কবি শামসুর রাহমান স্মরণে
জীবদ্দশাতেই কিংবদন্তি হতে পারেন কজন কবি? জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে, জাতীয় দিবসে এবং জাতির অর্জনকালে শামসুর রাহমান উদ্ধৃতিযোগ্য হয়ে ওঠেন তাঁর জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকেই সম্পাদক ও পাঠকদের চাহিদা মেটাতে তাঁকে লিখতে হয়েছে অজস্র। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাঁর কবিতায় পুনরাবৃত্তি চলে এসেছে, বিশেষ করে আশির দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে। দেশকালসমাজের এমন কোনো আলোড়িত বিষয় নেই যা তাঁর কবিসত্তাকে স্পর্শ করতে সক্ষম ছিল না। কবির জন্ম কোনো নির্দিষ্ট তারিখের মুখাপেক্ষী নয়; তবে কবির সামাজিক জন্মদিবস রয়েছে, যদিও কবিসত্তার জন্মমুহূর্তকে স্বয়ং কবিও যথার্থ শনাক্তিতে সক্ষম নন। তার প্রয়োজনও নেই। দিনক্ষণ বড় নয়, কবিজন্মটাই বড়। বিশেষ করে কুসংস্কারাচ্ছন্ন, কূপমণ্ডক একটি সমাজে। সেখানে কবির আগমন ঘটে আলোকবর্তিকা হিসেবে; যে আলো সুরুচি, সুশিক্ষা ও সুস্থতার দিকনির্দেশকারী।
এটি খুবই মহিমান্বিত বিষয় যে একটি সমাজে একজন কি দুজন বড় কবির জন্ম প্রত্যক্ষ করে একটি গোটা শতাব্দী। আবার তার পূর্ববর্তী শতকেই বড় সৌভাগ্যে মেলে প্রায় দশজন কবি-মহীরূহ। কবির মাতৃভাষায় লিখিত কবিতাঙ্গনে শুধু নয়, সমগ্র সমাজে, বলা ভালো, তাঁদের স্বদেশে সেসব কবির স্থান হয় বিশিষ্ট এবং সমীহের সঙ্গে স্মরণীয়। কবি শামসুর রাহমানের প্রয়াণের পর তাঁর প্রতিটি জন্ম ও প্রয়াণবার্ষিকীতে এ কথাগুলোর তাৎপর্য যেন আমরা নতুন করে অনুভব করছি।
আনুষ্ঠানিকতার আড়ম্বরে আড়ষ্ট, প্রচারসর্বস্বতার এই যুগে কবির যথাযোগ্য মর্যাদাদানে আমাদের কৃপণতা মাঝেমধ্যে প্রকট হয়ে ওঠে। শামসুর রাহমানের প্রয়াণের পর আমরা অত্যন্ত মর্মপীড়ার সঙ্গে প্রত্যক্ষ করেছি প্রধান কবির আসনটি অধিকার করার জন্যে অসুস্থ উল্লম্ফন ও প্রতিযোগিতা। কবি ও সমালোচক আবদুল মান্নান সৈয়দের সঙ্গে এক আলাপে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ‘কবিতার বাইরেও একটা সামাজিক বিচার থাকে, সমাজে একটা স্থান নির্দিষ্ট থাকে কবির। যেমন শামসুর রাহমানের ছিল। সেটা অনেক বড় ব্যাপার। আপনার কি মনে হয় সামাজিক সেই আসনটি পাওয়ার মতো আর কোনো কবি আছেন আমাদের সমাজে?’
উত্তরে মান্নান সৈয়দ বলেছিলেন : ‘এটা আর কারো দ্বারা সম্ভব নয়। তাঁর উচ্চতার কাছে আর সবাই বামনসদৃশ। এটা জমি দখলের ব্যাপার নয়। যদি কেউ বা কোনো কবি সেই আসন নেওয়ার জন্যে কূট প্রতিযোগিতা শুরু করেন, তবে সেটা হবে দুর্ভাগ্যজনক। কবিতাবিরুদ্ধ একটি কাজ।’
ওটা ছিল নষ্ট প্রবীণদের কসরৎ। কিন্তু নবীনদের বেলা? অনেক তরুণ-নবীন আছেন যাঁরা কবি শামসুর রাহমানের কবিপ্রতিভার মূল্যায়ন করতে গিয়ে অসম্মানজনক উক্তি করে বসেন। আজকের নতুন কবি তাঁর কবিসত্তার উদ্গমের উদ্যম ও অহংকার থেকে নিজেকে বাংলার শ্রেষ্ঠ কবি ভাবতেই পারেন। এটা থাকবে তাঁর অন্তরের গহিনে, সংগোপনে। এর সুদূরতম পরোক্ষ প্রকাশও হবে যে কোনো কবির জন্যেই অরুচিকর। উষরভূমিতে একটি উচ্চবিদ্যাপীঠ প্রতিষ্ঠা একেবারে প্রাথমিক কীর্তি। সেই জ্ঞানপীঠ থেকে শিক্ষার্জন করার পর তার শিক্ষক হতে পারা অর্জন বটে, তবে মহাকৃতিত্ব নয়। নবীন প্রভাষক আগামীতে তাঁর সমাজে অভূতপূর্ব সেই শিক্ষাগুরুর উচ্চতাকে অতিক্রম করতে সমর্থ হবেন কি না তার বিচারের জন্যে মহাকাল অপেক্ষমাণ। যাহোক, বাংলাদেশের কবিতায় কবি শামসুর রাহমানের মৌলিক অবদান নিয়ে এখানে খুব সংক্ষিপ্তভাবে কিছু কথা তুলে ধরছি।
কবিতায় শামসুর রাহমানের সামগ্রিক অর্জনের কথা সংক্ষেপে বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হবে যে তিনি এই অঞ্চলে প্রভাব সৃষ্টিকারী প্রাচীনত্বগন্ধী রিক্ত কাব্যভাষাকে হটিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন সুমার্জিত, আধুনিক, মুখের ভাষার কাছাকাছি নাগরিক কবিতার ভাষা। এই তাৎপর্যপূর্ণ কাজে তাঁর আগেও দু-তিনজন কবি বাংলাদেশে সক্রিয় হয়েছিলেন, তবে সফল পদরেখা প্রোথিত করেন তিনিই প্রথম। পরবর্তীকালে অনুগামী পান অনেক, অনুসারী সুপ্রচুর। ১৯৬০ সালে প্রকাশিত তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’ স্পষ্টতই বদলে দেয় বাংলা কবিতা বিশ্বকে। ভাষা, চেতনা, বোধ, আবেগ, বৈশিষ্ট্য সর্ববিচারে বাংলা কবিতার ঘটে পালাবদল। এখানে যে পাঁচটি উপাদানের কথা বলা হলো তার প্রতিটির ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন পৃথক পাঁচটি প্রবন্ধ-পরিসরের। আধুনিকতা, নান্দনিকতা, বিশ্বনাগরিকতা, মননশীলতা এবং বাস্তব ও কল্পনার সাংগীতিক সমন্বয় প্রতিটি ক্ষেত্রে কবি শামসুর রাহমানের অবদান এককথায় অসাধারণ।
তবে পরবর্তীকালে আমরা বিশাল শব্দভাণ্ডার গড়ে তোলা নতুন এক শামসুর রাহমানকে আবিষ্কার করি। এই শামসুর রাহমানের বর্ণনামূলক বাকভঙ্গি এমনই অবিকল্প হয়ে উঠেছিল যে তা স্বচ্ছন্দভাবে কবিতায় ধারণে সক্ষম ছিল বাংলার আধুনিক মানুষের যে কোনো বিষয় বা বক্তব্য। কবিতা যেন হয়ে উঠেছিল দিনানুদৈনিক ঘটনা, অনুভূতি কিংবা অনুষঙ্গের সহযাত্রী। ‘হরতাল’, ‘আসাদের শার্ট’, ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘দুঃস্বপ্নে একদিন’ কবিতার শিরোনামই বলে দেয় এর ভেতরকার বক্তব্য। সেই যে শামসুর রাহমানের কবিতায় স্বদেশের মুখচ্ছবি ফুটে ওঠার শুরু, তাতে আর ছেদ পড়েনি। বরং বিকশিত হয়েছে সর্ববিধ ও সর্বোচ্চ রূপ নিয়ে। স্বদেশের প্রতিটি বড় কম্পনে, ক্রন্দনে; অর্জনে, বিসর্জনে, আঁধারে ও আলোকছটায় সৃজিত ও স্পন্দিত হয়েছে তাঁর শব্দেরা। দেশ, দেশের মানুষ, চলমান সময়, কবিসত্তা- সব বেজে উঠেছে এক তানে, একাকার হয়ে গেছে সব। এভাবেই তো পাওয়া একাত্তরে ‘স্বাধীনতা তুমি’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা’; পঁচাত্তরের প্রেক্ষাপটে ‘ইলেকট্রার গান’; পুনরায় জলপাই রঙে দেশ ঢেকে গেলে ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’, ‘দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে’, ‘একটি মোনাজাতের খসড়া’ এবং এরশাদের স্বৈরশাসনকালে ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’, ‘একজন শহীদের মা বলছেন’, ‘গর্জে ওঠো স্বাধীনতা’, ২০০০-এর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ‘সুধাংশু যাবে না’সহ অনেক অনেক কবিতা।
ব্যক্তির প্রয়াণের পর আমরা ব্যক্তিত্বকে পূর্ণতায় বুঝে নিতে চাই। কবি-ভাবমূর্তির সঙ্গে সে অবয়ব সংযুক্ত হয়ে ব্যক্তিকে বিরাট ব্যাপ্তি দেয়। দেশের প্রধান কবির সম্মান আমরা দিয়েছি শামসুর রাহমানকে। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে, আরো স্পষ্ট করে বললে পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যে সেনাশাসন দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে, সেই বাংলাদেশে জাতির বিবেকের কণ্ঠস্বর আমরা শুনেছি শামসুর রাহমানের কবিতায়। দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনকে অনুসরণ করেছে তাঁর পঙক্তিমালা, জুগিয়েছে শক্তি ও প্রেরণা। মৌলবাদ ও স্বৈরাচারের সমান্তরাল উত্থানে বিপন্ন বিপর্যস্ত বাংলাদেশে আন্দোলনে সংগ্রামে শামসুর রাহমান গর্জে ওঠা শব্দে ও শারীরিক উপস্থিতির মাধ্যমে এমন একটি পর্যায়ে নিজেকে উত্তীর্ণ করতে সক্ষম হন, যেখানে পৌঁছাতে পারেন শতাব্দীতে একজন কি দুজন। তাঁর উজ্জ্বল অংশগ্রহণ নান্দনিক কবিতায় ও তীক্ষ্ণ প্রতিবাদে নিবিষ্ট পাঠক ছাড়াও ব্যাপক গণমানুষের হৃদয় স্পর্শ করে। তিনি হয়ে ওঠেন আইকন। সমৃদ্ধ শাণিত শৈল্পিক আইকন। বৃহত্তর সাংস্কৃতিক জগতের এক অসামান্য প্রতিভূ।
কবির অনুপস্থিতিতে কবির স্মরণে যে আয়োজন, তাতে স্বয়ং কবির এক ধরনের অনিবার্য উপস্থিতি থাকে। নতুন দিনের কাব্যানুরাগীরা সেখান থেকে ঠিকই পেতে পারে শিল্পের সুঘ্রাণ ও সৃষ্টির প্রেরণা। কবিতার বরমাল্য কবির জন্য এক অপার্থিব প্রাপ্তি। এই অর্জন অনেক বেশি খাঁটি ও মজবুত। প্রতিটি জন্মদিনে এবং প্রয়াণ দিবসে একেকটি জন্মান্তর ঘটে এমন কবিজন্মকে সংবর্ধিত করার মাধ্যমে আত্মিক শান্তিলাভ ঘটে কবিতার বরপুত্রদের। আর মাত্র চৌদ্দ বছর পরই কবি শামসুর রাহমানের জন্মশতবর্ষ উদযাপিত হবে। শামসুর রাহমানের আবির্ভাবের পর থেকে এক শতাব্দীকাল পরে এসে বাঙালি পেছনের দিকে ফিরে সগৌরবে বলবে, বিগত একশ বছরে আমরা পেয়েছি শামসুর রাহমানের মতো একজন বড় কবি, যাঁর উচ্চতাকে অতিক্রম করে যাওয়া আর কোনো কবির পক্ষে সম্ভব হয়নি। তাই আজ তাঁকে কুর্নিশ করছে বাংলার সকল কবি, কবিতাকর্মী এবং কবিতাপ্রেমী সুন্দর সুমার্জিত সত্তা।