গল্প পড়ার গল্প
গভীর দর্শনে পৌঁছে যান সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় যখন লিখতে আসেন তখন আমাদের সাহিত্যে হাস্যরস, তীর্যক চোখে চারপাশটিকে দেখা প্রায় মুছে গিয়েছিল। শিব্রাম অস্তমিত, কদিন বাদে তাঁর প্রয়াণ, পরশুরাম নেই, ত্রৈলক্যনাথ নেই। কোনো কোনো লেখকের গল্পে তীর্যকতা থাকে না যে তা নয়, কিন্তু তার চর্চা উঠেই গেছে। চারপাশের বৈসাদৃশ্যকে বিদ্রূপ, একটু বাঁকা চোখে না দেখার ভিতরে এই ধারাটি অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছিল। অথচ তা না হলে সাহিত্য তো ক্যারেক্টার সার্টিফিকেটের মতো নিষ্প্রাণ হয়ে থাকে। চারপাশের খুব গম্ভীর অনর্থকতাকে বিদ্রূপ করতে চাওয়া, তা খুব কঠিন। সবাই এটি পারেন না। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় পেরেছেন। সেই অবলুপ্তপ্রায় ধারাটিকে আবার গতিময় করে তুলেছিলেন একা। আমি এই লেখকের অতি গুণগ্রাহী।
বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনকে, নিরূপায় মানুষকে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় যেভাবে কাঁটাছেঁড়া করেছেন, তা তাঁর আগে হয়নি। আমি আগে যে তিন স্মরণীয় লেখকের নাম করেছি, তাঁদের পথে সঞ্জীব যাননি। তাঁরা তিনজন ছিলেন তিন স্বতন্ত্র দৃষ্টির অধিকারী। কেউ কারোর মতো নন। সবার ব্যঙ্গের ধার ছিল অসম্ভব।সঞ্জীবও স্বতন্ত্র লেখক। গুণবান। নানা ভাবে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারে প্রবেশ করে লুকোন অশ্রু খুঁজে বের করেছেন হাল্কা হাসির ভিতর দিয়ে, তীব্র হাসির মোড়কে। আমার মনে পড়ে সেই স্মরণীয় গল্প ‘শ্বেত পাথরের টেবিল’, ‘সোফা-কাম-বেড’–এর কথা। মনে পড়ে বঙ্কিম নামের এক ৩০ বছর দাম্পত্য করা এক পুরুষের কথা। তার পরিবারের কথা। তার ৩০ বছরের পুরোনো লেপ তোষকের মতো হয়ে যাওয়া দাম্পত্য। সঞ্জীব লিখতে লিখতে গভীর এক জীবন দর্শনে পৌঁছে যান। তাঁর গল্পের হাল্কা হাসি চোখের জল আমাকে এখনো স্নিগ্ধ করে।
চার্লির কথা মনে করিয়ে দেয়। আমি সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের যে জনপ্রিয়তা দেখেছি, তা ছিল বর্ণনাতীত। একজন লেখক লিখে কতটা জনপ্রিয় হতে পারেন? কলকাতা বইমেলায় তাঁর বই—‘হাল্কা হাসি চোখের জল’-এর জন্য দীর্ঘ লাইন, বই শেষ, তাঁকে স্পর্শ করার জন্য বহুজন দাঁড়িয়ে। আশীর্বাদ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন দুই বৃদ্ধা। কিন্তু সেই জনপ্রিয়তা এমন বইয়ের জন্য নয়, যা আসলে ফানুশ। এত বছর বাদেও সঞ্জীবকে পড়লে সেই পুরোনো অনুভূতিই ফিরে আসে। হাসতে হাসতে উদ্গত অশ্রু লুকোন। আবার নিজের ছাল-চামড়া ছাড়ানো চেহারাটি দেখে লুকিয়ে পড়া।
সঞ্জীব তাঁর লেখার ভিতরে এখন এক দার্শনিক প্রজ্ঞায় পৌঁছেছেন। আসলে যে জীবন আমরা যাপন করি তার টেরাবেকা দিকটার কথা বলতে বলতে দুঃখকে তিনি এমন গোপনে ছুঁয়ে যান যে আমি আমার হাড়-কঙ্কাল দেখতে পাই যেন। নিজেকে এমন ভাবে কী আর দেখা হয়? আমি তাঁর যে গল্পটির কথা বলব, সেই গল্পটি হাসির নয়। বেদনার। কিন্তু সঞ্জীবের লেখার যে তীর্যক ভঙ্গী, সেই ভঙ্গীর ভিতরেই তো তাঁকে দেখা যায় সারাক্ষণ। এখানে হাসতে চাইলেও পারি না, বেদনায় নুব্জ হয়ে যেতে হয়। গল্পটি ‘বত্রিশ নম্বর বিছানা’। এক সঙ্গীত শিল্পীর গল্প। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তিনি প্রধান এক পুরুষ।
এ গল্প আরম্ভ হয়েছে সেই সময়ে যখন রেডিওতে প্রকৃত গুণী উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের শিল্পীরা গাইতেন। কলকাতা ‘ক’-এ রাত ১০টার সময় কখনো কখনো বড়ে গোলাম আলীর কণ্ঠ শোনা যেত। উত্তম পুরুষে লেখা এই গল্পে কথক বলছেন তাঁর সেই গুণী ওস্তাদজীর কথা। তিনিও ছিলেন বেতারের এক নম্বর শিল্পী। বেতারই ছিল গান শোনার একমাত্র উপায়। ওস্তাদজীর গান আছে শুনলে গঙ্গার ধারে জমিদার বাড়ির একটি ঘরের জানালার পাশে লেখক দাঁড়াতেন অন্ধকারে। সেই ঘরে হল্যান্ডের মস্ত রেডিও বাজত। মনে আছে, রাগ মালকৌষ। তিন তাল। গুরুজী শঙ্করনারায়ণ বলতেন, মালকোষ হলো শ্মশানের রাগ। মধ্যরাতে সেই ভাবে গাইতে পারলে ভূত নামে।
আমি এই গল্প পড়তে পড়তে ক্রমশ ঢুকে গেছি মহাসঙ্গীতের ভিতর। কী চমৎকার আলাপে আলাপে শুরু হলো এই মাড়োয়া কিংবা মালকৌষ। সঞ্জীব নিজে যেন প্রবেশ করেছেন সঙ্গীতের অদ্ভূত আঁধারে আলোয়। বেদনায় আনন্দে। এক সাধক শিল্পীর জীবনের স্খলন, আর তারপর তাঁর ফিরে আসার প্রবল চেষ্টা, ব্যর্থতা নিয়ে এই গল্প। গল্প নয় এক অদ্ভূত জীবন নাট্য যেন বা। গল্প পড়তে পড়তে ধরা যায় তিনি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের গভীর থেকে গভীরে যেমন প্রবেশ করেছেন, তার সঙ্গে প্রকৃত শিল্পীর ( যেকোনো শিল্প) সারা জীবনের সংকটকে অনুভব করতে চেয়েছেন। কথাসাহিত্যিকই পারেন অন্য শিল্পের কথায় যেতে। গল্প কথক বলছেন, তাঁর মনে পড়ে ঠুংরি গাইবার সময় মাস্টারমশায়, ওস্তাদজীর চোখ দিয়ে জল ঝরত। এই গল্প আলাপে আলাপে ধীরে ধীরে প্রবেশ করে জীবনের অন্তঃস্থলে। এই যে ওস্তাদ শিল্পী, তার ছিল গান, অর্থ ছিল না। তিনি বলতেন, জাত শিল্পী না খেয়ে মরবে তবু অর্থ আর প্রতিপত্তির কাছে মাথা নোয়াবে না। সেই আত্মভোলা শিল্পীকে এক চিত্র পরিচালক তাঁর ছবির মিউজিক ডিরেকটর করলেন। ওস্তাদজীর স্ত্রীর মুখে হাসি ফুটল। সংসারের সুরাহা হবে। কিন্তু হল না। ওস্তাদজী সমঝোতা করেন নি। তাঁর ছিল শিল্পীর অহঙ্কার। তিনি চটুল সুরের দিকে যাবেন না। কিন্তু সেই ওস্তাদজী পা বাড়ালেন এক ভাড়াটে বউ-এর আগুনে। সে ছিল গা ঘিনঘিনে এক সুন্দরী। পা হড়কাল।
অনিলকুমার নামের এক ব্যর্থ নায়ক ছিল ওস্তাদজীর গুরুভ্রাতা। গান থেকে অভিনয়ে গিয়ে মদ আর ফুর্তিতে সব শেষ করে ওস্তাদজীর কাছে এসেছিল। ললিতা নামের চটুল রমনীকে সে-ই ডেকে আনে ওস্তাদজীর ঘরে। সে গান শিখতে এসে গুরুজির সব্বোনাশ করল। পতন শুরু হল। এমনই হল যে তাঁর সহধর্মিণী যিনি তাঁর পাশে থেকে সমানে যুদ্ধ করেছেন, শিল্পীর অহঙ্কারে নিজে গর্বিত হয়েছেন, তিনি বাধ্য হলেন ওস্তাদজী, তাঁর স্বামীকে ত্যাগ করে যেতে। ছেলেমেয়ে নিয়ে চলে গেলেন। সেই ললিতা, অনিলকুমার ওস্তাদজিকে শেষ করতে লাগল। সাধনার মন্দির হলো বাঈজি বাড়ি। নাচ গান আর মদ্যপান চলতে লাগল। তিনজনে মিলে ফিল্ম বানানোর পরিকল্পনা করলেন। ওস্তাদ শঙ্কর নারায়ণ আগেরবারে প্রত্যাখ্যাত হয়েছিলেন, তার শোধ তোলা হবে। সেই ছবির নায়ক অনিলকুমার আর নায়িকা ওই ললিতা। শঙ্কর-ললিতা প্রডাকশন্স। ডুবলেন ওস্তাদ শঙ্করনারায়ণ।
অনিলকুমার যেমন ব্যর্থ নায়ক, ব্যর্থ গায়কও। মদ আর ফুর্তি তাকে শেষ করেছে। তাদের ফিল্ম হয়নি। অনিলকে পুষতেন ওস্তাদজি। সেই গায়ক-নায়ক অনিল এক জায়গায় গান গাইতে গিয়ে হাসির খোরাক হয়। উদ্যোক্তারা তাকে দিয়ে অনুষ্ঠান করিয়ে কিছু পাইয়ে দিতে চেয়েছিলেন। হল না। এই গল্প এক শিল্পীর জীবনের গল্প। শিল্প থেকে বিচ্যুতি তাঁকে কোন অতল গহ্বরে নিয়ে গেল, সেই কাহিনি। কথক, শিল্পীর অনুরাগী মানুষটি এক প্রতিভার অপমৃত্যুর কথা বলছেন। সেই ওস্তাদজী মানুষটির কাছে তাঁর স্ত্রী ফেরত এসেছিলেন, কিন্তু সে ছিল এক অবর্ণনীয় পরিবার। তারা অন্য এক জায়গায় চলে গিয়েছিল। সেই বাসাবাড়ি খুঁজে খুঁজে গিয়ে জানা গেল তিনি হাসপাতালে।
হাসপাতালে বত্রিশ নম্বর বেডে পড়ে আছেন জীর্ণ হয়ে যাওয়া ওস্তাদ। অতবড় মানুষটি ভুগে ভুগে এইটুকু। কেউ দেখতে আসে না। বেহুঁশ মানুষটির পাশে এক গুচ্ছ ফুল রেখে চলে এলো তাঁর অনুরাগী। পরের দিন বেড ফাঁকা। আসলে সে মৃতের পাশেই গতকাল ফুল রেখে গিয়েছিল। পরে আবিষ্কার হয় তিনি নেই। অতবড় প্রতিভার শেষ আশ্রয় সেই বত্রিশ নম্বর বিছানা। এ এক মহৎ জীবনের দিশাহীন পরিভ্রমণের গল্প। গল্পের শেষ কয়েকটি চরণ মাথা নুইয়ে দেয়। সে নিজের ভবিষ্যতের কথা কল্পনা করে। সঞ্জীব আসলে জীবনের মহাসত্যকে উচ্চারণ করে গেছেন বারবার। এই গল্পে তা শিখর ছুঁয়েছে যেন।