সাক্ষী কেবল চৈত্র মাসের দিন
দেখো দেখো! কী কয় ইসুফ মিয়া ভাইয়ে! শোনো শোনোরে ঠাকুরবাড়ির ঘাটলা! কোন কতা কয় মিয়াভাইয়ে, কুকিলার লগে! জিন্দিগীতে যেয় মোখ খুইল্লা পরানের ভিতরের একটা কতা জুলেখারে কয় নাই; সেয় দেখো আউজকা নিজের পরানের কতা কইয়া কইয়া আসমান-জমিনরে কাঁপাইতাছে!
সেই কথা শোনতে শোনতে জুলেখার অন্তর দেখো ধকপক ধকপক করতাছে! জুলেখার শইল দেখো কাঙ্ক্ষে-ধরা ভরা-কলসির পানির মতোন ছল্লাত দিয়া ওঠতাছে খোনে খোনে! শোনো! সেয় কী কয়!
সেয় আউলা-বাউলা হইয়া কুকিলারে ডাক পাড়তাছে!
ও কুকিলা! ও কুকিলা! এই দেহো আমার দিলে আউজকা কোন সুখের তুফান ছোটছে! এই তুফান আর যে আমি দিলে রাখতে পারতাছি না পক্ষী! নেও তুমি তারে অখন তোমার গলায়! আমার খুশির তুফান-ছোলা, আমার পরানের সুখের ঝাপট-ঝোপট—নেওরে তুমি! নেও!
কুকিলারে! আমার পরান-কুমারীর লগে আমার সাক্ষাৎ ঘটছে! তার লগে দেহা হইছে আমার! ও রে পক্ষী! এই আমার সুখ!
তুমি সেই সুখের সংবাদখান আসমান-জমিনের সকল কিছুরে জানাইয়া দেও রে কুকিলা! আমার সাধ-আহ্লাদের ধনের সামোনে খাড়া হওয়ার ভাগ্যি পাইছি আমি! আমার বাঞ্ছা-ধনের সামোনে, আমার সোনার কন্নার সামোনে—আইয়া বহোনের কিসমত হইছে আমার! এমুন সুখের কথা বাতাসের কানে তুইল্লা দিবা না তুমি? বাতাসরে যুদি না জানাওরে এই সুখ-সংবাদ; তাইলে তা মেঘ আর গাঙ্গের কানে যাইবো ক্যামনে ! সগলতেরে জানান দেও রে কুকিলা, আমার এই সুখের কথাখান! ডাকো পঙ্খী! দুনিয়া উতলা কইরা ডাকো অখন!
মিয়াভাইয়ে অই কথা খালি কইয়া সারে না, পাতা ঝোপ্পের ভিতরে ঠায়-ঠান্ডা হইয়া বইয়া থাকা কুকিলায় লগে লগে ডাকা শুরু করে!
ডাক পাড়তে থাকে পইখে! উতালা বেতালা মিঠা স্বরে ডাক পাড়তে থাকে! কু কু কু কু! কু কু কু কু! জু জু জু জু জু! জুলি জুলি জুলি!
কুকিলায় ডাকে গাছের ঠালে বইয়া! আর তার সুর নিয়া চৈত মাইস্যা বাতাসে উড়াইয়া লইয়া যাইতে থাকে দূরের তেনে দূরে। উড়াইয়া লইয়া যাইতে থাকে কোন উপরের আসমানের গহিনে! সুরের সোরোত খলখলাইয়া নাইম্মা যাইতে থাকে কোন পাত্তালে! কুকিলার সুর দেহো জুলেখার অন্তরের কোন অতলে গিয়া কোন ডাক ডাকতাছে!
ডাকতাছে, জুলি জুলি জুলি গো! আর ক্যান! আর ক্যান! তোর সুখের কলসি কানায় কানায় ভইরা গেল যে! আর তাইলে এই দেহ ধারণ কইরা ফল কী! একবার সুখের মরণ মইরা দেখবি না জুলি!
মিয়াভাইয়ে আউজকা তো তেলেসমাতি কারবারে কোনো সীমা রাখতাছে না! সেয় জুলেখার অন্তরের ভাবনারে ধইরা ফালাইয়াই বুঝি জুলেখার ডাইন হাতের আঙ্গুল কয়টারে আলগোচ্ছে ধরে! তার হাতে জুলেখারে কইতে থাকে, ‘এমুন কতা মোনে আনতে নাই! জীয়নে-মরণে একলগে থাকমু দোনোজোনে! কী? থাকবেন না?’
জুলেখার মোখে আর এই কতার জব দিবো কী! তার আঙ্গুলেরাই তো সগল কতা কইয়া শেষ করতে পারে না! তারা কয়, ‘আপনে আমার জীয়ন হইলেন মিয়াভাই! আপনের হাতে সইপ্পা দিলাম আমার পরান!’ জুলেখার ডাইন হাতের আঙ্গুলেরা চুপেচুপে এই কথা কয় আর কান্দে। কান্দে আর হাসে।
সেই কান্দন-হাসির গুনগুনানির লগে থাকোনের বাঞ্ছা লইয়াই বুঝি কইত্তেনে জানি উইড়া আহে একজোড়া ভোমরা! তারা গুনগুনাইতে গুনগুনাইতে মিয়াভাই আর জুলেখারে ঘিরা ঘুরতে থাকে। ঘুরতে থাকে, উড়তে থাকে। উড়তে উড়তে তারা একবার যাইতে থাকে গা পুষ্কুনী একেবারে মধ্যখানে, আবার ফিরা আসে তাগো দোনোজোনের কাছে! আইয়া আবার চক্কর দিতে থাকে।
কিন্তুক মিয়াভাইয়ে মোখে তো কিছু বলে না! কিছুই তো সেয় বলতাছে না!
কুকিলারে দিয়া ডাক পাড়াইতাছে! জুলির উষ্টা-খাওয়া আঙ্গুলরে পরান দিয়া দর্দ করতাছে! জুলেখার লগে কেমুন নয়া-রকমে কতা কইতাছে। জুলেখারে আপনে আপনে-কইরা কতাও তো চালাইতাছে পইল্লার তেনেই! কিন্তুক এটি দিয়া জুলেখার কোন ফয়দা হইবো! জুলেখায় যেই হাছন-কপাইল্লা, হেই হাছন-কপাইল্লাই তো থাকবো!
তয় ভিতরে ভিতরে আউজকা জুলেখায় একটা বিষয় লইয়া বড়োই ধাক্কা খাইতাছে! দেহো মিয়াভাইয়ে আউজকা ক্যামুন আচানক রকমে কতা কইতাছে! এমনে তো হেরে কোনোকালেও কতা কইতে হোনে নাই কেউ! জুলেখারা সগলতে, দেওভোগ গেরামের সগলতে এমুন কইরা কোনোসোমই তো কতা কয় না!
শীতের কালে কোনো কোনো সোম গায়েনেরা দেওভোগ গেরামে আইয়া যেমনে পরস্তাব কয়, মিয়াভাইয়ের কতারে এক একবার মনে হইতাছে সেই পরস্তাবের কতা! আরেকবার মোনে হইতাছে য্যান কাচ-নাচ দেহাইতে আওয়া মাইনষেগো কোনো এক জোনে বুঝি কতা কইতাছে! অই মাইনষেরা তো জুলেখা গো সগলতের মতোন কইরা কতা কয় না!
ইসুফ মিয়া ভাইয়ে এইটা? খোনে খোনে ক্যান জানি জুলির মোনে আইতাছে যে, এইটা অন্য কেউ! এইটা ইসুফ মিয়া ভাইয়ে না আসোলে! ক্যান এমুন ভুল কতা মোনে আহে দেহো তো!
জুলেখার এই সগল কথার উত্তরে মিয়াভাইয়ে মোখে কিছুই কয় না ঠিক, কিন্তু ক্যামনে জানি আবার জুলেখার অন্তরে আইয়া মিয়াভাইয়ের কথা বাজতে থাকে।
জুলেখায় হোনে মিয়াভাইয়ে কইতাছে, সেয় জুলেখার অন্তরের এই সগল কথারই জব দিবো। ভাইঙ্গা-চুইরা বিশদ কইরাই দিবো। কিচ্ছু লুকাছাপা করবো না। তয় তার আগে সেয় আঙ্গুলটার বিষ-ব্যাদনা দূর কইরা লইতে চায়! থেতলানির ঘাওটা ভালা কইরা লইতে চায় সেয় আগে!
কিমুন মাথা-খরাপের লাহান কতা কয় মিয়া ভাইয়ে আউজকা!
উষ্টা খাইয়া থেতলাইছে যেই জায়গা, সেইটা কী লগে লগে সারে! না কইয়া হইলেও তো চাইর-পাঁচটা দিন লাগবো ঘাওটা শুকাইতে! দুব্বার রস ভালা মতোন পড়ছে দুক্ষুর জায়গায়; আলা, শুইকাইবো নে ঘাওয়ে তার নিজের গরজেই! হেইটা লইয়া আর ভাবনা-চিন্তা করার কী আছে! এই গেরামের কোনো একটা জোনে নি এই উষ্টার জখমি নিয়া পেরেশান হইছে কোনোদিন! তাইলে মিয়াভাইয়ে পেরেশান হইতাছে ক্যান! সেয় আউজকা এমুন আজাইরা কারবার করা ধরছে ক্যান!
জুলেখার ভিতরে এই যে অতো কথার আনাগোনা চলতাছে, তারে আর এট্টুও গেরাজ্জি করে না মিয়াভাইয়ে! আঁতকা য্যান দিন-দুনিয়ার কথা তার একেবারে বিস্মরণ হইয়া যায়! খালি স্মরণে থাকে জুলেখার পাওয়ের পাতাখান!
তবে সেয় বেতালা হইয়া খালি জুলেখার জখমি-আঙ্গুলটারেই দর্দ করতে থাকে না! পুরা পাওয়ের পাতাটারেই মমতা দিয়া নিছতে-পোছতে থাকে।
কেমুন শান্তি যে লাগতে থাকে জুলেখার! কেমুন যে শান্তি! তার পরানে তারে কইতে থাকে যে, দিন-দুনিয়ার কথা তারও আর মনে রাখনের কোনো কাম নাই!
থাকুক পইড়া বাড়িঘর, ভিটিপুষ্কুনী! থাকুক পইড়া মাও-বাপে। জুলেখার আর কোনো কথা খেয়ালে আনোনের কোনো ঠেকা নাই! কিচ্ছু ঠেকা নাই!
মিয়াভাইয়ে যুদি কিচ্ছু কোনো আশার কতা নয়া কইয়া এইন তেনে যায়ও গা; জুলেখারে একেলা থুইয়া যুদি এট্টু পর সেয় যায়ও গা; জুলির পরানে কোনো দুক্ষু হইবো না!
তার পরান ভইরা গেছে দরদে! তার জিন্দিগী কেমনে জানি আউজকা টায়-টায় ভইরা গেছে! মায়া-দর্দ দিয়া তারে কেমনে জানি ভইরা ফালাইছে মিয়াভাইয়ে! অখন মিয়াভাইয়ে যুদি অরে আর কিচ্ছু নয়া কইয়া যায়ও গা; জুলেখার অন্তরে হায় হায় করবো না!
সেয় একলা পইড়া থাকবো এই ছাড়া-বাড়িতে! যুগ-জনমের লেইগা পইড়া থাকবো! আর কোনোদিগে যাইবো না উয়ে! কোনোহানে যাইবো না!
এই কতা জুলেখার ভিতরে আহোনের লগে লগে; ক্যান জানি আঁতকা তার পরানের ভিতরটা হু হু কইরা ওঠে! ক্যান জানি তার ধুম কান্দন আইতে থাকে। অকারণেই দমে দমে পানি আইয়া তার চক্ষে ঝাপটা মারতে থাকে!
দেহো তো কী জ্বালা! অর চক্ষে পানি দেখলে মিয়াভাইয়ে কী মোনে করবো! হের যুদি মোনে অয় যে, দেহো ছেড়িটায় কেমুন বেশরমের বেশরম! দুক্ষু পাইছে দেইক্ষা ছেড়িটারে এট্টু দর্দ করতাছি, আর অদিগে ছেড়ির মোনে কোন লোভ লড়ে-চড়ে!
মিয়াভাইয়ে তো জুলেখারে নিয়া ভালা-বুরা কতা কিছু মোখ খুইল্লা কয় নাই! কিছুই তো কয় নাই! জুলেখায় কোন আক্কলে মিয়াভাইয়ের লেইগা অমুন চিক্কুর পাড়তে চাইতাছে!
ইছছছ! থাকুক অন্তরের কান্দন অন্তরে! মিয়াভাইয়ে য্যান একটা ফোটা চক্ষের পানি না দেখে!
কপাল ভালা যে জুলেখার মোখের দিগে মিয়াভাইয়ের কোনো খেয়ালই নাই! সেয় জখমি আঙ্গুল আর দুব্বা-বাটা নিয়াই বেজেহানী আছে! আল্লা! তুমি জুলেখার মান রাখো!
বেত্তমিজ চক্ষের পানিরে লুকানি দেওনের লেইগা জুলেখায় তখন করে কী, তরাতরি চউখ বুইজ্জা ফালায়।
কতখোন বাদে তার চউখ ক্যান জানি আপনাআপনিই আবার খুইল্লা যায়। আইচ্ছা, আর কতখোন মিয়াভাইয়ে এমুন যতন দিতে থাকবো জুলেখার পাওরে! আর কতো শরম দিবো হেয়, জুলেখারে! হইছে, বহুত হইছে! আর না!
শরমে কুকরি-মুকরি খাইতে খাইতে জুলেখায় নিজের পাওয়ের দিগে চায়। ও আল্লা! এইটা কী দেখতাছে উয়ে! কী দেখতাছে!
দেখতাছে যে; মিয়াভাইয়ে জুলির পাওয়ে হাত রাখতাছে, অর পাওয়ের রং হইয়া যাইতাছে দগদগা লাল! য্যান সিন্দুরে সিন্দুরে ঢাকা পইড়া যাইতাছে পাওটা! যেই পাওয়ে মিয়াভাইয়ের হাত নাই, সেইটাও এক লগে একই রকমে লালে লাল, দবদবা মান্দারের ফুলের লাহান হইয়া যাইতাছে।
আবার যেই সেয় তার আঙ্গুলটি জুলির পাওয়ের তেনে এট্টু সরাইতাছে, অমনেই যে কে সেই হইয়া যাইতাছে পাওয়ের বন্ন! আবার মিয়াভাইয়ের আঙ্গুলেরা ধরতাছে জুলেখার পাওরে, তার পাতা দুইটা হইয়া যাইতাছে হইলদা!
মিঠা-কুমড়া ফুল আছে না! ডবডবা হইলদা মিঠা-কুমড়া ফুল! জুলেখার পাওয়ের পাতা দুইটারে তখন আর মাইনষের পাও মোনে হইতাছে না! লাগতাছে য্যান দুইটা ঝকমক ঝকমক মিঠা-কুমড়ার ফুল! চৈত মাইস্যা দিনে সুরুজের নিচে ডগবগাইতাছে! হায়রে সোন্দরের সোন্দর! এইটা জুলির পাও! এইটা অর পাও নিহি! বিশ্বাস অয় না! বিশ্বাস অয় না জুলেখার!
কেমুন যে ধোক্কা লাগতে থাকে জুলেখার!
তার বাদে সেয় ধোক্কা খাইতে খাইতে আরেকটা আচানক জিনিস দেখে! জুলেখায় পষ্ট চক্ষে দেখে যে, অর থেতলানি-খাওয়া আঙ্গুলের কোনোখানে কোনো জখমের কোনো চিহ্ণ নাই! আঙ্গুলের কোনোদিগে কোনো ঘাও কী কাটা-ছিঁড়ার কোনো এট্টু দাগ তরি দেহা যাইতাছে না! পুরা ভালা হইয়া গেছে গা অর আঙ্গুল! পুরা ভালা! এইটা ক্যামনে হইলো! ক্যামনে কী হইলো!
‘মিয়াভাই! আপনে এটি কি জোরাইলেন আউজকা! আমি কিন্তুক ডরামু হেইর পর!’ বেদিশা জুলেখায় মিয়াভাইরে হাঁকানী দিয়া ওঠে।
‘আমারে আপনে ডরাইয়েন না জুলেখা! আসমান-জমিনের সকল ডরের তেনে আমি আপনেরে আগলানি দিয়া রাখমু! আমার জান দিয়া আগলামু তারে আমি! এই কইন্যারে!’
‘মিয়াভাই! এটি ক্যান কন! এমনে কইয়েন না! বাবায় আমার লেইগা সম্বন্ধ পাক্কা করতে গেছে গা মিয়াভাই! হোনেন! আউজকাই পাক্কা হইয়া যাইবো! এই সগল কথা কইয়া তাইলে ক্যান কান্দাইতে চাইতাছেন আমারে, আপনে! আর ক্যানই বা আমারে আউজকা আপনে আপনে করতাছেন!’
‘শোনো রে রাইতের তারা, দিনের সুরুজ! শোনো রে মাটির দুনিয়া, নূরের জাহান! তোমাগো সাক্ষী থুইয়া কই আমি! এই দেহে জান থাকতে আমি অই চক্ষে পানি নামতে দিবো না!’
‘থাউক! এইসব কতা কইয়া আর কী ফয়দা মিয়াভাই! আর কইয়েন না! আর কওন লাগদো না! কিচ্ছু কওন লাগবো না! আমার নসিবের লিখন আমারই থাউক!’ কইতে কইতে কান্দতে কান্দতে উইট্টা খাড়ায় জুলেখায়! লাগবো না আর তার ঠাকুরবাড়ির পুষ্কুনীতে ডুব দেওন! লাগবো না তার আর এইসব বেহুদা, ফেদা পেঁচাল হোনোন! কিচ্ছু লাগবো না!
কিয়ের চান-সুরুজ সাক্ষী! কিয়ের লেইগা সাক্ষী! অই সাক্ষী দিয়া কী হইবো! বাবায় সম্বন্ধ করতে গেছে। ঘরজামাই আইন্না আইজ-কাইলের মিদে জুলিরে বিয়া দিয়া দিবো। এইবার আর কোনো ঢিলামি দিবো না। জুলেখায় জানে, ভালা কইরাই জানে, এইবার জুলেখার বিয়ার সম্বন্ধ তারা কইরাই ছাড়বো!
তাইলে আর মিয়াভাইয়ের এই সগল কথা হুইন্না নিজের কইলজারে দাগা দেওনের কী কাম! জুলেখার কইলজা যেইট্টুক পুড়ছে, সেই পোড়ানির জ্বালাই ত্তো জুলেখায় তামান জিন্দিগীতেও দূর করতে পারবো না!
কাইন্দা কাইন্দাই ত্তো জুলেখার জিন্দিগী পিছলা হইয়া থাকবো রোজ-কিয়ামত তরি! আর কোনো দরদ-মোহব্বত লাগবো না দুঃখিনী জুলেখার! কিচ্ছু লাগবো না! থাকুক মিয়াভাইয়ে তার মারফতি কথারে লইয়া!
জুলেখায় চক্ষের পানি পোছতে পোছতে বাড়ির দিগে মেলা দেয়। এই ত্তো অল্প কয়খান সিঁড়ি! হেগিলি পার হইয়া দিবো জুলেখায় আবার বোদ-বোদাইয়া লৌড়! এক লৌড়ে গিয়া হাজির হইয়া যাইবো গা নিজে গো পুষ্কুনীর ঘাটে। কোন ঘাটলায় কবে, কোনসোম, কার লেইগা জুলি বেদিশ হইয়া গেছিল, তার খোঁজ কেউইরে পাইতে দিবো না জুলি! কেউইরে না! জানবো খালি সেয় নিজে! আর তার আল্লায়!
ধিকিধিকি দগ্ধ হইবো খালি সেয় একলা একলা, ভিতরে ভিতরে! সেই যাতনার সাক্ষী থাকবো খালি তার আল্লায়! কেউইরে কোনো নালিশ জানানের নাই জুলেখার! কেউইরে না!
চক্ষের পানিতে দুনিয়া ভাসাইতে ভাইতে জুলেখায় না খালি দুইটা সিঁড়ি ওঠছে, পিছের তেনে অর মিয়াভাইয়ে অরে কাতর গলায় কয়, ‘আপনে যাইয়েন না! জুলেখা! আমার কথা শেষ হয় নাই! জুলেখা গো যাইয়েন না!’
‘ক্যান থাকমু আমি! ক্যান! আপনে এটি কী জোরাইছেন! কোনকালে আমারে আপনে কইরা কইতেন! কোনকালে! আউজকা ক্যান কন! আমার আর এটি হোনোনের সাধ নাইক্কা!’
‘শোনেন গো কন্না! সব কথা আমি আপনেরে ভাইঙ্গা কইতে পারতেছি না! সব কমু আমি আপনেরে! সব আমি কইতে চাই! তয় তার আগে আমারে একটা কথার জব পাওন লাগবো গো! সত্য জবাব। দিবেন?’
জুলেখায় বোলে কোনোদিন মিয়াভাইরে কিছু ভাঁড়াইছে! কোনোদিন বোলে মিছা কিছু কইছে! আউজকা তাইলে সেয় ক্যান এমুন কিরা কাটাইতাছে জুলেখারে! হাছা কতা কওয়ানের লেইগা জুলেখারে নি কিরা কাটান লাগবো! মিয়াভাইয়ে যেইটা জিগানের জিগাউক না জুলেখারে! জুলি মিছা কইরা কিচ্ছু কইবো না! একটা কতাও মিছা কইবো না!
‘আপনে আমার সব জাইন্না আমারে বিয়া করবেন জুলেখা?’
মিয়াভাইয়ের কিছু বোলে জানোনের বাদ আছে জুলেখার! কান্দনের মিদেই হাসি আহে অর! মিয়াভাইয়ে এমুন পাগলা-কিসিমের! জুলেখায় খেয়াল করে নাই দি আগে!
‘জুলেখা গো! আমার পরান-কইন্যা! যাইবেন আপনে আমাগো বাইত? যাইবেন?’
‘আপনে না নিলে আমি কেমনে যামু! আপনে না কইলে আমি কই যামু!’
‘এই যে কইলাম! এই যে কইতাছি! আউজকা কতোদিন হয় কইয়া যাইতাছি জুলেখা! আপনে হোনেন না! আমার ডাক আপনের কানে পৌঁছায় না! কতো ডাকছি, কতো কইছি; আপনে হোনেন নাই। আপনে হোনেন না জুলেখা!’
‘এই যে অহন হোনলাম! এই যে হুনছি! এই যে আমি হুমুইর দিতাছি আপনের ডাকের!’
‘কন জুলেখা! আমারে বিয়া করবেন? যাইবেন? আমার পরানের ধন! যাইবেন আমার লগে? বিয়া করবেন আমারে?’
‘আপনে গিয়া বাবা-মায়রে কন! হেগো কন গিয়া আপনে!’
‘আগে আপনের মোখের কথাখান হুনি আমি! কন আমারে! আপনের মোখে আগে কন!’
দেহো তো! এমনে নি জিগায় মাইনষে! শরম লাগে না জুলেখার! মিয়াভাইয়ে দুনিয়ার রীতিমিতি সগল ভোলছে! ক্যামনে ভোলছে! অন্তরের বাঞ্ছারে আউজকা নি জুলিরে মোখে কইয়া বুজাইতে হইবো! জুলির অন্তরের কথাখান হেয় বোজতাছে না বুঝি!
এই যে উয়ে কইলো বাবা-মাওয়ের কাছে গিয়া বিয়ার কতা কইতে, অইটা দিয়া জুলির অন্তরের ভাব বুঝানি দিছে না জুলিয়ে! তাও বোলে ভাইঙ্গা কইতে হইবো! পারবো না জুলেখায় অমুন বেশরম হইতে! কিছুতেই পারবো না!
‘একবার খালি কন আপনে জুলেখা! আপনের নিজের মোখে একবার খালি বলেন! আপনে বিয়া করবেন আমারে! যাইবেন আমার লগে?’
এমুন উতলা মানুষটারে আর কেমনে কষ্ট দেয় জুলেখায়! এইটুক কতা হোনোনের লেইগা যেয় এমুন কাতর এমুন পেরেশান; তারে ক্যান আর জ্বালা দিবো জুলি!
‘জুলেখা! বিয়া করবেন আমারে? যাইবেন আমার লগে আমাগো বাড়িত?’
লাজ-শরমের মাথা খাইয়া জুলেখায় একবার মাথা লাইড়া নিজের ইচ্ছারে বেক্ত করে। তার বাদে মাটির দিগে চাইয়া, লাজে কাঁপতে কাঁপতে কোনোমতে কয়, ‘হ! যামু! আপনে নিলে আমি যামু!’
সেই কথার উত্তরে দেখো মিয়াভাইয়ে কী করে! দেখো সেয় কেমুন কইরা তার দুই হাত বাড়াইয়া ধরে জুলেখার সামোনে! এমনে ডাকলে জুলি নি থির থাকতে পারবো! পারবো না! পারবো না! অই পাগলা দুই হাতের ভিতরে নিজের ফিক্কা না দিয়া থাকতে পারবো না জুলিয়ে!
জীবন-মরণ, আখের-আউয়াল, নেক-বদ, আগুন-পানি সব ভুলাইয়া দিতাছে যে সর্বনাইশ্যা দুই হাতে! তার কাছে নিজেরে সইপ্পা দিতে না পারলে এই জীবন যে বিরথা হইয়া যাইবো গা!
সগল কিছুরে বিস্মরণ হইয়া উতলা জুলেখায় ছুট দেয় অই দুই হাতের দিগে!
(চলবে)