আমার শিক্ষক হুমায়ুন আজাদ
ব্যতিক্রমী, বহুমাত্রিক ও প্রতিভাবান লেখক হুমায়ুন আজাদ ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে তিনি আমাদের বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্ব পড়াতেন। ১৯৭৮ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তিনি যোগ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইতোপূর্বেই তাঁর নাম, পড়েছি দু-একটি কবিতা। বিভাগের করিডোরে লক্ষ করেছি লম্বা শীর্ণ অথচ চলনে দৃঢ়, কিছুটা স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে তাঁর হেঁটে যাওয়ার দৃশ্য। ফলে বিশেষ একটা কৌতূহল নিয়েই এমএ শ্রেণিতে তাঁর প্রথম ক্লাসে উপস্থিত হয়েছি। শিক্ষক হিসেবে তাঁকে দেখার প্রথম দিনেই তিনি আমার মাঝে স্বাতন্ত্র্যের ছাপ রাখলেন। উপস্থাপনা রীতি, উচ্চারণ, কথা বলার ঢং, বিষয় বোঝাবার ক্ষমতা, বিশ্লেষণ—সবকিছুতেই স্পষ্ট ব্যতিক্রম আমার চোখে ধরা পড়ল। ক্লাসে তিনি ছিলেন নিয়মিত, ক্লাস না করার অজুহাত কখনো শুনিনি তাঁর কাছে, দেরিতে এসে আগেভাগেই ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে যাওয়ার কোনো দৃষ্টান্তও নেই আমার স্মৃতিতে। শিক্ষক হিসেবে হুমায়ুন আজাদ ছিলেন প্রকৃত অর্থেই ব্যতিক্রমী।
শিক্ষক হিসেবে হুমায়ুন আজাদকে পাই ১৯৮১ সালে। সেই থেকেই তাঁর সঙ্গে প্রাত্যহিক দেখাশোনা। ১৯৮৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে আমি যোগদান করি। শিক্ষক ও সহকর্মী হিসেবে এর পর থেকে আমার যোগাযোগ ও সম্পর্ক আরো দৃঢ় ও দৈনন্দিন হয়ে ওঠে। করিডোরে কি বিভাগের সভাপতির কক্ষে, দেখা হলে স্মিত হেসে বলতেন, ‘কী খবর?’ বিভাগের প্রাত্যহিক কাজকর্মে, পরীক্ষার হলে দায়িত্ব পালনে খানিকটা অনীহা থাকলেও ক্লাস গ্রহণে তিনি ছিলেন সব সময়ই নিয়মিত ও আন্তরিক। ডক্টর হুমায়ুন আজাদ ক্লাস নেননি—এমন অনুযোগ কোনো শিক্ষার্থীর কাছে কখনো শোনা যায়নি।
নব্বইয়ের দশকের গোড়া থেকেই তিনি সৃষ্টিশীল রচনায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন। ক্রমে এ ক্ষেত্রে তিনি এত বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়েন যে, শিক্ষকতা তাঁর কাছে প্রাধান্য হারিয়ে বসে। তবু সত্য এই, পড়ানোর যে দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করতেন, তা পালন করতেন নিষ্ঠার সঙ্গে। পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়নে গতানুগতিক বিলম্ব, যা কখনো কখনো সাত-আট মাসে পৌঁছায়, হুমায়ুন আজাদের ক্ষেত্রে কখনো ঘটেনি। তিনি ক্লাস নিতেন অপরাহ্ণে—২টা ৩০-এ ক্লাসে যাওয়ার আগে সভাপতির ঘরে গেলে দেখা যেত, মুখে সিগারেট নিয়ে একমনে বইয়ের দিকে নিবিষ্ট হুমায়ুন আজাদ। পদশব্দে চোখ তুলে যথারীতি সেই প্রশ্ন, ‘কী খবর?’ টুকটাক কথাবার্তা, আবার তাঁর সেই টেক্সট ওল্টানো। এই ছিল নিষ্ঠ শিক্ষক হুমায়ুন আজাদের ছবি।
শিক্ষার্থী ও সহকর্মী হিসেবে ডক্টর হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক দীর্ঘ ২৫ বছরের। এ সময়ে তাঁর অনেক ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য আমাদের আন্দোলিত করেছে। প্রচলিত কথার বিপ্রতীপ বয়ান ছিল তাঁর স্বভাবধর্ম। এ কারণে কখনো তিনি নিন্দিত হয়েছেন, কখনো নন্দিত। অন্যের উপন্যাসকে তিনি অবলীলায় বলেছেন ‘অপন্যাস’, নিজেকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক বলতেও কুণ্ঠিত হননি—এসব কিছুই তাঁর প্রাতিস্বিক সত্তার পরিচায়ক। সত্য উচ্চারণে তিনি ছিলেন নির্ভীক, ভয় পেতেন না কোনো কিছুতেই—এই অভীকসত্তাই ডক্টর হুমায়ুন আজাদের বিশিষ্ট চরিত্রধর্ম।
ব্যতিক্রমী বক্তব্যের পাশাপাশি কখনো কখনো স্ববিরোধী বক্তব্যও শুনেছি তাঁর মুখে। মনে আছে, আমরা তখন স্নাতকোত্তর শ্রেণির শিক্ষার্থী। ক্লাসে তিনি একদিন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস পাঠের আগ্রহ ব্যক্ত করলেন। কারো কাছে ‘পথের পাঁচালী’ থাকলে তাঁকে দেওয়ার কথা বললেন। একদিন সন্ধ্যায় স্যারের নয়াপল্টনের বাসায় হাজির হলাম ‘পথের পাঁচালী’ নিয়ে। দিন কয়েক পর বইটি ফেরত দিলেন তিনি। কিন্তু যা বললেন, তাতে একটু বিস্মিত হলাম। এমএ ক্লাসে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস আমাদের পড়াতেন ডক্টর সৈয়দ আকরম হোসেন। তাঁর মাধ্যমে ‘পথের পাঁচালী’র শিল্প-সৌন্দর্য আস্বাদন করে আমরা তখন বিমোহিত। অথচ হুমায়ুন স্যার বললেন অন্য কথা। তিনি আমাদের বললেন, ‘আমি ২১ পৃষ্ঠা পর্যন্ত পড়েছি। তার পর আর পড়তে পারিনি। অপাঠ্য।’ আমরা বিস্মিত হলেও কিছু বলিনি। কেননা, একটা উপন্যাস দুজন পাঠকের কাছে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতেই পারে। কিন্তু বিস্মিত হলাম তার কিছুদিন পরে। এক সাক্ষাৎকারে দেখলাম তিনি লিখেছেন, ‘পথের পাঁচালী’ পৃথিবীর একটা শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, অথচ সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র বানিয়ে উপন্যাসটির চরিত্র নষ্ট করেছেন। উত্তরকালে তিনি ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস সম্পাদনাও করেছেন। এই স্ববিরোধিতা, নাকি বলব কোনো বিষয় সম্পর্কে ধারণার রূপান্তরশীলতা ছিল তাঁর মজ্জাগত বৈশিষ্ট্য।
বাংলা বিভাগের সভাপতি হিসেবে তিনি ছিলেন ভিন্ন এক মানুষ। এ সময় তিনি হয়ে ওঠেন অনেক বেশি স্থিতিস্থাপক। কোনো বিষয় নিয়ে কখনো বিরোধে জড়িয়ে পড়েননি—সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর ছিল শ্রদ্ধাপূর্ণ সম্পর্ক। নিজের স্বাতন্ত্র্য বা ব্যতিক্রমিতা তেমন একটা দেখাতেন না তিনি। সহজাত কারণে কিছু একটা করলেও দ্রুত তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠের মতো বুঝে নিয়ে নিজেরটা তুলে নিতেন। বিভাগ পরিচালনার ক্ষেত্রে তাঁর এই গণতান্ত্রিক বোধ আমি বিশেষভাবে লক্ষ করেছি।
মনে পড়ে একটি ঘটনা। ‘বাংলা’ শব্দটি তিনি লিখতেন না, লিখতেন ‘বাঙলা’। সভাপতি হিসেবে তিনি যখন তা করতে চাইলেন, তখন একদিন বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভায় ডক্টর রফিকুল ইসলাম বললেন, “হুমায়ুন, তুমি যেভাবেই লেখ না কেন, বিভাগের নাম ‘বাংলা’ বানানেই লিখতে হবে।” হুমায়ুন স্যার একটা কথা না বলেই সঙ্গে সঙ্গে তা মেনে নেন।
ডক্টর হুমায়ুন আজাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত অনেক স্মৃতি আছে আমার। বছর কয়েক পূর্বে তিনি বাংলা কবিতার একটি সংকলন প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। একদিন ফোন করলেন আমাকে। স্যারের বাসায় গেলাম। আবুল হাসানের কবিতার বই চাইলেন আমার কাছে। বললেন, ‘তুমি আবুল হাসানের জীবনী লিখেছ। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সে বই আমি পড়েছি। নিশ্চয়ই তোমার কাছে আবুল হাসানের কবিতার বইগুলো আছে।’ স্যারকে সাহায্য করতে পেরে সেদিন আমি আনন্দিত হয়েছিলাম।
একদিন অপরাহ্নে করিডোর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। হঠাৎ পেছন থেকে স্যারের কণ্ঠ, ‘এই যে বুদ্ধদেব বিশেষঙ্গ, কথা শোন।’ বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসে নৈঃসঙ্গ্যচেতনা বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করেছি আমি, তাই স্যারের এই সম্বোধন। সম্বোধনটা খারাপ না লাগলেও ভেতরে ভেতরে শঙ্কিত হচ্ছিলাম। স্যার কি কোনো ত্রুটির কথা বলবেন? না, তিনি জানতে চাইলেন, বুদ্ধদেব বসুর ‘শোনপাংশ’ উপন্যাসটি আমার কাছে আছে কি না? কক্ষ থেকে এনে স্যারের হাতে বইটা দিলাম। স্যার খুশি হলেন। পরের দিনই তিনি বইটা ফেরত দিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘স্যার, কিছু লিখবেন কি?’ বললেন, ‘না, উপন্যাসটার থিমটাকে ভেঙে নতুন একটা উপন্যাস লেখার ইচ্ছা আছে। বুদ্ধদেব বসুই হবে আমার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র।’ বুদ্ধদেব বসুর একনিষ্ঠ অনুরাগী ছিলেন হুমায়ুন আজাদ—বুদ্ধদেব বসুকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন ‘আধুনিকতার শিক্ষক’ হিসেবে। বুদ্ধদেব বসুকে নিয়ে স্যারের পরিকল্পিত সেই উপন্যাস অলিখিতই থেকে গেল; বরং এখন তিনিই হয়ে উঠেছেন নতুন একটা উপন্যাসের শিল্প-উপাদান।