলে যেতাম। প্রথমে দুটি ওয়াই-আকৃতির বৃক্ষশাখা চোখে পড়েছিল আমাদের। সেগুলোর শেকড় ছিল মাটিতে। পরে আমরা গিয়ে শাখাগুলোকে আড়াআড়ি করে দিলাম। তার ওপর ঝুলিয়ে দিলাম পাত্রটি। আর নিচে জ্বালিয়ে দিলাম আগুন।
পাত্রটি ছিল লোহার তৈরি। তবে এর ভেতরে ছিল কাইয়াকি স্টাইলে মাছ রান্নার জন্য মিসো সস-সহকারে বিশাল ক্ল্যামশেল বা ঝিনুকের খোলস। সাধারণত নানা ধরনের পোনামাছই ধরতে পারতাম আমরা। ইচ্ছে হলে এখানে-সেখানে জন্মানো ভেষজ আর সবজিও যুক্ত করতাম। খাবার খেতাম কাঠের চপস্টিক দিয়ে। আমাদের খাবার ছিল দুর্দান্ত সুস্বাদু।
আমার সারা জীবনে খাওয়া সবচেয়ে সুস্বাদু খাবার ছিল সেগুলোই—এ কথাটি আমি লিখতেই যাচ্ছিলাম; কিন্তু তাহলে তা খানিকটা বাড়াবাড়িই হবে। তা ছাড়া, এই খাবারগুলো, নাকি পরবর্তীকালে পর্বতারোহণে আমার আসক্তি জন্মানোর দিনগুলোতে পাহাড়চূড়ায় যে ঠান্ডা রাইসবলগুলো খেতাম—এ দুই খাবারের মধ্যে কোনটা যে সর্বসেরা—তা নির্ধারণ করা আমার জন্য দুরূহ বটে।
সাধারণত নদীর পাড়ে বসেই খাবার খেতাম আমরা। আকাশে সূর্যাস্তের রং, আর নদীতে তার প্রদীপ্ত প্রতিফলন—এমন পরিবেশে বসে খাওয়ার ফলে, একই খাবার হওয়া সত্ত্বেও, যেন প্রতিবার আলাদা একেকটা আস্বাদন পাওয়া যেত। খাওয়া শেষ হলে, বাড়ির পথ ধরতাম আমরা। ততক্ষণে একেবারেই অন্ধকার নেমে আসত চারপাশে। বাড়ি ফিরেই ঝটপট গোসল সেরে, ঘুমিয়ে পড়তাম আমি। চুল্লির উপর থেকে এক কাপ চা নিয়ে এলেও, চোখ খোলা রাখা খুব কঠিন হয়ে উঠত আমার জন্য; তাই সোজা চলে যেতাম বিছানায়।
বৃষ্টির দিনগুলো ব্যতিক্রম হলেও, গ্রীষ্মের বাকি দিনগুলো এমনই কেটেছে আমার—পাহাড়ি সামুরাই জীবনে। ধীরে ধীরে মাছ ধরার পারদর্শী হয়ে উঠেছি। বহন করে নেওয়া ছিপটি হয়ে উঠেছে আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত হালকা। ধীরে ধীরে পর্বতের গভীর থেকে আরো গভীরে আসা-যাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, আর আমাদের দলের সদস্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিনে; তারপর চার হয়ে পাঁচে—এভাবে আমাদের সঙ্গে যুক্ত হওয়া শিশুর সংখ্যা বেড়ে চলছিল।
একদিন আমরা এক ঝর্ণার কাছে এসে দাঁড়ালাম। পাহাড়ের দেয়াল ঘেঁষে, পাথুরে সুড়ঙ্গ দিয়ে আবির্ভূত হয়ে এটি, গিয়ে পড়েছিল ত্রিশ ফুটের মতো নিচের এক জলাশয়ে। জলাশয়টি খুব একটা বড় ছিল না। জলধারাটি আছড়ে পড়ত পাহাড় বেয়ে। অন্য বালকদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম, যেখান দিয়ে ঝর্ণাটি বয়ে আসে—সুড়ঙ্গের সেই অপর প্রান্তে কী রয়েছে? তারা সবাই জানাল, কেউই জানে না সে কথা; কেউই সে মাথায় যায়নি কখনো। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, তাহলে আমিই যাব।’ তারা সবাই আতঙ্কগ্রস্ত চোখে তাকাল আমার দিকে। এই ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য চাপ বোঝাতে থাকল। তা ছাড়া, যেহেতু বড়রা কেউ নেই সঙ্গে, তাই এ কাজটি সত্যিকারঅর্থেই বিপজ্জনক হবে—তারা বেশ জোরের সঙ্গে বলল এ কথা। এসব পীড়াপীড়ি শুনে জেদ চেপে গেল আমার। বুঝলাম, আমাকে যেতেই হবে সেখানে।
আমাকে আটকাতে চাওয়া সকল ভীতু প্রচেষ্টাকে ধিক্কার জানালাম আমি, আর খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠতে লাগলাম। যেখান থেকে ঝর্ণাটি বেরিয়ে আসছিল, সেই গহ্বরে ঢুকে পড়লাম। দুই হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ওপরের দেয়াল ধরে, স্রোতের নিচে পা দুটো ফাঁকা করে এগোতে থাকলাম। প্রত্যেক পদক্ষেপে এক পা থেকে আরেক পায়ে ক্রমাগত ভার সরিয়ে, যেখান থেকে স্রোত আসছিল—সুড়ঙ্গের সেই শেষ প্রান্তের আলোর দিকে এগিয়ে গেলাম। যখনই আমি কোনো হাত বা পা নাড়াচ্ছিলাম, প্রতিবার পাথরের দেয়ালের মিহি, ভেজা শ্যাওলা আমাকে হড়কে দেওয়ার ভয় দেখাচ্ছিল। সুড়ঙ্গের ভেতরে পানির শব্দ, আর প্রতিধ্বনির গর্জন দিয়েছিল কানে তালা লাগিয়ে। তবু এতটুকুও ঘাবড়াইনি আমি।
কিন্তু যে মুহূর্তে অপরপ্রান্তটিতে গিয়ে পৌঁছলাম, তখনই অসাবধানতাবশত মুঠি আলগা হয়ে গেল আমার। মুহূর্তেই পড়ে গেলাম জলস্রোতে। সুড়ঙ্গটি দিয়ে কীভাবে ফিরে এলাম আগের জায়গায়, জানি না; তবে বোধশক্তি ফিরে পাওয়ার আগেই ঝর্ণাটির চূড়োয় পৌঁছে গেলাম, আর বোকার মতো গিয়ে পড়লাম নিচের জলাশয়টিতে। পুরো কাণ্ডটিতে আমি সম্ভবত অক্ষতই রইলাম। কেননা, আমি ভেসে উঠে, সাঁতরে চলে এসেছিলাম জলাশয়ের কিনারায়—যেখানে পিরিচের মতো বড় বড় চোখ করে, বাকি বালকেরা চরম আতঙ্ক নিয়ে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।
সুড়ঙ্গটির অপরপ্রান্তে ঠিক কী আছে—ওরা আমার কাছে তা জানতে চায়নি বলে ধন্যবাদ ওদের। কেননা, আমি সেটির কাছে পৌঁছুতে পারলেও, চোখ মেলে দেখার মতো সময় তো পাইনি!
এ ঘটনার পর আরেকটি বোকামি করেছিলাম আমি—যা তোয়োকাওয়া গ্রামের বালকগুলোকে অবাক করেছিল। তামাগাওয়া নামের মোটামুটি বড় আকারের এক নদী ছিল কাছাকাছি। তামাগাওয়ার জলপ্রবাহের এক জায়গায় ছিল বিশাল এক ঘূর্ণিপাক। গ্রামের ছেলে-পেলেরা যখনই সাঁতার কাটতে নামত, নিজের বিচারবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে, সেই জায়গাটি ভীষণ সচেতনভাবেই এড়িয়ে চলত তারা। নদীর সে জায়গাটি দিয়ে সাঁতার কেটে গিয়ে নিজের সাহসের পরিচয় দেওয়ার জেদ আমার ভেতর আরো একবার চেপে বসল। শুনে স্বভাবতই সবার মুখ পাংশুটে হয়ে গেল। আরো একবার আমাকে আটকানোর চেষ্টা করল ওরা। ফলে স্বভাবতই আমি তা করে দেখাতে আরো বেশি জেদ খাটালাম!
শেষ পর্যন্ত সেই ঘূর্ণিপাকের ভেতর আমাকে সাঁতার কাটার ব্যাপারে একটি শর্ত দিলো এই বালকেরা। ওরা নিজেদের কিমোনোর উত্তরীয় একসঙ্গে গিঁট বেঁধে, একটা বড় রশির মতো বানিয়ে, আমাকে সেটি দিয়ে বেঁধে দিলো। যদি খারাপ কিছু ঘটে, ওরা আমাকে টেনে টেনে, পানি থেকে তুলতে পারবে পাড়ে। কিন্তু এই রশিটিই আমার জন্য হয়ে উঠেছিল মৃত্যুর ফাঁস।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির পরপরই কানকাইরিয়ু সুইমিং স্টাইলটি শিখে নিয়েছিলাম আমি। সেই শিক্ষার অংশ হিসেবে, প্রকাণ্ড এক পণ্যবাহী জাহাজের নিচ দিয়ে সাঁতরে যেতে হয়েছিল আমাকে। শিক্ষক আমাকে যা বলে দিয়েছিলেন, সেই মুহূর্তে ঘটেছিল ঠিক তা-ই। আমি যখন জাহাজের নিচে, মাঝামাঝি অবস্থায় পৌঁছেছি, আচমকাই সেটির তলদেশের বোর্ডের সঙ্গে বাড়ি খেলাম। তবে শিক্ষকটির কথা ঠিকঠাক মাথায় রেখে, একদমই ঘাবড়ে যাইনি আমি। বরং গেছি উল্টে। আমার পিঠ আটকে গিয়েছিল জাহাজের তলদেশে। তবু আমি নিজের চার হাত-পা দিয়ে ধাক্কা মেরে সরে, সাঁতরে বেরিয়ে এলাম।
জাহাজের তলদেশ পেরিয়ে আসার এই অভিজ্ঞতা আমার ছিল বলে, এই মামুলি ঘূর্ণিপাকটিকে বিশেষ কিছু মনে হয়নি আমার। কিন্তু ঘূর্ণিপাকে ডাইভ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম নদীর একদম তলদেশে। জাহাজের ঘটনা মনে করে নিজেকে বারবার বলতে থাকলাম, ‘ভয় পেও না’। আর ঘূর্ণিপাক থেকে বেরিয়ে আসতে, নদীর তলদেশে হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু নদীর পাড়ে থাকা বালকেরা আমার কোমরে বেঁধে রাখা রশিটি তাদের সর্বশক্তি দিয়ে টানতে থাকায়, আমি নড়তে পারলাম না। আর ঘাবড়ে গেলাম! তবু, কিছুতেই নড়াতে পারলাম না নিজেকে। তাই স্রোতের বিপরীতে, আমার কোমরের যেদিক থেকে টান আসছিল—সেদিকেই হামাগুড়ি দেওয়ার চেষ্টা করা ছাড়া বিকল্প ছিল না আমার। মনে হলো যেন ঘণ্টার পর ঘণ্টার মারাত্মক ব্যথা আর দুর্নিবার আতঙ্ক শেষে, অবশেষে আমি ওপরের দিকে ভেসে ওঠতে থাকলাম। পানির ভেতর কিক মারতে থাকলাম সপাটে। উঠে দেখি, এবারও গ্রামের এই বালকেরা মুখ পাংশুটে আর চোখ পিরিচের মতো বড় বড় করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।
ওদেরকে এমন রোমাঞ্চের স্বাদ দেওয়ার কারণ একটা ছিল। আগেই যেমন বলেছি, তোয়োকাওয়া গ্রামে থাকাকালে শুধু বৃষ্টির দিনগুলোতেই আমাকে সকালের নাশতা সেরে, দুই স্তরের লাঞ্চবক্স সঙ্গী করে, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তে হতো না। ‘আকাশ ভালো থাকলে কাজ করো, আর বৃষ্টি থাকলে পড়তে বসো’—ঠিক এ প্রবচনটির মতোই জীবন ছিল আমার। যখন বৃষ্টি নামত, আমি হয় বই পড়তাম, নয়তো মনোযোগ না দিলেও হোমওয়ার্কে চোখ বুলাতাম। তখন আমি ব্যবহার করতাম ছোট্ট একটি রুম। শিনতো [জাপানি ধর্মবিশেষ] দেবদেবীদের জিনিসপত্র-অলা একটি শেলফ ছিল সেই রুমে। একদিন যখন পড়ছিলাম, বাড়িঅলা এসে দেব-দেবীর শেলফটির নিচে থাকা ড্রয়ার বা বুকসেলফ থেকে কিছু একটা বের করে বললেন, এটি নাকি কুরোসাওয়া-পরিবারের বংশতালিকা।
পরিবারপুঞ্জিটির দিকে তাকিয়ে একটি নাম দেখতে পেলাম আমি—আবে সাদাতো [১০১৫-১০৬২]—যিনি সেই জেনকুনেন যুদ্ধে শহিদ হয়েছিলেন, যার নামে একটি ট্রেন স্টেশনের নামকরণ করা হয়েছিল। তার নামের পর থেকে, বাড়তে বাড়তে একগুচ্ছ লাইন নেমে গেছে; তবে তৃতীয় নামটি ছিল—কুরোসাওয়া জিরিসাবুরো। এই নামটির পর থেকেই, ‘কুরোসাওয়া’ শব্দটি সহকারে একের পর এক নাম বেড়েই চলেছে। দৃশ্যতই আবে সাদাতোর তৃতীয় পুত্র— কুরোসাওয়া; ‘তিনপুত্রের মধ্যে সর্বশেষজন’—এভাবেই উল্লেখ করা ছিল তার নামটি। তিনিই ছিলেন আমার পরিবারের আদিপুরুষ। কুরোসাওয়া জিরিসাবুরো নামটি আমি এই প্রথমবার শুনলেও, আবে সাদাতো ছিল খুবই পরিচিত নাম। ইতিহাসের বইগুলোতে তার নাম জাপানের উত্তরাঞ্চলের একজন বিখ্যাত যোদ্ধা হিসেবে লেখা আছে। তার বাবা ছিলেন গেঞ্জি যোদ্ধা—ইয়োরিতোকি; আর তার ছোটভাই আবে মুনেতো রাজদরবারের আদেশ অমান্য করেছিলেন, এবং মিনামোতো ইয়োরিয়োশির সঙ্গে দিয়েছিলেন যুদ্ধে যোগ। সেখানেই মৃত্যু হয় তার। ঘটনা হলো, তিনি একজন রাজদ্রোহী ছিলেন, এবং যুদ্ধে হেরে মারা গেছেন—এ বিষয়টি খানিকটা মন খারাপের হলেও, তিনিই ছিলেন কুরোসাওয়া জিরিসাবুরোর বাবা। কেউ যদি আমাকে নিজের পূর্বপুরুষের নাম নিতে বলত, আমি সাদাতোর নামটিই নিতাম। ফলে কোনো-না-কোনোভাবে সাহসী হয়ে উঠতেই হলো আমাকে।
আমার এই নতুন পাওয়া সাহসই আমাকে ঝর্ণার সুড়ঙ্গে বেয়ে উঠে, পা হড়কে জলাশয়ে পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ানোর, আর এর পরে ঘূর্ণিপাকে সাঁতার কাটার দম জুগিয়েছে। এগুলো নিশ্চয়ই বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না। তবে এ ধরনের বোকামি করা সত্ত্বেও, গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে এসে সেবার এই যে আবে সাদাতোর বংশধর হিসেবে নিজের পরিচয় খুঁজে পেলাম, বিশেষত এই বিষয়টি অনেক বেশি বলবান করে তুলল আমাকে।
(চলবে)