কন্যার কলমে পিতা
হুমায়ুন আজাদ, ভেতর-বাহিরে
আমার বাবা হুমায়ুন আজাদ আজ ১১ বছর হলো আমাদের মাঝে নেই। ঘাতকদের হাতে অকালমৃত্যুর কারণে বাবার সঙ্গে জীবনের ২৭টি বছর কাটাতে পেরেছি মাত্র। আমি জানি, পাঠকের তাঁর জীবনযাপনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তাই তাঁকে নিয়ে লিখতে আবারো আমি বসলাম। জানি না, পাঠকের কৌতূহল কতটা মেটাতে পারব। অনেকেরই ধারণা, হুমায়ুন আজাদ বোধ হয় অতটা পারিবারিক মানুষ ছিলেন না। আমার মনে হয়, তিনি হয়তো আট-দশ সাধারণ মানুষের মতো দৈনন্দিন জীবন বা পালাপার্বণ উদযাপন করতে চাইতেন না, আর কী! যেমন ঈদের কথা বলতে পারি (কারণ এটাই আমাদের প্রধান উৎসব)। বাবাকে কখনো আমি ঈদ নিয়ে খুব বেশি উচ্ছ্বসিত হতে দেখিনি। ঈদের দিনও তিনি প্রতিদিনকার মতো তাঁর সকাল শুরু করতেন। লাল চা ও মুড়ি ছিল তাঁর প্রাত্যহিক দিনের মতো সেদিনেরও সকালের খাবার। পত্রিকা পড়তেন। সকাল থেকেই অনেকে ফোন করে তাঁকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতেন। সানন্দে শুভেচ্ছা গ্রহণ করতেন। কিন্তু তিনি নিজে কাউকে ফোন করে ঈদ মোবারক বলছেন, তা আমার কানে আসেনি। ঈদের দিন সকালে আমার মায়ের রান্না সেমাই-ফিরনি ও চটপটি বেশ আগ্রহ নিয়েই খেতেন। সকালের খাবার শেষ করে ঢুকতেন তাঁর ছোট পড়ার ঘরে। তাঁর পড়ার রুমে টেবিল আর র্যাকেই শুধু বই থাকত না, মেঝেতেও বই ছড়ানো থাকত। বাসার এ রুমটাতেই তিনি বেশির ভাগ সময় কাটাতেন। আমরা যেখানে ঈদের দিন বইপত্র না খুলতেই বেশি আগ্রহী ছিলাম, সেখানে তিনি ছিলেন উল্টো। সেদিনও নানা বিষয়ের ওপর বই পড়তেন আর লিখতেন।
ঈদের দিন বলেই সকালে গোসল করে সুরমা লাগিয়ে পাঞ্জাবি পরে বাইরে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অন্যান্য শিক্ষকের সঙ্গে কোলাকুলি করতে আমি দেখিনি তাঁকে। হয়তো তিনি লিখছেন, এমন সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাদের বাসায় আসতেন। তাঁরা বলতেন, ‘কই, সাহিত্যিক সাহেব কোথায়?’ বাবা খালি গায়ে পড়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে শোবার ঘরে যেতেন। একটা হাফশার্ট গায়ে জড়িয়ে বৈঠকখানায় এসে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতেন। তাঁদের অনুযোগ ছিল, আজো আপনি লিখছেন? কোথায় আজ এবাড়ি-ওবাড়ি যাবেন, তা নয় আপনি...। বাবা কিছু বলতেন না। শুধু একগাল হাসতেন। দুপুরে গোসলে যেতেন। এর মাঝেই আমার মায়ের দুপুরের রান্না হয়ে যেত। আমরা তিন ভাইবোন প্রায়ই বাসায় থাকতাম না। তিনি আমাদের ছাড়া খেতেন না। খোঁজ পাঠাতেন, আমরা কোথায়? ঘরে ফিরতাম। পাঁচজন খাবার টেবিলে একসঙ্গে খেতে বসতাম। পোলাও, ভুনা মাংস, কাবাব, কৈ মাছসহ সব পদের মাংস তিনি তৃপ্তিসহকারে খেতেন। খেতে খেতে শুনতাম তাঁর ছেলেবেলার ঈদের গল্প। ছেলেবেলায় ঈদের দিন নাকি খেজুরের গুড়ের পায়েস খেতেন। সেই খেজুরের গুড় কীভাবে তৈরি হতো, গুড়ের ঝোল কীভাবে চেটেপুটে খেতেন, তার রসাত্মক বর্ণনা দিতেন। তাঁর বর্ণনা শুনে জিভে জল এসে যেত। ছেলেবেলায় আমাদের মতো সব ঈদে নতুন জামা না পেলেও প্রায় ঈদেই জামা পেতেন তিনি। ছেলেবেলায়ও তিনি ঈদের দিন বই পড়তেন। এটা অবশ্য আমাদের ঈদের দিন পড়ার জন্যই একটা ইঙ্গিত ছিল। আমরা তিন ভাইবোন তাঁর এ কথা শুনে মাথা চুলকাতাম কেবল। বাবাকে বলতাম, সে সময়ের বন্ধুদের সঙ্গে কোথাও বেড়াতে যেতে; কিন্তু তিনি বলতেন, ‘না’। তবে ঈদের দিন তাঁর নানাবাড়ি কামারগাঁওয়ে যেতেন। সেখানে যাওয়া ছিল তাঁর বিশেষ পছন্দ। ভালো ছাত্র ছিলেন বলে নানাবাড়ির সবাই তাঁকে নাকি খুব পছন্দ করত। সালামি হিসেবে তাঁকে কয়েক পয়সা দিত। সেই পয়সা দিয়ে ভাগ্যকূল বাজারে গিয়ে তিনি লেবেঞ্চুষ আর কুকিজ কিনে খেতেন। ভাগ্যকূলে পদ্মার পাড়। পদ্মার পাড়ে বসে পদ্মার ঢেউ দেখতেন। তিনি যখন এসব বলতেন, বোঝাই যেত কতটা আনন্দ পেতেন ছেলেবেলায় তিনি। আমরা যারা শহুরে মানুষ, ফাস্টফুড দোকানে বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ করে খাওয়াটাকেই ঈদের আনন্দ বুঝি। পদ্মার পাড়ে কিশোর বয়সে একা ঢেউ দেখে সুখ পাওয়া কীভাবে সম্ভব, তা আমি বুঝতে পারতাম না। তাঁর কথা শুনে তাঁর মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতাম। খাওয়া আর গল্পের মাঝেই আমরা তিন ভাইবোন তাঁর পা ছুঁতাম। তিনি হেসে প্রত্যেককে ৫০০ টাকা করে সালামি দিতেন। এ রেট কখনো বাড়ত বা কমত না। ভীষণ খুশি হতাম আমরা।
অন্যান্য দিন দুপুরে ঘুমালেও ঈদের দিন দুপুরে তিনি ঘুমাতেন না। বাবার জন্য ঈদের পাঞ্জাবি আমাদের মা-ই কিনতেন। দুপুরে খাবার পর সেই পাঞ্জাবি পরে বাসা থেকে বের হতেন। তিনি কোনো আত্মীয়ের বাসায় যেতেন না। বাসা থেকে বের হলেই তাঁর হয়তো রাস্তায় দেখা হয়ে যেত কোনো তরুণ ভক্তের সঙ্গে (তিনি তরুণদের সঙ্গই বেশি পছন্দ করতেন)। তাদের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতেন শাহবাগ/সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। ঈদের দিনও তাঁদের আড্ডার বিষয় ছিল দেশের অবস্থা আর তাঁর লেখালেখিই। বাবা তাঁর প্রিয়তমা বাংলাদেশকে এত বেশি ভালোবাসতেন যে দেশের খারাপ অবস্থা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। দেশের সংকট মুহূর্তগুলো তাঁকে প্রচণ্ড পীড়া দিত। তাই আমি দেখেছি, ঈদের দিনও তাঁর আলোচনার বিষয় ছিল বাংলাদেশ। বাঙালির কুসংস্কার, বাঙালির অসততা, চাতুর্য, ধর্মান্ধতা তিনি পছন্দ করতেন না। তাই এসব তাঁর আলোচনায় বারবার উঠে আসত। মাঝেমধ্যে ঈদের দিন এসব আলোচনায় বিরক্ত হতাম। তবে তাঁকে কখনো এসব আলোচনা থেকে নিবৃত্ত করতে পারিনি।
বিকেলে তরুণদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাতে বাসায় ফিরে দেখতেন, আমরা টিভির ঈদ প্রোগ্রাম দেখা নিয়ে ব্যস্ত। তাঁকে জানিয়ে দিতাম, আমাদের দেখা শেষ হলেই কেবল তিনি টিভির রিমোট হাতে পাবেন। আমাদের ছেলেমানুষি দেখে হাসতেন তিনি। তাঁর হাতে যখন রিমোট যেত, তিনি প্রতিদিনকার মতো বিবিসি/জিওগ্রাফি চ্যানেলে চোখ রাখতেন।
কোরবানির ঈদের সময় দেখতাম, তাঁর কোরবানির গরু-ছাগল কেনার প্রতি খুব বেশি আগ্রহ নেই। কিন্তু আমাদের অতি উৎসাহের কারণে চাঁদরাতে তিনি রাস্তা থেকে ছাগল কিনে আনতেন। বাসার বারান্দায় ছাগল বাঁধা থাকত। আমার ছোট দুই ভাইবোনের ছাগল নিয়ে আনন্দের অন্ত থাকত না। বাবা ওদের আনন্দ উপভোগ করতেন। কোরবানির ঈদে দুপুরে বাবার সঙ্গে বসে সদ্য রান্না হওয়া টকটকে ঝাল গরুর মাংস রুটি দিয়ে খেতাম। মাংসে চর্বি ভাসত। দেখে লোভ লাগত। খাবো কি খাবো না, ভাবতাম। বাবা বলতেন, ‘আরে এত চিন্তা করছিস কেন, এ বয়সে খেলে কিছু হবে না।’ সঙ্গে সঙ্গে মাংসের চর্বিও পাতে নিতাম আর মনের সুখ মিটিয়ে খেতাম। সত্যি, কী যে দিন ছিল সে সময়! এখন ঈদে খাবার টেবিলে রান্না হওয়া মাংস দেখলে শুধু তাকিয়ে থাকি। মনে হয়, বাবা যেন হাসতে হাসতে আমার প্লেটে চর্বিসহ মাংস তুলে দিচ্ছেন।
তিনি দেশের বাইরে যেতে পছন্দ করতেন না। তাই দেশের বাইরে তাঁর সঙ্গে কোনো ঈদ উদযাপন করা হয়নি। দুবার তাঁর সঙ্গে ঢাকার বাইরে ঈদ করেছিলাম। প্রথমবার করেছিলাম তাঁর প্রিয় নিজগ্রাম রাঢ়িখালে। তাঁকে সে ঈদেই আমার বেশি স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন বলে মনে হয়েছে। গ্রামের বাড়ির উঠানে ঈদের দিন বসেছিলেন তিনি। অন্য বাড়ির বয়স্ক লোকেরা যখন আমাদের বাড়ির উঠান পেরিয়ে যাওয়ার সময় বাবাকে দেখতে পেয়ে ডাক দিতেন, ‘ও হুমায়ুন, ঈদ করতে গ্রামে আসছেন?’ তখন তাঁর চোখেমুখে আনন্দের ঝিলিক দেখেছিলাম। মনে হয়েছিল, তিনি সেই রাঢ়িখাল গ্রামের বালক হুমায়ুন হয়ে গেছেন। দ্বিতীয়বার কোনো এক কোরবানির ঈদে আমরা সবাই মিলে কক্সবাজার গিয়েছিলাম। কোরবানির ঈদ বলে বাবা সেখানে গিয়ে বললেন যে কয়দিন এখানে আছি, কেউ মাংস খেতে পারবে না। মাছ খেতে হবে। আমাদের আবার মাছে অনীহা। তাই কক্সবাজারে থাকাকালে খাওয়া নিয়ে কী যে ঝামেলায় পড়েছিলাম!
আজ এসব সবই স্মৃতি। মাঝেমধ্যে বিশ্বাই হয় না যে এসব দিন আর ফিরে আসবে না। বাবাকে এত তাড়াতাড়ি হারিয়ে তাঁকে নিয়ে ঈদের স্মৃতিচারণ করতে হবে, তা ভাবলেই সবকিছু এলোমেলো লাগে।
ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে হুমায়ুন আজাদ প্রসঙ্গ এলেই যে টার্মটি আসে তা হলো, প্রথাবিরোধী হুমায়ুন আজাদ। সত্যিকার অর্থেই তিনি কোনো একটা বিশ্বাসে আবদ্ধ হতে চাননি। তবে কোনো বিষয়ে তিনি যদি দ্বিমত পোষণ করতেন, তাহলে সেটা অবশ্যই যুক্তি দিয়ে করতেন। কোনো একটা মিথে তিনি গণ্ডিবদ্ধ থাকতে চাননি কখনো। বাবা যদি কোনো বিশ্বাসে বিশ্বাসী না হতেন, তবে সেটা ভাঙতে চাইতেন প্রচণ্ডভাবে। এ জন্য আমি বাবার সঙ্গে অনেককে তুমুল তর্ক করতে দেখেছি। আমার মা-বাবার বিয়েটাও হয়েছিল অনেকটা প্রথার বাইরে। টেলিফোনে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। যেটা সে সময় অতটা প্রচলিত ছিল না। বাবা লেখার স্বার্থে তাঁর পিতৃপ্রদত্ত নাম হুমায়ুন কবীর বদলে হুমায়ুন আজাদ হয়েছিলেন। প্রথাবিরোধী হলেও সমাজবাস্তবতায় তিনি প্রথার মধ্যেই ব্যক্তিগত জীবন কাটিয়ে গেছেন। অবশ্য এ সমাজে প্রথার মধ্যে জীবনযাপন না করলে বেঁচে থাকাটা অসম্ভব বৈকি!
হুমায়ুন আজাদ নামটি উচ্চারিত হলেই অনেককে বলতে শুনেছি, হুমায়ুন আজাদ নাস্তিক। মেয়ে হিসেবে এ কথা শুনতে আমার বেশ খারাপ লাগে বৈকি। আস্তিক/নাস্তিক হওয়ার বিষয়টি প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিষয় বলেই আমি মানি। তিনি নিজে ধর্মকর্ম করতেন না ঠিক; কিন্তু অন্যকে ধর্মকর্ম করতে পারবেন না বলেও হুমকি-ধমকিও দিতেন না। আমি সব সময় নামাজ পড়ি। এ ক্ষেত্রে আমি তাঁর সঙ্গে সারা জীবন থেকেও বাধার সম্মুখীন হইনি। কাউকে জোরপূর্বক কোনো কাজ করানোর চেয়ে স্বাধীনতা দেওয়াও কি কাম্য নয় সবার কাছে?
বাবাকে আমার অন্য সবার চেয়ে ব্যতিক্রম লাগত তাঁর সাহসের জন্য। সুবিধাবাদী সমাজে সবাই যেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থের কথা চিন্তা করে অন্যায় দেখেও মুখ খুলব না বলে পণ করি, সেখানে তাঁর যেন কাউকে তোয়াক্কা না করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মন্তব্য করতেই হবে। অনেক সময় তাঁকে বলেছি, তুমি এমন কেন? তিনি বলতেন, তাঁর কারো কাছে কোনো কিছু চাওয়ার নেই। তিনি যা করবেন, তা নিজেই করবেন। কারো কথা চিন্তা করে কিছু বলেন না তিনি। তাই বাবার চারপাশে সাংবাদিকরা থাকত সব সময়। শামসুন নাহার হলের ছাত্রীদের ওপর যে বছর আক্রমণ হয়, আক্রমণের পরে বাবার নেতৃত্বে শিক্ষকরা কারাগারে ফুল নিয়ে গিয়েছিলেন। আজ নারীর ওপর প্রকাশ্যে হাজারও মানুষের মাঝে আক্রমণ দেখার পর কতজনই বা আমরা মুখ খুলছি? এসব দেখলে বারবার তাঁর কথা মনে হয়। মনে হয়, সাহিত্যের জন্য নয়, কেবল সত্য উচ্চারণের জন্যও এ মানুষটার এ সময়ে দরকার ছিল। মেয়ে হিসেবেও তাঁর ঠোঁটকাটা নানা মন্তব্যের জন্য মাঝেমধ্যে অনেকের কাছে অপ্রস্তুত হতাম। কিন্তু তাঁর ঠোঁটকাটা কথা থামাতে পারিনি।
অনেককেই বলতে শুনেছি, হুমায়ুন আজাদ বিতর্কিত কথা বলে নিজেকে ফোকাস করতে চান। বাবা বেঁচে থাকতে আমার নিজেরও তা মনে হতো। কিন্তু আজ মনে হয়, সত্যি কি তাই? এতটা ঝুঁকি নিয়ে কথা বলতে কি আমরা সবাই পারি? তাঁর বইয়ে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সত্য তুলে ধরায় তিনি নিজ জীবনটাও তো দিয়ে গেছেন। তাঁর ওপর আক্রমণ হওয়ার পর বাংলার মানুষের ক্ষোভে ফেটে পড়ার কারণ তো একটাই ছিল, তাঁর সাহসী উচ্চারণ, তাই নয় কি? সুবিধাবাদী পা-চাটা কারো জন্য কি এই বাংলার মানুষের বুকের মধ্যে এতখানি ভালোবাসা থাকত? আহত হওয়ার পর যে অল্প সময় তিনি বেঁচে ছিলেন, তাঁর জন্য উত্তাল বাংলার কথা আমি তাঁকে বলেছি। তিনি মুখে কিছু বলেননি। শুধু তাঁর আক্রান্ত চোখের এক কোনো দিয়ে জল পড়তে দেখেছি কেবল। একজন ঠোঁটকাটা মানুষের শত্রু থাকবে, এটাই ভেবে নিয়েছিলেন বোধ হয়। কিন্তু মিত্ররা...। সবকিছু যে এখনো নষ্টদের কবলে যায়নি।
তাঁকে আমি কোনো কাজে ইতস্তত বোধ করতে দেখিনি। আমাদের সমাজে উঁচুতলার লোকেরা নির্দিষ্ট কিছু কাজ করবেন বলেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকেন যেন। পাছে গণ্ডির বাইরে কাজ করলে যদি তাদের মান যায়, সেই ভয়ে। কিন্তু তার মধ্যে সেসবের বালাই ছিল না। একটা উদাহরণ দিই। আমরা বহু আগে আজিমপুরে ভাড়া বাসায় থাকতাম। সেই বাসার ছাদে প্রায়ই কে যেন মল ত্যাগ করে যেত। দুর্গন্ধে আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারতাম না। ওই বাসার কাউকে এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখিনি। বাবা একদিন নিজেই তা পরিষ্কার করতে গেলেন...তখন সবাই তার পিছ নিল। একজন সুইপার ডাকলেই ঝামেলা চুকে যেত...কিন্তু তিনি নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে এ কাজ করে ভদ্রসমাজের মুখে বলা যায় একপ্রকার চপেটাঘাত করেছেন।
তিনি সারা দিন পড়াশোনা করতেন। লিখতেন। অধ্যাপনার বাইরে বই লেখা ছিল তাঁর একমাত্র কাজ। বাবাকে আমি কখনো কোনো কনসালট্যান্সি/বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর জন্য উদগ্রীব দেখিনি। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সঙ্গে ক্লাবে বসে আড্ডা দেওয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতি করা এসব ছিল তাঁর রুটিনের বাইরে। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় থাকার সময় দেখতাম, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা ইউনিভার্সিটি পলিটিক্স ভীষণভাবে এনজয় করেন। তিনি পলিটিক্সের ধারেকাছেও ছিলেন না। তার পরও একবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য শিক্ষদের অনুরোধে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিলেন। বাসায় আমরা সবাই তাঁকে বলতাম, তুমি কারো সঙ্গে মেশো না, কারো স্তুতি করো না, তোমাকে কে ভোট দেবে? বাবা হাসতেন। এবং যথারীতি বাবা নির্বাচনে হারেন। নির্বাচনে হেরে হাসতে হাসতে বাসায় আসেন... নির্বাচন নিয়ে মজা করেন, আমাকে উত্তেজিত দেখে আরো বেশি করে হাসেন এবং তার পর যথারীতি তাঁর পড়ার রুমে গিয়ে পড়তে বসেন।
তিনি সাহিত্যের সব শাখাই বলতে গেলে লিখেছেন। কিন্তু নাটক লেখায় ছিল তাঁর অনীহা। আমার আবার নাটক দেখার নেশা। তাঁকে প্রায়ই বলতাম তুমি নাটক লিখো...তোমার লেখা নাটক টিভিতে দেখতে ইচ্ছা হয়। তিনি বললেন, নাটক আমি লিখব না। নাটক মানেই মিথ্যা কোনো কিছুকে উপস্থাপন করা...তাই নাটক লেখার ইচ্ছা আমার নেই।
আশ্চর্যজনকভাবে বাবার মৃত্যুর পর তাঁর পাক সার জমিন বইয়ের ঘটনা কেন্দ্র করে মঞ্চে নাটকও হয়েছে।
তাঁকে আমি কখনো ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে কথা বলতে দেখিনি। ইংরেজি পারতপক্ষে বলতেন না। আমার সবচেয়ে মজা লাগত, বাবা টেলিফোন নম্বরগুলো পর্যন্ত বাংলায় লিখতেন ও পড়তেন। এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আমরা হাসতাম। তিনি বাংলার অধ্যাপক হলেও পিএইচডি করেছিলেন কিন্তু ইংরেজিতে। তাঁর প্রতিটি বইয়ের নাম চমৎকার বাংলায়। কিন্তু তিনি আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নিয়ে একটি বই লিখতে চেয়েছিলেন। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমার আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা নিয়ে একটি বই লিখব। সে সময়ের পত্রিকাগুলো গোছাও। তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বইয়ের নাম কী দেবে? তিনি বললেন, মৃত্যু থেকে এক সেকেন্ড দূরে। বললাম, সেকেন্ড তো ইংরেজি শব্দ। তিনি বললেন, সেকেন্ড শব্দটি না দিলে বইয়ের নামটি আকর্ষণীয় হবে না। এখানে ইংরেজিই প্রযোজ্য।
বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন, পরিপূর্ণ স্বাধীন জীবনযাপন করে গেছেন। তাঁর যা ভালো লাগত, তিনি তা-ই করতেন। পরিপূর্ণ জীবনযাপন যাকে বলে। প্রচুর ধূমপান করতেন তিনি। মানা করেছি দুই-একবার। শোনেননি। এমনকি থাইল্যান্ডে চিকিৎসা করে দেশে ফিরে আসার পরও তিনি নিয়মিত ধূমপান করতেন। বেশ বাধা দিয়েছিলাম তখন। লাভ হয়নি। তিনি বলতেন, এটা আমার নতুন জীবন। বাধা দিস না। উপভোগ করে নিই।
তিনি নিজে যেমন নিজের স্বাধীনতা ভোগ করতেন, আমাদেরও তা দিতেন। বড় হয়ে নয়, ছোটবেলা থেকেই তাঁর কাছ থেকে পেয়েছিলাম সব কাজের পূর্ণ স্বাধীনতা। মাঝেমধ্যে মনে হ,য় স্বাধীনতার মাঝে বড় হলে জীবনে ঝড়-তুফান এলেও ভেঙে না পড়ে নিজে থেকে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রচেষ্টা চালানো যায় বোধ হয়। আমাকে স্বাধীনভাবে বড় হতে দেওয়ার জন্য তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ আমি।
স্বাধীনতার পাশাপাশি বাবা আমাদের দুই বোনকে সব সময় স্বাবলম্বী হতে তাগিদ দিতেন। যেখানে অন্য বাবারা মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করেন, সেখানে বাবাকে এ বিষয়ে কখনো চিন্তা করতে দেখিনি। তাঁর কথা ছিল, তোমরা আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করো। এতেই মুক্তি পাবে। স্বামী আর বাবার রেখে যাওয়া সম্পদে হয়তো সাময়িক আনন্দ পাওয়া যাবে, কিন্তু নিজের মনোবলটা শক্ত হবে না। তাই তাঁর কাছে পেতাম নিজের পায়ের মাটি শক্ত করার তাগিদ।
তাঁকে আমি কখনো অর্থ চিন্তা করতে দেখিনি; বরং দেখেছি কোনো পার্টিতে গেলে সবাই যখন তাঁদের বাড়ি-গাড়ির ফিরিস্তি দিতেন, তখন তিনি হাসতেন। বাবার মতো এসবে এতটা নিরাসক্ত হতে পারিনি দেখে তাঁকে বলতাম, তুমি হেসো না। এসবের দরকার আছে। তুমি যখন থাকবে না, তখন আমাদের কী হবে? আমাদের জন্য কী রেখে যাবে?
বাবা একদিন এ প্রসঙ্গে বললেন, যা রেখে যাব, তা দিয়ে চলে যাবে বেশ। তখন এ কথার মর্মার্থ বুঝতে পারিনি। কারণ, দৃশ্যমান কোনো বিষয়আশয় চোখে পড়েনি। এখন বুঝি। সেই জিনিসটা হলো তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসা আর সম্মান। তিনি মারা যাওয়ার পর আমি যখন যেখানে কোনো কাজে গেছি, সেখানে বাবার প্রসঙ্গ এলেই সবার চোখে-মুখে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা/ভালোবাসা দেখেছি। অনেকে আমাকে দেখে তাঁর কথা মনে করে কেঁদেও ফেলেন। সবাই বাবাকে স্যার বলেন। এ রকম বাবার মেয়ে বলেই হয়তো আমার অনেক কাজ সহজেও হয়ে গেছে। আসলে সব সময় অর্থ লাগে না, ভালোবাসাতেই কাজ হয় বোধ হয় বেশি।
বাবা অর্থের পেছনে ছিলেন না, তাই অর্থ যেন তাঁর কাছ থেকে বারবার ফসকে যেত। এ প্রসঙ্গে দুটো কথা। বাবা বাংলা একাডেমির পুরস্কার পেয়ে প্রথম কালার টিভি কেনেন। দুর্ভাগ্য, আমাদের সেই কালার টিভিটি কেনার কিছুদিন পরই চুরি হয়ে যায়। বাবা কখনো ঢাকায় অ্যাপার্টমেন্ট কেনা পছন্দ করতেন না। কারণ, তাঁর নাকি ঢাকার অ্যাপার্টমেন্টগুলোকে খুপরিঘরের মতো লাগে। শুধু একের পর এক তলা উঠেছে বলে তাঁর মনে হত। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি হঠাৎ করে ১০ তলায় একটি অ্যাপার্টমেন্ট বুকিং দিয়ে বসেন। সেই অ্যাপার্টমেন্টে একটি রুম হবে তাঁর পড়ার রুম, সেই রুমটা কেমন হবে সে বিষয়ে মনে মনে কিছুটা প্ল্যানও করেছিলেন বোধ হয়। কিন্তু এখানেও বিধিবাম! তাঁর বই বিক্রির টাকা দিয়েই অ্যাপার্টমেন্ট হয়ে গেছে। কিন্তু তিনি নিজে একদিনের জন্যও থাকতে পারেননি সেখানে। তিনি নেই। অ্যাপার্টমেন্ট হয়েছে। তাঁর পড়ার রুমে তাঁর লেখা সব বই আছে (বইয়ের ওপরে কিছুটা ধুলোর আস্তরও পড়েছে) তাঁর বদলে পড়ার রুমে ঝুলছে তাঁর মস্ত বড় প্রতিকৃতি।
তিনি আহত হওয়ার পর যে কয়টা দিন বেঁচেছিলেন, তখন আমার তাঁকে ভেতরে ভেতরে অস্থির মনে হতো। যেন মনে হতো অনেক লেখা তাঁর বাকি। তিনি অসুস্থতার মধ্যেও লিখতে চাইতেন। পারেননি। আমাদের নিয়েও সে সময় তাঁকে উদ্বিগ্ন দেখতাম। শারীরিক ও মানসিকভাবে বেশ বিপর্যস্ত ছিলেন। বইমেলা থেকে বের হওয়ার পথে তাঁর সারা জীবনের জায়গা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি বোধ হয় ভেতরে ভেতরে মেনে নিতে পারেননি। শারীরিকভাবে বির্পযস্ত থাকলেও তাঁর মূল চিন্তার জায়গায় কিন্তু ফাটল ধরেনি। সে জায়গায় আগের মতোই অনড় ছিলেন। তিনি আক্রান্ত হওয়ার পর টিভির ফুটেজে দেখেছি তাঁর সারা শরীরে রক্তের বন্যা। পুলিশ তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে চাইছে, কিন্তু তিনি পুলিশের গাড়িতে উঠবেন না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। শারীরিক কষ্ট তাঁর মাথা ওলটপালট করতে পারেনি। মনে পড়ে, সিএমএইচ হাসপাতালে তাঁর জ্ঞান ফেরার পর প্রথম কথা ছিল, আমি বইমেলায় যাব।
এতটা শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যে আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মাথায় এ চিন্তা আদৌ আসত কি? আক্রান্ত হওয়ার পর তিনি দুজন পুলিশ পেয়েছিলেন। অন্যরা পুলিশ পেলে হয়তো স্বস্তি পান, বাবাকে দেখেছি উল্টো। তাঁকে দেখে মনে হতো, পুলিশ প্রহরায় তিনি নিরাপদ বোধ করছেন না। তাঁর মধ্যে সারাক্ষণ চিন্তা ছিল, আর কোনো দিন কি তিনি আগের মতো মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারবেন না?
তাঁকে আমি বলেছিলাম, তোমাকে যারা পেছন থেকে আক্রমণ করেছিল, তাদের দেখা পেলে কী করবে তুমি? তিনি আমার প্রশ্নে হেসেছিলেন। কোনোরকম প্রতিশোধস্পৃহা দেখিনি তাঁর চোখে।
জানি, জার্মানিতে বাবার হঠাৎ মৃত্যু নিয়ে তাঁর ভক্ত-পাঠকের মধ্যে রয়েছে ধোঁয়াশা। তাঁদের উদ্দেশে বলি, আমরাও তাঁদের মতো এ বিষয়ে অন্ধকারেই আছি। জার্মানি থেকে আমরা তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে যে রিপোর্ট পেয়েছি, তাতে তাঁর হার্টফেল হয়েছে বলেই উল্লেখ আছে। বেশ কিছু পত্রিকায় সে সময় বের হয়েছিল যে, অতিরিক্ত মদ্যপান নাকি তাঁর মৃত্যুর কারণ। পত্রিকার পাতায় যা দেখি, অনেক সময় আমরা তাই তো বিশ্বাস করে বসি। যাঁরা এ রকম লিখেছিলেন, তাঁদের উদ্দেশে বলতে চাই, জার্মানি থেকে প্রেরিত রিপোর্টে তাঁর শরীরে অ্যালকোহলের উপস্থিতি নেই বলেই উল্লেখ আছে।
আচমকা একজন সুস্থ মানুষ কীভাবে জার্মানি গিয়ে হার্ট ফেইলরের শিকার হলেন, তা আমাদেরও বোধগম্য হয়নি। তাই জার্মানির কাছে বিষয়টি তদন্তের জন্যও বলেছিলাম। কিন্তু জার্মানি থেকে এর উত্তরে বলা হয়েছে, পরিবার থেকে জার্মানির উকিল নিয়োগ করে যেন বিষয়টি তদন্ত করা হয়। এই ছিল সভ্য দেশের উত্তর। আমাদের মতো ক্ষমতা নেই, অর্থ নেই এ রকম পরিবারের পক্ষে কি সম্ভব জার্মানিতে গিয়ে এ বিষয়ে তদন্ত করা?
তাঁর মৃত্যুরহস্য যেমন কাটেনি, তেমনি তাঁর হত্যা প্রচেষ্টা মামলাটি আজো শেষ হয়নি। সময় চলে গেছে ১১ বছর। আজ এক চার্জশিট তো কাল আরেক চার্জশিট, দীর্ঘ সাক্ষ্যগ্রহণ...। তবু আশা হারাইনি। আজকাল অনেক পুরোনো মামলারই তো বিচার হচ্ছে, তাই তাঁর মামলাটিও একদিন সমাপ্ত হবে—এ আশা করতে দোষ কী?
২৭ বছরে বাবার সঙ্গে এত স্মৃতি, এত ভালোলাগা-মন্দলাগা তা আসলে একটি নিবন্ধে লিখে শেষ করা যাবে না। ইদানীং বাবার কথা মনে হলেই তাঁর জীবনের শেষের দিনগুলোর কথাই বেশি মনে পড়ে। একদিন বাবা আমাদের সবাইকে ডেকে বললেন, দেখ, তোমরা তো সব দেখছ, কী রকম হুমকি আসছে এখন আমাদের ওপর। তাই আমি ঠিক করেছি, কিছুদিনের জন্য জার্মানিতে যাব। আমরা বললাম, তা কী করে হয়। তুমি তো অসুস্থ। কী দরকার জার্মানি যাওয়ার। আর একা ওখানে থাকবেই বা কীভাবে? তিনি বললেন, আমাকে নিয়ে চিন্তা করিস না; বরং অনন্যকে (আমার ছোট ভাই) নিয়ে চিন্তা কর। ওর তো সামনে এসএসসি পরীক্ষা। ও তো আমার জন্য পড়াশোনা করতে পারছে না। ঠিক হলো, বাবা ৭ আগস্ট জার্মানি যাবেন। বাবা যতবার বিদেশ গেছেন, ততবারই আমরা সবাই সেজেগুজে তাঁর সঙ্গে আনন্দ করতে করতে বিমানবন্দরে যেতাম; কিন্তু কেন যেন সেদিন আর পারলাম না। সবাই কেমন মলিন কাপড় পরে মলিন মুখে বাবার সঙ্গে বেশ কয়েকটি ছবি তুললাম। জীবনে কখনো বিদেশ যাওয়ার সময় আমরা ফ্যামিলি ফটো তুলিনি। সেবারই প্রথম তুললাম। আর সেই ছবিগুলোই হলো বাবার সঙ্গে তোলা আমাদের শেষ ছবি। বিমানবন্দরে যাওয়া পর্যন্ত কেউ কোনো কথা বললাম না। যখন প্লেন ছাড়ার সময় হলো, তখনো কথা বলতে পারলাম না। শুধু সবার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। বাবা আমাদের দিকে ভালোভাবে তাকাতে পারলেন না। বললেন কেবল, সাবধানে থাকিস।
জার্মানি পৌঁছেই বাবা ফোন দিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা হলো মাত্র দুদিন। খুব কম কথা হলো। তাঁর কথায় বুঝলাম, আমাদের জন্য তিনি হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও চিন্তাগ্রস্ত। এর পর আমরা থেকেছি তাঁর টেলিফোন আর ই-মেইলের সামনে। কিন্তু না। কত ফোন বাসায় এলো, কিন্তু বাবার ফোন আর আসেনি। অনেকে বলেছে, উনি তো মাত্র জার্মানি গেলেন। তোমরা এত ব্যস্ত হচ্ছো কেন? উনি ওখানে নিজেকে একটু গুছিয়ে নিক। কারো কথার উত্তর দিইনি। বাইরের বারান্দায় কাকের তারস্বরে ডাকের সঙ্গে আমাদের মনের অস্থিরতা যেন বাড়তেই লাগল। তিনি যে আমাদের মধ্যে আর নেই, এই চরম দুঃসংবাদটি আমরা পেলাম ১৩ আগস্ট। ৭ থেকে ১৩—মাঝখানে পাঁচ দিন। যিনি জার্মানিতে নিরাপদে থাকবেন বলেই গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখান থেকেই চিরতরে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে।
সে সময় যে কীভাবে আমাদের পরিবারের সবার দিনগুলো গেছে, তা আমি লিখে বোঝাতে পারব না। তাঁর মৃত্যুটি কি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক, তা ভাবব নাকি বাবা ছাড়া আমাদের অনাগত দিনগুলো কীভাবে কাটবে তাই ভাবব—কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না যেন। সে সময় মাথা যেন ভোঁতা হয়ে গিয়েছিল। শুধু মাঝেমধ্যে বুকের ভেতর দলা পাকানো কান্না বের হয়ে আসত। তিনি তো মরে পড়ে ছিলেন জার্মানির মরচুয়ারিতে। আর আমরা একবার অসহায়ের মতো পেন সংস্থার কাছে আর একবার জার্মান দূতাবাসের কাছে ছুটেছি। কিন্তু পাইনি কারো কাছে সাহায্য; বরং তারা পাঠাল এক বিশাল অঙ্কের ফর্দ, যা হুমায়ুন আজাদের লাশ বাংলাদেশে পাঠাতে হলে তাদের দিতে হবে। এ কথা জানার পর দেশ-বিদেশ থেকে বাবার ভক্তরা জানাল, তারাই টাকার ব্যবস্থা করে বাবার লাশ দেশে আনবেন। আমাদের মা তখন শক্ত অবস্থান নিলেন। মা বললেন, হুমায়ুন আজাদ বিত্তশালী ছিলেন না সত্যি, কিন্তু তাঁর লাশ দেশে আসতে ভিক্ষা করতে হবে—এত খারাপ অবস্থাও তাঁর ছিল না। তাঁর টাকাতেই তিনি ফিরবেন। অতঃপর তাঁর মৃতদেহ পাঠানোর ব্যবস্থা হলো। কিন্তু তখন শুরু হলো অন্য ষড়যন্ত্র। কারণ, জীবিত হুমায়ুন আজাদের চেয়ে মৃত হুমায়ুন আজাদকে যে সবার আরো বেশি ভয়। কিন্তু সব ষড়যন্ত্র ভেঙে দিয়ে তিনি তাঁর নিজ দেশের মাটিতে ফিরলেন বৃষ্টিভেজা দিন ২৭ আগস্টে। একশ্রেণির লোকের হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে তাঁর জানাজা হলো হাজার হাজার মানুষের কাতারে দফায় দফায়। বাবাকে তাঁর শেষ বিছানায় শোয়ানোর সময় চারপাশে হাজার হাজার মানুষের শব্দে, সাংবাদিকদের ক্যামেরা ঝলকানিতে সে সময় আমি যেন অসাড় হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের কান্না যেন বৃষ্টি হয়ে ঝরছিল। মনে পড়ছিল, কেবল বাবা বলেছিলেন, তুই বড়। যখন আমি থাকব না, তখন আমার চোখ (যার অ্যাগ্রিমেন্ট ছিল) ও আমার ডেডবডি (যার অ্যাগ্রিমেন্ট ছিল না) তা যেন মেডিকেলে দিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু পারিনি তাঁর কথা রাখতে। নিজেকে ব্যর্থ মেয়ে মনে হলো। কারণ ডাক্তারেরা বললেন, এতদিন পর লাশের চোখ আর দেহ মেডিকেলের কোনো কাজে আসবে না। এগুলো মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা পরেই সংগ্রহ করতে হয়।
এখানেই তো বাবা-আমার কাহিনী শেষ হতে পারত। কিন্তু হলো না। তিনি সমাধিস্থ হওয়ার দুই মাস পর আমাদের হাতে এলো তাঁর জার্মানিতে বহন করে নেওয়া তৈজসপত্র, কিছু রিপোর্ট আর তাঁর কাপড়ের ভাঁজে থাকা আমার জন্য পাঠানো তাঁর শেষ উপহার। আমার উদ্দেশে লেখা একটি ভিউকার্ড। ভিউকার্ডের পেছনে বাবা তাঁর অল্পদিন থাকা জার্মানির কথা বলছেন এভাবে—এখানে সব চুপচাপ, লোকজন কম, বিশাল সব দালান, তবে নিউইয়র্কের উল্টো—প্রাচীন দালান। তোমরা খুব সাবধানে থাকবে।
জীবনে প্রথম এ রকম একটি উপহার পেয়ে খুশিতে ফেটে পড়তে পারলাম না। কাঠের মতো অনুভূতিশূন্য মানুষ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কেবল।