মুক্তিযুদ্ধ, রবীন্দ্রগান ও বাঁধন ছেঁড়ার সাধ
বাংলাদেশের রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন একই লক্ষ্যকে সামনে রেখে পরস্পর হাত ধরাধরি করে চলেছে। একদিকে প্রতিক্রিয়াশীল অন্যদিকে প্রগতিশীল উভয় পক্ষই মুখোমুখি থেকেছে।বাঙালি জাতিসত্তার মূল সংগ্রামটা ঐতিহ্যের গোড়ায়। বিরোধীরা বারেবারে ওইখানে আঘাত হেনেছে, কখনো ঢেলে দিয়েছে বিষ। মূল থেকে বিচ্ছিন্ন করা, নতুন কোনো পরিচয়ে অভিহিত করাই ছিল উদ্দেশ্য।
১৯৭১সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, কবিগুরু- আপনি লিখেছিলেন-
সাতকোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী
রেখেছ বাঙালি করে-মানুষ করনি।
কবিগুরু, আপনার কথা মিথ্যে হয়ে গেছে, আপনার বাঙালি মানুষ হয়েছে।’ এই মানুষ হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।’
জেনারেল ইয়াহিয়া পার্লামেন্টের পহেলা মার্চের অধিবেশন বাতিল করলে দেশেপ্রতিবাদের ঝড় ওঠে। গঠিত হয় বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ। রাস্তায়, মোড়ে, শহীদ মিনারে শিল্পীরা গাইতে আরম্ভ করে জাগরণের গান- ও আমার দেশের মাটি, এখন আর দেরী নয় ইত্যাদি। তেসরা মার্চ ছায়ানট শহীদ মিনারে পাকিস্তানকে চূড়ান্ত প্রত্যাখ্যান জানাল গানে গানে, আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে... বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন এক হউক,এক হউক,হে ভগবান’ ইত্যাদি।
কেউ বলে দেয়নি, প্রবাসী সরকারের কোনো নির্দেশ ছিল না, তবু মানুষের মুখে মুখে সেই দারুণ দুর্দিনে যে গান উঠে আসে, তা রবীন্দ্রনাথের-‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’
চারদিকে যখন গুলি চলছে, বোমা ফাটছে, নিরস্ত্র মানুষের হাহাকার আকাশ ভরিয়ে দিচ্ছে তখন মাটির সঙ্গে এক হয়ে যাওয়া মানুষের কণ্ঠ হতে এই গান গুঞ্জরিত হয়ে ওঠে। ভুল সুরে, ভুল উচ্চারণে পথেঘাটে, ছেলেবুড়ো, নারীপুরুষ সবার মুখে মুখে এই গান ফেরে- তাদের সাহস দেয়,শক্তি দেয়। মুক্তিবাহিনীর কৃষক শ্রমিক ছাত্রের সাধারণ কন্ঠের সেই গানকেই শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিলেন।
বৈরী পরিস্তিতির কাছে মার খেয়ে বাঙালীয়ানার দৃপ্ত চৈতন্যে ঐকান্তিকভাবে বলীয়ান হয়ে গান ধরলেন কণ্ঠসৈনিক। স্বাধীনতার প্রাক্কালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিশেষত শহীদ মিনারে বার বার গাওয়া হয়েছে-ও আমার দেশের মাটি, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, সার্থক জনম আমার, বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই মরতে হবে ইত্যাদি আশাজাগানিয়া রবীন্দ্রসংগীত।
বিদ্রুপভরা তিরস্কারে পিছু হটবার ভাব সম্পর্কে নিজেদের এবং সাধারণ বাঙালিকে সাবধান করে গাওয়া হয়েছে- যদি তোর ভাবনা থাকে ফিরে যা না।
শক্তি সন্ধানের গান- সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ...
শুভ কর্মপথে ধর নির্ভয় গান...
ভাঙনের জয়গান- ভাঙো বাঁধ ভেঙে দাও...
আশ্বাসের গান- নাই নাই ভয়, হবে হবে জয়...
নিশিদিন ভরসা রাখিস...ইত্যাদি
বিধির বাঁধন কাটবে তুমি, যে তোমায় ছাড়ে ছাড়–ক, ফিরে চল মাটির টানে- এসব কালোপযোগী গান গণআন্দোলন জাগিয়ে বাংলার আকাশ বাতাস ভরে তুলেছে।
একাত্তরের বিভীষিকায় যখন দেশ ছেড়ে পালাতে হলো, তখন আমাদের শিল্পীরা গাইলেন- দেশে দেশে ভ্রমি তব দুখগান গাহিয়ে। গাইলেন- সুখহীন নিশিদিন পরাধীন হয়ে/ভ্রমিছ দীনপ্রাণে। পরিবেশ পরিস্থিতি রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদেরকে অমোঘভাবে টেনে নিয়ে গিয়েছিল আন্দোলনের পথে। সেদিনকার গানের দল শুধু এপার বাংলা নয়, ওপার বাংলার আনাচে-কানাচে তো বটেই- বাংলার বাইরে গিয়েও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি মানুষের সমর্থনের মনোভাব গড়ে তুলেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়ে দেশের গান গেয়ে তাদের মনোবল অক্ষুণ্ণ রাখা, শরনার্থীদের দুর্দশার দিনে আশার সুর শোনানো, গান গেয়ে সাধারণ মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করা, জনসচেতনতা বাড়ানো, অর্থ সংগ্রহ, ইত্যাদি বহুমাত্রিক অংশগ্রহণে সেদিনকার রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীরাও হয়েছিলেন এক একজন মুক্তিযোদ্ধা।
বাংলাদেশের কবি জিয়া হায়দার রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে একটি কবিতায় লিখেছেন, ‘আমার চৈতন্যে তুমি ঈশ্বরের মতো’। এটি শুধু একটি কবিতার লাইন নয়, এটি একটি গভীর বিশ্বাস।এভাবেই রবীন্দ্রকীর্তি আমাদের মননের চর্চা সমৃদ্ধ করেছে বারে বারে, বাড়িয়েছে আত্মবিশ্বাস।
সহায়ক গ্রন্থপঞ্জী :
স্বাধীনতার অভিযাত্রা, ড. সন্জীদা খাতুন
রবীন্দ্রনাথের হাতে হাত রেখে, ড. সন্জীদা খাতুন
অনুত্তম বক্তব্য, সন্তোষ গুপ্ত
অতলের আঁধি, হাসান আজিজুল হক