আমার শিক্ষক সেলিম আল দীন
২০০৬ সালের ঈদুল আজহার কয়েক দিন আগের কথা। আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্ট অফিসে যাই মানি অর্ডার করার জন্য। আমি মানি অর্ডারের ফরম পূরণ করে ফরম ও টাকা হাতে পোস্টমাস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। পোস্টমাস্টার সাহেবের পাশের চেয়ারে বসা একজন সুন্দর চেহারার ভদ্রলোক হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, টাকা কার জন্য পাঠাচ্ছ? স্বল্প উত্তরে বললাম, মায়ের জন্য। আবার জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করো? বললাম, পড়ি। আবারো জিজ্ঞেস করলেন, পড়! টাকা পাঠাচ্ছ কী করে? উত্তরে বললাম, টিউশনি করি। তিনি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন এবং পোস্টমাস্টারের দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলতে লাগলেন, দেখছ! দেখছ! ছেলেটা টিউশনি করে, পড়ালেখা করে এবং মায়ের জন্য টাকা পাঠায়!
হ্যাঁ, আমি টিউশনি করে পড়ালেখা ও নিজের খরচ চালিয়ে তা থেকে কিছু টাকা প্রতি মাসে মায়ের কাছে পাঠাতাম। আমার কথা শুনে ভদ্রলোক আমাকে বললেন, তোমার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা দাও। আমি একটু দ্বিধায় পড়ে গেলাম। ঠিক তখনই পোস্টমাস্টার সাহেব আমাকে বললেন, তুমি উনাকে চেন না? উনি হলেন, বিশিষ্ট নাট্যকার ড. সেলিম আল দীন। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোন বিষয় ও কোন পর্বের ছাত্র? আমি বললাম, সরকার ও রজনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। তখন উনি বললেন, তৃতীয় বর্ষে পড়ো আর আমাকে চেন না? প্রত্যুত্তরে বললাম, স্যার, আপনার নাম শুনেছি; কিন্তু দেখিনি, সরি স্যার। তখন আমার ঠিকানাটা একটি সাদা কাগজে লিখে দিলাম। স্যার বললেন, তুমি প্রতি মাসের ১ থেকে ৫ তারিখের মধ্যে আমার ডিপার্টমেন্টে দেখা করবে। ঈদের পরের মাসের ৩ তারিখে স্যারের ডিপার্টমেন্টে গেলে প্রথমে আমাকে চিনতে পারেননি। যখন বললাম, স্যার, আপনার সঙ্গে আমার পোস্টঅফিসে দেখা হয়েছিল। তখন স্যার বললেন, ও! তুমি টিউশনি করে খরচ চালাও, তাই না? আমি বললাম, জি স্যার। স্যার আমাকে বসতে বললেন। আমি বসলাম। কিছুক্ষণ পর স্যার পকেট থেকে ঈষৎলাল একটা পাঁচশ টাকার নোট আমার হাতে দিয়ে বললেন, তুমি এভাবে প্রতি মাসে এসে আমার কাছ থেকে পাঁচশ টাকা নিয়ে যাবে। আমি অবাক হলাম! কী মহৎ হৃদয়ের মানুষ। আমি কিছুক্ষণ পর পাঁচশ টাকার নোটটা স্যারের হাতে দিয়ে বললাম, আমি এভাবে টাকা নিতে পারব না। স্যার বললেন, কেন? আমি বললাম, টাকা নেব। তবে কোনো কাজের বিনিময়ে। স্যার মুচকি হেসে বললেন, ঠিক আছে, তুমি শুক্রবার বাসায় এসো। তখন টাকা নিয়ে স্যারকে সালাম দিয়ে চলে এলাম। শুক্রবার প্রথম স্যারের বাসায় যাই। বাসায় ঢুকে স্যারকে সালাম দিয়ে দেখি, স্যারের কয়েকজন ছাত্রছাত্রী স্যারের কাছে কী যেন তালিম নিচ্ছে। আমার সালামের উত্তর দিয়ে স্যার বললেন, বসো। কিছুক্ষণ পর পকেট থেকে একশ টাকার একটা নোট দিয়ে বললেন, প্রান্তিক গেট থেকে এক প্যাকেট ব্যানসন সিগারেট নিয়ে আসো। মুহূর্তের মধ্যেই প্রান্তিক গেট থেকে সিগারেট নিয়ে এলাম।
কিছুক্ষণ পর আবার একটা পাঁচশ টাকার নোট দিয়ে বললেন, নবীনগর বাজার থেকে দুইটা ছোট্ট দেশি মুরগি নিয়ে আসতে। আবারো স্বল্প সময়ের মধ্যেই নবীনগর গিয়ে দুইটা মুরগি নিয়ে এলাম। মুরগি কেনার পর বাকি টাকা ফেরত দেওয়ামাত্রই স্যার বললেন, আজকে তোমার ছুটি। এভাবে প্রতি শুক্রবার স্যারের বাসায় আসা-যাওয়া করি। স্যারের ভালো অভ্যাসের মধ্যে অন্যতম হলো, ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজেই চা তৈরি করে পান করতে করতে লেখা এবং লেখা শেষে নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র শাজাহান ভাইয়ের সঙ্গে সকালবেলা হাঁটা। আর সন্ধ্যার সময় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্র মিজান ভাইয়ের সঙ্গে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে হাঁটতেন।
একদিন মিজান ভাই আমাকে বললেন, জিয়া, স্যার বলেছেন এখন থেকে স্যার তোমার সঙ্গে হাঁটবেন। পরের দিন সকালবেলা থেকে স্যারের সঙ্গে পুরো ক্যাম্পাসে হাঁটতাম। দিনের পর দিন স্যারের বিশ্বস্ত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে আমি অন্যতম হয়ে উঠলাম। তাই স্যার এবার আমাকে তাঁর বাসায় থেকে পড়ালেখা করতে বললেন। স্যারের বাসায় থাকা শুরু করলাম। স্যারকে রাতের খাবার খাওয়ানোর পর আমি ও স্যারের স্ত্রী মেহেরুন্নেসা (পারুল) ম্যাডামসহ একসঙ্গে খেতাম। তারপর স্যার ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পর ঘুমাতে যেতেন। আগেই বলেছি, স্যার খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠতেন। ঘুম থেকে উঠে নিজেই চা তৈরি করে পান করতে করতে লিখতেন। কিছুক্ষণ পর আমাকে ডাকতেন, জিয়া উঠো, হাঁটতে যাব। আমি ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে হাঁটতে যেতাম। হাঁটা শেষে স্যারসহ সপ্তাহে দুদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হলের পশ্চিমে অবস্থিত গেরুয়া বাজারে যেতাম। সেখান থেকে স্যারের প্রিয় সবজি বাঁধাকপি, পেঁপে, বিলেতি আলু, পটোল, ঝিঙে—এগুলো কিনতাম। স্যার মাংসের চেয়ে মাছ বেশি পছন্দ করতেন। তাই বাজার থেকে স্যারের পছন্দের মাছ (শিং, মাগুর, টেংরা, মোয়া, বাইন গোছি, কৈ) আনতাম। বাসায় এসে স্যার গোসল করতেন। তাঁর নাশতা (রুটি ও সবজি, ডাল) খেয়ে কিছুক্ষণ ঘুমাতেন। ঘুম থেকে উঠে ডিপার্টমেন্টে যেতেন। আমিও স্যারের সঙ্গে নাশতা খেয়ে নিজ হলে (মীর মশাররফ হোসেন) আসতাম। তার পর ডিপার্টমেন্টে যেতাম। দুপুরবেলা হলে খেয়ে আড়াইটার বাসে ঢাকায় যেতাম টিউশনি করার জন্য। ঢাকা থেকে রাত ৯টায় ফিরে আবার স্যারের বাসয় যেতাম। স্যার পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ভালোবাসতেন তাঁর পালিত কন্যা অন্বীতাকে। অন্বীতা যখন ভারতে গেল চিকিৎসার জন্য, তখন সারাক্ষণ স্যার অস্থির হয়ে থাকতেন। ভারতে বারবার ফোন দিতেন অন্বীতার খবর নেওয়ার জন্য। অন্বীতার মৃত্যুর পর স্যার সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছেন এবং মাঝেমধ্যে ঝিমিয়ে থাকতেন। স্যার সবচেয়ে বেশি ভয় পেতেন ঠান্ডাকে। যে বছর স্যার একুশে পদক পেলেন, সে বছর ২১ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টায় ঠান্ডার ভয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারে ফুল দিতে যেতে চাইলেন না। আমি বললাম, স্যার, আপনি একুশে পদক পেলেন আর ফুল দিতে যাবেন না, তাই কী হয়? স্যার বললেন, ঠিক বলেছিস। যা অন্বীতাদের বাসা থেকে আমার চাদরটা নিয়ে আয়। অন্বীতাদের বাসা থেকে স্যারের চাদরটা আনলাম এবং দুজনে শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে বাসায় ফিরলাম। স্যার আমাকে ছেলের মতোই ভালোবাসতেন। তাই অনেক সময় সন্তানের কথা শুনতেন। যেমন তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যেতেন, ঘুমের ওষুধ খাওয়ার পর আর সিগারেট খেতেন না। স্যার অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। আমি কখনো কোনো অন্যায় কাজ করতে দেখিনি। তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘জিয়া পৃথিবীর কারো জন্য কিছু না করলেও আমি তোর জন্য করব।’ কিন্তু তাঁর এই স্বপ্নটা পূরণ হওয়ার আগেই এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন। কিছু স্মৃতি মানুষ সহজে ভুলে না। মুহুর্মুহু স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে জ্বলন্ত দিব্যজ্জ্বল বর্তমানের মতো। আমি দোয়া করি, স্যারের আত্মা শান্তি পাক এবং তিনি যেন জান্নাতবাসি হোন।