সেলিম আল দীন : শিল্পের সমগ্রে পৌঁছানো
সেলিম আল দীনের অনেক দক্ষতার ভেতরে একটা ছিল কোনো কিছুর নাম দেওয়া। সেটা বিষয় হোক কি মানুষের নাম হোক। তাঁর নাটকগুলোর নাম খেয়াল করলেও সেটা দেখা যাবে—কত সাধারণ কিন্তু ব্যঞ্জনাময়। নামগুলোর যেন জ্যান্ত হয়ে লাফ দিচ্ছে—কেরামতমঙ্গল, কিত্তনখোলা, হাত হদাই থেকে বনপাংশুল, প্রাচ্য, স্বর্ণবোয়াল, ধাবমান, পুত্র ইত্যাদি। নাম দেওয়ার আরেকটা দিকও আছে—নিজের আত্মীয়স্বজন, ভাইবোনের ছেলেমেয়েদের চমৎকার সব নাম রেখেছেন—শৌনক, আরাত্রিকা, কৃপাকণা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো কিছুর মটো তৈরি করা, স্লোগান বা কোনো ব্যাচের র্যাগ উপলক্ষে কোনো বাণী তৈরি করায় ছাত্রছাত্রীরা তাঁর কাছে ছুটে যেত। আমাদের র্যাগের স্লোগান তিনি ঠিক করে দিয়েছিলেন—রুখো অন্যায়, দাঁড়াও ঊর্ধ্বশির। বোঝাই যায়, তাঁর দেওয়া এই কথাগুলো কেবল একটা সময়ে আবদ্ধ থাকে না, সেটা বেঁচে থাকার সঙ্গে, জীবনযাপনের সঙ্গে চিরদিনের জন্য জড়িয়ে যায়। এটা তিনি সহজেই পারতেন, কারণ তাঁর সাধনা ছিল চিরদিনের হয়ে ওঠার সাধনা। একদিন বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাহিত্যের কাগজের নাম রাখেন ‘সাধনা’, আর বুদ্ধদেব বসুরা রাখেন ‘কবিতা’। এই নাম দেওয়ার জায়গা থেকেই মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিটা বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ করেছেন অখণ্ডের সাধনা। আর পরের প্রায় সবাই খণ্ডিত হয়ে গেছে।
সেলিম আল দীন এই খণ্ডনের ভেতরে নিজেকে দেখতে চাইতেন না বলেই নিজের যে চর্চার ক্ষেত্র—বাংলা নাটক—সেটিকে আর নাটক বলতে চাইছিলেন না। তিনি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী তত্ত্বের পুনর্জাগরণ চেয়েছিলেন। তিনি বলতেন, সাহিত্যে আমি দ্বৈতাদ্বৈতবাদী। অনেকেই ভুল বোঝেন; মনে করেন, তিনি সাহিত্যের নতুন তত্ত্ব দিতে চেয়েছেন। তিনি ঐতিহ্যেরই আধুনিকায়ন চেয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, যেকোনো রকমের খণ্ডনের বিপরীতে অবস্থান গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন।
একের মধ্যে বহু, বহুর মধ্যে এক। এটা তো নতুন কোনো দৃষ্টি নয়। একটি সাহিত্যকর্ম একই সঙ্গে কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ সে সঙ্গে এতে নৃত্যকলা, চিত্রকলা আরো যা যা সংযোজিত হয়ে থাকে—সব মিলিয়ে শিল্পকর্মকে একটা ‘সামগ্রিক’ বা ‘টোটাল আর্ট’ হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। আর্ট বিষয়টি কোনোভাবেই যেন খণ্ডিত না হয়—এটা তাঁর শিল্পপ্রত্যয়ের মূল দিক।
গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে মারিও ভার্গাস ইয়োসার এক আলাপে তাঁরা একমত ছিলেন যে, লাতিন আমেরিকায় তাঁরা ‘টোটাল নভেল’ লিখতে চেয়েছিলেন। আমরা জানি, উপন্যাস নিজেই একটা বিশেষ সামগ্রিকতার বাহক, সেখানে আবার আলাদা করে সামগ্রিকতা কেন? সেটি এ জন্য যে, কোনো দিকের প্রতি পক্ষপাত নয়, জীবনের সমগ্রে যেতে হলে ডান-বাম-মধ্যম-উগ্র-শান্ত কিংবা ভালো-মন্দ-মিশ্র বা সাদা-কালো-ধূসর—এসব মিলে জীবনকে দেখার জন্য একটা দৃষ্টি চাই। কোনো একটা কিছুতে একাট্টা হয়ে থাকা নয়, বহু পথ ও মতের বাস্তবতা দেখা ও দেখানোর ভেতর দিয়েই সেটা আয়ত্ত করা যেতে পারে।
সেলিম আল দীন বাংলা নাটককে ওই ‘টোটাল নাটক’ করতে চেয়েছিলেন। কারণ, নাটক ক্রমে খণ্ডিত হয়ে যাচ্ছিল। ইউরোপীয় আধুনিকবাদের মারে বাংলা নাটকের প্রসেনিয়াম থিয়েটার-রূপ ধারণ করার পর থেকেই একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে যেতে শুরু করেছে বলে তাঁর মনে হয়েছিল। একমাত্র রবীন্দ্রনাথ সেই মৃত্যুকে রোধ করতে পেরেছিলেন। তাঁর নাটককে ইউরোপীয় আধুনিকবাদের গ্রাস থেকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন। সেটা রবীন্দ্রনাথ কী করে করেছিলেন, তা তো অন্য আলাপের ব্যাপার। আমরা সেলিম আল দীনের দিকটাই বরং দেখতে চেষ্টা করি।
সেলিম আল দীনও অ্যাবসার্ডধারায় কয়েকটি নাটক দিয়ে শুরু করলেও দ্রুতই বুঝতে পারেন, এটা পরের জিনিস। সেটা না হবে নিজের বসন, না হবে নিজের ভূষণ। তাই দ্রুত নিজের পথ খুঁজতে গিয়ে তাঁর পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি সেসব চিরন্তন বিষয়ের দিকে এগোতে থাকেন, যা সব সময়ের বিষয়, যা কখনো পুরোনো হয় না। এই চির নূতনের প্রেরণা তিনি রবীন্দ্রনাথের কাছে, ফেরদৌসীর কাছে এবং হোমারের কাছে পান। প্রাচ্য, মাধ্যপ্রাচ্য আর পাশ্চাত্য মিলে তিনি নতুন সেই পথের দিকে পান ভর্জিল, ওভিদ আর দান্তেকে। অন্যদিকে আধুনিক বর্ণনামূলক ধারার প্রেরণা আধুনিক নাটকে ব্রেখটের কাছেও বোধ করি পান। ব্রেখটের এপিক থিয়েটার আর সেলিম আল দীনের ‘মহাকাব্যিক বাস্তবতা’ (কেরামতমঙ্গল, কিত্তনখোলা, হাত হদাই দিয়ে) মধ্যে কিছু তফাত তো আছেই। তিনি ভিন্ন কিছু খুঁজছিলেন। তাঁর নিজের মতো কিছু। নজরটা সব সময় এপিকের দিকে। কারণ তিনি বোধ করতেন কোনো কিছুকে মিথিক্যাল হাইট বা পৌরাণিক উচ্চতা দিতে না পারলে তা সময়ের শ্যাওলাতে মুছে যায়, আড়ালে পড়ে যায়। এ জন্য পরে ‘কাঠামোগত মহাকাব্যে’র দিকে যাত্রা (যেটা বনপাংশুল ও প্রাচ্যের মাধ্যমে) শুরু করেছিলেন। আবার তাতে যোগ করতে চাইলেন ‘সম্মুখ-বাস্তবতার’ তত্ত্ব। তিনি বলতেন ‘ফোর রিয়ালিটি’। ‘নিমজ্জন’-এর ভেতর দিয়ে এটিও পখর করলেন। মঞ্চের জন্য প্রায় অসম্ভব এর আখ্যানভাগকে তিনি এমন এক বৈশ্বিকমাত্রা দিতে চেয়েছেন, যা ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, দেশ-কাল-জাতি-গোত্র সব পার হয়ে যায়, সমস্ত ভেদ দূর হয়ে যায়।
নাটকের অঙ্কভাগ ভেঙে, প্রবেশ-প্রস্থান দূর করে, বর্ণনা এবং চরিত্রের সীমামুক্ত হয়ে তিনি ওই টোটাল নাটকটিও চাইছিলেন। মাঝখানে থাকা কথানাট্য ( চাকা, যৈবতী কন্যার মন ও হরগজ) থেকেই আসলে তিনি মঞ্চের কথা, অভিনয়ের কথা আর বিবেচনায় রাখেননি। রবীন্দ্রনাথের ‘রঙ্গমঞ্চ’ প্রবন্ধে যে হৃদয়মঞ্চ—যে মঞ্চে জায়গার কোনো অভাব নেই; সে সঙ্গে পিটার ব্রুকের ‘এমপ্টি স্পেস’ তত্ত্ব—এসব তাঁর সেই কাজে প্রেরণা দেয়। ফলে তিনি ‘মধ্যযুগের বাঙলা নাট্য’ নামের যে বিশাল গবেষণা করেন, সেখানেই মূলত পাঁচালী রীতির পদ্ধতি ও কাঠামো বিষয়ে নতুন প্রত্যয়ে অভিষিক্ত হন।
আসলে আমরা দেখব, তিনি বারবার তাঁর নাটকের কাঠামো বদলের চেষ্টা করেছেন; উপস্থাপনরীতির নতুন বিন্যাস তৈরি করতে সচেষ্ট থেকেছেন। এর কারণ মনে হয়, তাঁর নিজের নান্দনিকবোধ তাঁকে বারবার তাগাদা দিয়েছে পুনরাবৃত্তি না করার। তিনি সেটা করতে না চাইলেও রচনাকে পৌরাণিক উচ্চতায় রচনাকে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তাঁর ভেতর থেকে কখনো হারিয়ে যায়নি। এবং তিনি প্রান্তিক মানুষগুলোকেও যে-চরিত্রে হাজির করতে চেয়েছেন, তা যেন এস্কাইলাস-সফোক্লিস বা গ্যেটের নাটকের চরিত্রগুলোর চেয়ে কোনো অংশে হীনতর না হয়—এই ‘সৃজন-উদ্বেগ’ও তাঁর নিত্যসঙ্গী হয়ে থেকেছে।
প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাহিত্যপাঠ, সাহিত্যের শিক্ষক হওয়া, ঢাকা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা, গ্রাম থিয়েটার গড়ে তোলা এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি নিজেই আসলে একা একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছিলেন। বিরোধীমতের লোকরা তাঁর রচনাকে অগ্রাহ্য করেছে। হেয়ও করেছে। কেউ কেউ তাঁকে নাটক নিয়ে স্বেচ্ছাচারের দায়ে অভিযুক্তও করতে চেয়েছে। কিন্তু সমস্ত কিছু অতিক্রম করে সেলিম আল দীন তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে অব্যাহত রেখেছিলেন। কারণ প্রকৃত শিল্পী নিজের ভেতরের তাড়না ছাড়া বাইরের কোনো শর্ত মেনে চলেন না; বরং সেসব মেনে চলতে গেলেই তিনি তাঁর নিজের পথ থেকে সরে যান। তিনি আবার এসব শর্তও যে পুরো মেনে চলেছেন তাও না। তাঁকে টিভি নাটক লিখতে হয়েছে, বিজ্ঞাপনচিত্রের স্ক্রিপ্টের কাজ করতে হয়েছে, করতে হয়েছে এমন ফরমায়েশি হাজারো কাজ। লিখতে হয়েছে উপলক্ষের লেখা, আর পত্রপত্রিকার ফরমায়েশি লেখালেখি তো আছেই। তবে ফরমায়েশি কাজটাও তিনি নিজের করে নিতেন, সেটির শিল্পসুষমা এবং তাতে কোনো না কোনো নতুনত্ব তিনি আনার চেষ্টা করতেন।
সেলিম আল দীন নিজের একটা ভাষাভঙ্গিও তৈরি করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন নিজস্ব বয়ানকৌশল। তাঁর লেখার যেকোনো অংশ পড়ে, যে পাঠক তাঁর লেখাতে মগ্ন হতে পেরেছেন, নতুন কোনো লেখা যা, কে লিখেছে জানা হয়নি, সেটিও পড়ামাত্রই বুঝতে পারবেন এটি তাঁর লেখা। তাঁর গদ্যে তৎসম-তদ্ভবের মাত্রা একটু বেশি। এটাও তাঁর প্রাচীন-সাহিত্য, ক্ল্যাসিক সাহিত্যের প্রতি দুর্বলতার কারণে ঘটেছে বোধ করি। তবে তাঁর সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। আদতে বাংলা নাটকের আদি উৎস সন্ধান করতে গিয়েই তিনি এতে আরো বিশেষভাবে নিমগ্ন হয়েছিলেন।
একজন সৃজনশীল লেখক হওয়ার পরও মননশীল লেখা তো বটেই গবেষক হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন তিনি। আর শিক্ষকতার কারণে সেটি তাঁকে করতেও হয়েছে। সে কারণে সাহিত্যের তত্ত্ব ও সূত্র নিয়ে ভেবেছেন; ভেবেছেন এর প্রয়োগকৌশল নিয়ে। সে সঙ্গে নতুন নতুন তত্ত্বীয় বিষয়ও তাঁর চিন্তা থেকে উদ্ভূত হয়েছে। তুলনামূলক সাহিত্যের ধারায় তিনি তুলনামূলক নাটক ও নাট্যতত্ত্বের কথাও ভেবেছেন। এ নিয়ে নিজে ও অন্যদের কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বিরাট এক অনুপ্রেরণাশীল সত্তার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু বিশ্বাস করতেন পরিশ্রমে। প্রতিভা মানে যে, এক ভাগ অনুপ্রেরণা আর নিরানব্বই ভাগ পরিশ্রম, সেটি তিনি তার জীবনের ফলিয়েছিলেন। নিজেও তাঁর অনুগামী ভক্ত এবং পাঠক, দর্শকদের সঙ্গে যেকোনো রকমের সাক্ষাতে একজন অনুপ্রেরণাময় মানুষ হয়ে উঠতেন। ভালো বই পড়া, বিশেষ করে ক্ল্যাসিক সাহিত্য পড়ার জন্য সবাইকে বলতেন। তাঁর আলাপে বারবার ফিরে আসতেন হোমার, গ্যেটে, রবীন্দ্রনাথ ও তলস্তয়। কখনো কখনো ফেরদৌসী। বোধ করি এঁদের লেখা থেকে নিজেও প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত হতেন। সমকালীন সাহিত্যের প্রতি আকর্ষণ অপেক্ষাকৃত কমই ছিল। রামায়ণ-মহাভারতের মতো বইপত্রের সঙ্গে নিত্য থাকতে চাইতেন।
তার পরও লেখক হিসেবে তাঁর দ্বৈতজীবন ছিল। ছিল মানুষ হিসেবেও। ভাঙা প্রেম অশেষ-বিশেষ এবং তাঁর দিনলিপিতে এই সত্তাগুলোর দেখা মিলবে। প্রেম-ভালোবাসা এবং জীবনের উষ্ণতার বা উষ্ণ-জীবনের প্রতি আমর্ম দুর্বলতা ছিল। মানুষের সবচেয়ে গভীর ও তীক্ষ্ণ বিষয়াদির একটা হলো শরীর ও যৌনতা—সেসবও তাঁর লেখায় বারবার ফিরে এসেছে। কারণ কোনো সৎ শিল্পী জীবনের প্রকাশ্যে বা আড়ালে থাকা যে যে বিষয়গুলো মানুষকে তাড়িত করে, তাদের এড়াতে পারেন না। তাই প্রবল এক যৌনতাবোধ এবং একই সঙ্গে প্রতিরোধ্য এক মৃত্যুবোধ তাঁর স্বভাবে স্বয়ংক্রিয় ছিল।
আদতে বহু কিছু নিয়েই এক সেলিম আল দীন। বা এক সেলিম আল দীন মানেই একের ভেতরে বহু। ফলে তিনি নিজেই ছিলেন এক দ্বৈতাদ্বৈতবাদী অস্তিত্ব। এই সৃষ্টিশীলতা তাঁর স্বভাবগত এবং জন্মগত। কিন্তু প্রচণ্ড পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি সেটাকে ধরে রেখেছিলেন। তাঁর জন্মদিন, ১৮ আগস্ট, এসব বিষয়ই আমাদের স্মরণে আনে।