গল্প পড়ার গল্প
দেশ ও দেশপ্রেমের গল্প
ইমদাদুল হক মিলনের ফোন আজ থেকে বছর ৩০ আগে প্রথম পেয়েছিলাম। নামটি ওপার থেকে এপারে ভেসে এসেছিল তখনই, নামী, জনপ্রিয় লেখক। কলকাতায় এসেছেন, আলাপ করবেন আমার সঙ্গে। সেই প্রথম পরিচয়। অবাক হয়েছিলাম, মিলন আমার ১৯৭৭-৭৮ সালে লেখা গল্পও পড়েছেন। এত আন্তরিক, এত পড়ুয়া লেখক মিলন, আমি তখন তাঁর কিছুই পড়িনি। সেই সময়ে এখানে বাংলাদেশের বই ছিল অমিল। বাংলাদেশের লেখকদের খবর আমরা পেতাম না। পরে তা বদলেছে।
‘দাদা পড়ে দ্যাখবা তো। ম্যালা বইয়ের ভিতর এও একটা বই।’ আমি নূরজাহান পড়ে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। এমন অবাক করা উপন্যাস লিখেছেন মিলন, অথচ আমি জানি না! আমার মনে হয়, সাহিত্য ক্ষেত্রে অনেক সত্য উচ্চারিত হয় না। মিলন যে সত্যিকারের গুণী লেখক, তা নূরজাহান পড়লে প্রত্যয় হয়। তিনি বাংলাদেশটিকে চেনেন নিজের হাতের তালুর মতো। দেশ চেনা মানে দেশের মানুষ চেনা, প্রকৃতি, গাছপালা, মেঘ বৃষ্টি, নদী নাও, লতাগুল্ম, মাছ... সব। মিলনের গল্পে সব আছে। ‘নিরন্নের কাল’, ‘মেয়েটির কোনো অপরাধ ছিল না’, ‘মানুষ কাঁদছে’, ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’, ‘লোকটি রাজাকার ছিল’, ‘মমিন সাধুর তুকতাক’ এসব গল্পের জন্যই মিলন বহুদিন পঠিত হবেন সাহিত্যের পাঠকের কাছে। আর এই সমস্ত গল্প পড়লে ধরা যায়, মিলন কেন স্বতন্ত্র।
‘নিরন্নের কাল’ বাংলাদেশে এসেছিল। অনাবৃষ্টি, ফসলহানি বহু কৃষক পরিবারকে ভিখিরি করে দিয়েছিল। এই গল্প সেই গল্প। এর বাস্তবতা ভয়ানক। দুর্ভিক্ষে দুই নাচার ভাইবোনের গল্প। বড় বোন, ছোট ভাই। বোনটি যেন সেই হতশ্রী ক্ষুধার্ত দুর্গা, আর ভাই তেমনিই অপু। না, তা নয়। এদের কথা আমাদের জানাই হয়ে ওঠে না। দুর্ভিক্ষে মা গেছে ভিখ মাগতে। বাপ গেছে কাজের সন্ধানে। না পেলে ভিক্ষা। ভাই আর দিদি বাড়ি। দীনু আর বুলবুলি। সমস্ত গল্প লেখা হয়েছে উপভাষায়। ভাই বোনের কথোপকথনই গল্প। ভাই দ্যাখেনি সোনার বাংলা। কবছরের খরায় সব পুড়ে ছারখার হয়ে গেছে। ভাই জিজ্ঞেস করে ধানের কথা, চালের কথা, ভাতের কথা। দিদি তা বলে। দীনু জিজ্ঞেস করে, পাকা ধানে রং কেমুন অয় বুবু?
সোনার লাহান, গেন্দাফুলের পাপড়ির লাহান।
ঘেরান অয় না?
অয় না আবার! সাই ঘেরান অয়...
অন্নের অভাব নিয়ে এই গল্প শুধু ধান, ধান চাষ, ধান কাটা, ধান ঝাড়া, চাল কোটা, ভাতের ফুট, গরম ভাতের বাসের কথা বলে যায়। মিলন যে শিকড় থেকে উচ্ছিন্ন কোনো শহরবাসী লেখক নন, তা তাঁর গল্প পড়লে ধরা যায়। নিরন্নের কাল-এর মতো গল্প বাংলা সাহিত্যে খুব কমই লেখা হয়েছে। আর এই গল্প পড়লে ধরা যায়, বাংলাদেশের গল্পে যে শিকড়ের ঘ্রাণ আছে, তা আমরা হারিয়েছি অনেক কাল। মিলন এই গল্পে একটু একটু করে ক্ষুধার পৃথিবীকে উন্মোচন করেছেন। বুলবুলি ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য কত রকম কথা বলে অন্ন নিয়ে। কামারবাড়ি যায় ভাইকে নিয়ে। তাদের বাগানে গয়া ফল আছে। কচুর লতি থাকতে পারে, তা দিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি হতে পারে। ক্ষুধা নিয়ে কামার বাড়ি যেতে যেতে বালকটি কিচ্ছা শুনতে চায়। কিচ্ছা শুনতে শুনতে পথ হাঁটলে পথ তাড়াতাড়ি ফুরোবে। কিসের কিচ্ছা? না, ধানের কিচ্ছা, মাছের কিচ্ছা...।
আহা পড়তে পড়তে চোখ ভিজে আসে নিজের অজান্তে। অন্নের খোঁজে গিয়ে বুলবুলি ধর্ষিতা হয়। কী ভয়ানক একসময়ের কথা লিখেছেন মিলন। ভাইবোন কামারবাড়ি গিয়ে কিছু পায় না। বড় সড়কের ধারে যে পুরোনো দেবদারু গাছটি, তার ছায়ায় যেতে গিয়ে তারা সেই লোকটিকে দ্যাখে, যে এক বস্তা চাল নিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিল ছায়ায়। গঞ্জে চাল লুট হয়েছে, সে এক বস্তা পেয়েছে। চাল দেখে বুলবুলির লোভ হয়। চাল, থালা-বাসন ভর্তি ভাত, অন্ন। লোকটি ক্ষুধার্ত দীনুকে চার আনা দিয়ে বাজারে বিস্কুট খেতে পাঠিয়ে বুলবুলিকে চালের লোভ দেখিয়ে জঙ্গলে টেনে নিয়ে যায়। বুলবুলি বাধা দেয়নি। তার চোখে ভাতের স্বপ্ন। তারপর আড়াই সেরের মতো চাল বুলবুলির আঁচলে ঢেলে দিয়ে চলে যায়। দীনু ফিরে দ্যাখে চাল পেয়েছে দিদি। লোকটা চাল দিয়েছে দিদিকে। উল্লসিত হয় সে ভাতের স্বপ্নে। তখনই দ্যাখে দিদির কাপড়ে রক্ত। ‘বুবু তোমার কাপড়ে দিহি রক্ত! এত রক্ত বাইর অইল কেমনে!’
বুলবুলি বলে, একবার ধান কাটতে গিয়ে তার বাবার আঙুল কেটে কত রক্ত বের হয়েছিল। পেট ভরে ভাত খেতে একটু রক্ত দিতে হয়... ‘আমিও আইজ পেড ভইরা বাত খাইওনের লেইগা রক্ত দিছি। এইডি হেই রক্ত...’
মিলন অতি সাধারণ নিরুপায় মানুষের কথা জানেন। লেখেন। তাঁর গল্প পড়লে ধরা যায় মানুষের প্রতি গভীর মমত্ববোধ তাঁকে লিখিয়ে নেয়, মানুষ কাঁদছে বা নেতা যে রাতে নিহত হলেন—এর মতো অসাধারণ সব গল্প। এই দুটি গল্প পড়লে চেনা যায় একজন অতি আধুনিক গল্প বলিয়েকে। যিনি কীভাবে গল্প বলতে হয়, তার কত রকমই না জানেন। আমি বলছি আঙ্গিকের কথা।
‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ গল্পটি পড়লে ধরা যায় গল্পটি যত না এক ভয়ানক হত্যাকাণ্ডের তার চেয়ে বেশি ভালোবাসার। নেতার প্রতি ভালোবাসা। মিলনের ভালোবাসা আছে বাংলাদেশের স্রষ্টা শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি। তা তিনি প্রকাশ করেছেন অতলস্পর্শী করে। ‘মানুষ কাঁদছে’ গল্পটি অনেক মানুষের অনেক কান্নার গল্প। সেই গল্পের এক সামান্য ঠিকেদারের সামান্য কর্মচারী নিহত শেখ মুজিবের জন্য কাঁদে। কত রকম দুঃখ নিয়ে মানুষ বেঁচে থাকে, সেই সব দুঃখ নিয়ে কাঁদে। ‘নেতা যে রাতে নিহত হলেন’ গল্পে সন্দেহভাজন একটি লোককে থানায় ধরে এনেছিল পুলিশ। সে নেতার বাড়ির উল্টোদিকে বসেছিল। কেন তা গুছিয়ে বোঝাতে পারে না। পুলিশের সন্দেহ সে নিশ্চয় কোনো মতলবে গ্রাম থেকে শহরে এসে নেতার বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করছিল। লোকটির সঙ্গে পোঁটলায় কী আছে, না চিড়ে। তার বাড়ির নামায় একচিলতে জায়গায় কালিজিরে ধান হয়েছিল সামান্য। তাতে পৌনে দুসেরের মতো চিড়ে হয়েছে। সেই সুস্বাদু চিড়ে নিয়ে সে নেতার কাছে এসেছে। নেতাকে সে বড় ভালোবাসে। গরিবের ভালোবাসা। পুলিশ বিশ্বাস করে না তার কথা। মনে করে লোকটা নিশ্চয় কোনো মতলব নিয়ে এসেছে। রতন মাঝি আল্লার নামে কসম খেয়ে বলে, সে নেতাকে দেখতেই এসেছে দূর মফস্বলের গ্রাম থেকে। সেই লোকটার চিড়ের পোঁটলা পুলিশ কনস্টবল নিয়ে নেয়। চিড়ের সুগন্ধে ঘর ভরে যায়।
থানার দারোগা বলে, ওই চিড়ে টেস্ট করিয়ে আনতে, তার সন্দেহ ওর ভেতরে কিছু মেশান আছে। লোকটিকে হাজতে ভরে দেওয়াও হলো। লোকটি হা-হুতাশ করতে থাকে, সে তো নেতার জন্যই চিড়েটা এনেছিল। পুলিশ তা নিয়ে নিল! থানার দারোগা সন্দেহ করেছিল, রতন মাঝি নেতাকে হত্যা করার জন্য এসেছে শহরে। পরদিন সকালে দারোগা ডেকে নেয় রতন মাঝিকে। বলে, তাকে আর আটকে রাখার দরকার নেই, কেন না তার প্রিয় নেতা আগের রাতেই নিহত হয়েছেন। সে এবার যেতে পারে। রতন মাঝি তখন বলে, না, তাকে আটকেই রাখা হোক, কেন না, ছাড়া পেলেই সে নেতার হত্যাকারীদের খুঁজে বের করে হত্যা করবেই। শোধ নেবে। মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। আদ্যন্ত রাজনৈতিক গল্প মিলন কী সহজভাবে লিখে দিলেন। প্রকাশ করলেন তাঁর ভালোবাসা।
বাংলাদেশের গল্প এটি, আবার এই গল্প পৃথিবীর যেকোনো ভাষার হতে পারে, এমনই এর সুগন্ধ। আমি তাঁর আর একটি গল্পের কথা বলি, ‘লোকটি রাজাকার ছিল’। এই গল্প লিখতে কলজের জোর লাগে। একটা লোককে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা ধরে এনেছে চোখ বেঁধে। জেরায় সে প্রথমেই স্বীকার করে নিল, হ্যাঁ সে রাজাকার। তাতে হয়েছে কী? তার অপরাধটা কী যে এইভাবে চোখ বেঁধে, হাত বেঁধে ধরে আনতে হবে। তাতে মুক্তি বাহিনীর লোক অবাকই হলো। এখন তো তাকে জেরা করে নদীর পাড়ে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারা হবে। মুক্তিবাহিনী ওই শাস্তিই দেয় রাজাকারদের। স্কুল ঘরে নিয়ে এসে তাকে জেরা হতে লাগল। লোকটার মুখ দেখলেই ধরা যায় নিবোর্ধ ধরনের। সে বুঝতে পারছে না কারা তাকে ধরে এনেছে হাত বেঁধে চোখ বেঁধে। এই সব ছেলেরা কারা? হ্যাঁ, চেরমেন সায়েব বলল, রাজাকার হলে টাকা পাবে আর চাল আটা পাবে। আর তা পেয়েছেও। রাজাকার হওয়ার পর তার বিবি বাচ্চার পেটে ভাত পড়ছে। সে এত দিনে একটু সুখের মুখ দেখেছে। বন্দুক সে পায়নি। লাঠি দিয়েছে চেরমেন সায়েব। পরে বন্দুক পেলেও পেতে পারে। সে নিচের তলার রাজাকার। লাঠি নিয়ে হাটে মাঠে, নদী ঘাটে ঘোরাই তো তার কাজ।
মুক্তিযোদ্ধাদের খবর পেলেই চেরমেন সায়েবকে জানিয়ে আসাই তার ডিউটি। চেরমেন সায়েব বলেছে, দেশের মালিক পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা লেগেছে। দেশের মালিকের পক্ষে যাওয়াই তো তার উচিত। তাই সে পাকিস্তান উদ্ধার করতে রাজাকার হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা কারা সে জানে না। তাদের সে চোখে দ্যাখেনি। চেরমেন সায়েবের কথায় তারা অতি খতরনাক। তারা পাকিস্তান শেষ করে দিতে চায়। একটি হতদরিদ্র মানুষের কথা এই গল্প। সে যখন শোনে তাকে যারা ধরে এনেছে তারাই মুক্তিযোদ্ধা, অবাক হয়ে যায়। এরা তো তার গ্রামের ছেলেদের মতো। মুক্তিবাহিনীর নেতার কাছে একটা বিড়ি চায় সে, বদলে সিগারেট পায়। সুখটান দিয়ে তার দারিদ্র্য, রাজাকার হয়ে কী লাভ হয়েছে সেই কথা বলতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধা তাকে তখন বোঝায় কেন মুক্তিযুদ্ধ। পাকিস্তানিরা কেন খারাপ। কী অত্যাচার করছে দেশের মানুষের উপর। সে পাকিস্তানি মিলিটারি দ্যাখেনি। তাদের গাঁয়ে তখনো পৌঁছায়নি। অবাক হয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সব শুনতে শুনতে উত্তেজিত হয়ে উঠতে থাকে। বলে, তাহলে তো পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশোদ্ধার করাই তার কাজ। রাজাকার হয়ে খুব খারাপ করেছে। রাজাকারদের শাস্তি হওয়া দরকার। মুক্তিযোদ্ধারা যখন বলে, রাজাকারের শাস্তি হলো, গুলি করে মেরে ফেলা, নদীর পাড়ে গিয়ে তা হয়, সে ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে বলে, তাহলে তাকে নিয়ে গিয়ে তাই করা হোক। কী অসামান্য এই গল্প বলা। অসহায়, নিরুপায় মানুষের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা, তাই এমন সব গল্প লিখতে পারেন।