ত্রিপুরা বিয়ে
জলপূর্ণ কলস নৃত্য আনন্দ উদযাপনের
বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতা, প্রীতিভোজ, পূজা ও নৃত্যগান শেষে বাড়ির মা ও খালারা বরণ ডালায় ধান, দূর্বা ঘাস দিয়ে মাঙ্গলিক আচার করে নববধূকে বরণ করে নেন। এ সময় ত্রিপুরা গান গায়—
নোকখুং নোক লক্ষি হামজুকয়া সাজুকসে (নোকখুংনি মালিক)—নকসে
(মাইরাংনি মালিক—নকসে)
অতিগর্বা ফায়ৗইবো হায়া চায়া
অংগৗইবো
গালনি কাচার অংগীইবো
ঘরনি কাচার ফায়ৗউবো নোকাখুং নোক লক্ষি নকসে—
ঔগো মাইক্রৗই মাই রনাই
খা তৗই ক্রৗই তৗই রনাই
জগত সংসারনৗ পালি নাই
ঘায়া চায়ানৗ রুজুল নাই
নোক খুং নোক লক্ষি নকসে।
ভাবার্থ :
গৃহলক্ষ্মী মা গো তুমি নাও পর কন্যা। তুমি আমাদের নন্দিনী, শান্তি প্রদায়িনী। যদি আসে অতিগর্বা, দিন দুপুরে কিংবা রাত্রের গভীরে কেউ তোমার সেবা থেকে বঞ্চিত হবে না। তুমি তৃষ্ণা নিবারনী অন্ন ধাত্রী, জগত পালিনী, বিপদ বারণী। তুমি নন্দিনী শান্তি প্রদায়িনী মা।
ত্রিপুরা সমাজে বিয়ের দুদিন পর বর ও কনের সঙ্গে আত্মীয়স্বজনদের একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। এ আদিবাসীরা একে-বেলাও জেখমা বলে। নিয়ম অনুসারে এ অনুষ্ঠানের যাবতীয় খরচ বরকেই বহন করতে হয়। তবে বর্তমানে ত্রিপুরা সমাজে বিয়ের এই আদি রেওয়াজগুলোর অনেকটাই পরিবর্তন ঘটেছে।
আবার ত্রিপুরাদের হালাম সমাজে বিয়ে ঠিক হলে পঞ্জিকা দেখে রাশি গণনার মাধ্যমে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করা হয়। এদের বিয়ের আগের দিন বরকে দলবেঁধে কনে বাড়িতে যেতে হয়। আবার বিয়ের পর দুদিন বরযাত্রীসহ কনের বাড়িতে থেকে কনেকে বরের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু আদিতে হালামদের বিয়ের আগের দিন কিছু লোক কনেকে বরের বাড়িতে নিয়ে এলে কনেকে একটি আলাদা ঘরে রাখা হতো। তার পরের দিন বরের বাড়িতেই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করা হতো। কলই হালামদের ভাষায় ওই বিয়েকে-হামজুক কমন বলা হয়। তবে বর্তমানে হালামরা ব্রাহ্মণ দিয়েই বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করে থাকে।
বিয়ে উপলক্ষে ত্রিপুরার কাথারক নামক পূজা করে থাকে। অচাই বা পুরোহিত বর-কনের কল্যাণ, শান্তি ও সুখ সমৃদ্ধি কামনা করে এ পূজার আয়োজন করে। পূজার মূল উদ্দেশ্য থাকে মঙ্গল কামনা। তাই এটিকে অনেকেই মাঙ্গলিক পূজাও বলে থাকে। এই পূজার প্রধান বিষয় নৃত্য। পূজা শেষে কনে পক্ষের একজন ও বর পক্ষের একজন কেঞ্জু ও কেনা নাম ধারণ করে গলায় ফুলের মালা পড়ে, মাথায় বোতলের উপর দীপ শিখা জ্বালিয়ে ঢোলের তালে তালে নানা নান্দনিক ভঙ্গিতে নাচে। আবার বোতল মাথায় জলপূর্ণ কলসের ওপর বসানো পিতলের থালায় ভর করেও নৃত্য করে ত্রিপুরা আদিবাসীরা। এদের কাছে এই নৃত্য আনন্দ উদযাপনের প্রতীক। নৃত্যের উপকরণগুলোও ত্রিপুরাদের কাছে নানা অর্থ বহন করে। যেমন: জলপূর্ণ কলস কর্মের প্রতীক, মদের বোতল শৌর্য-বীর্য ও শক্তির প্রতীক, প্রদীপ শিখা জ্ঞানের প্রতীক, ফুলের মালা ভক্তির প্রতীক।
আবার বিয়েতে চুমলাই পূজা অনুষ্ঠিত হয় ত্রিপুরাদের ঘরের ভেতরে। লক্ষ্মী-নারায়ণ দেবতার নামে এ পূজার আয়োজন করা হয়। লক্ষ্মী-নারায়ণ যুগলকে ত্রিপুরা ভাষায় চুমলাই বা চুমলাং বলে। অনুপক্ষী ও বরাহ বলি দিয়ে এই পূজা শুরু করতে হয়। উপকরণ হিসেবে প্রয়োজন পড়ে তুলা দিয়ে তৈরি একটি ফুলের মালা, একটি বানা (পতাকা), এক সের আতপ চাল, এক সের ধান, খই, বাষ্পে সিদ্ধ করা কলা পাতার পিঠা, এক বোতল মদ, পাঁচ খণ্ড কাঁচা হলুদ, উথপ, মারাই, দিক, পিড়া, একখানা বস্ত্র ও বলির জন্য এক জোড়া অনুপক্ষী ও একটি বরাহ।
ত্রিপুরাদের সনাতন রীতি অনুসারে বিয়েতে বরপক্ষ কনেপক্ষকে দাফা বা নগদ অর্থ দিতে হয়। মা-বাবা কন্যাসন্তানকে অনেক কষ্ট করে ছোট থেকে বড় করেছেন। কন্যার পরিবারের আয়-উৎপাদনে সহযোগিতার উপযুক্ত সময় এখন। এ সময়ে তাকে বিয়ে দিতে হচ্ছে। তাই যে বরপক্ষ কনেপক্ষের পরিবারের কন্যাসন্তানকে বউ করে নিয়ে যাচ্ছে সেই কন্যার শিশু অবস্থা থেকে বর্তমান অবধি যে সব খরচ হয়েছে সে খরচ বর পক্ষকে দিয়ে যেতে হবে—এ হলো দফা রীতির মূল কথা। এ রীতি ত্রিপুরা সমাজে অনেক প্রাচীন। তবে বর্তমানে নানা সামাজিক পটপরিবর্তনের ফলে এ রীতির প্রচলন হ্রাস পেয়েছে।
এ আদিবাসী সমাজে বিধবা নারী যদি আর্থিকভাবে অক্ষম হন এবং তাকে যদি কোনো পুরুষ বিয়ে করতে রাজি হয়, তবে বিধবা বিয়ে হয়ে থাকে। স্বামী পরিত্যক্ত নারীও বিধবার ন্যায় এ রকম বিয়ে করতে পারেন। শুধু পুরোহিত বা অচাইয়ের মন্ত্রপাঠের মাধ্যমেই এ বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করা হয়। বিয়ের পর সামর্থ্য অনুযায়ী সামান্য ভোজেরও ব্যবস্থা থাকে। তবে সাক্ষী রেখে গন্ধর্ব বিয়ের মতো এ বিয়ে হয় না। ত্রিপুরা সমাজে বহু বিবাহ তেমন দেখা যায় না।
ত্রিপুরাদের গ্রামীণ সমাজে সালিশি বা গ্রাম্য বিচারকের মাধ্যমে বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটে থাকে। মেয়েদের ক্ষেত্রে স্বামী শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করলে, রীতিমতো ভরণপোষণ না দিলে, অন্য মহিলার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়লে, স্বামী নেশাগ্রস্ত প্রভৃতি কারণে বিয়ের বিচ্ছেদের জন্য গ্রাম্য বিচারককে জানাতে পারেন। তিনি অত্যন্ত দুইবার স্বামীর অঙ্গীকার নিয়ে বিষয়গুলো বুঝিয়ে সমাধান করার চেষ্টা করেন। তাতেও স্বামী সংশোধিত না হলে তিনি তার কাছ থেকে নির্দিষ্ঠ সময়ের জন্য নির্দিষ্ঠ পরিমাণ ভরণপোষণ আদায় করে বিয়ে বিচ্ছেদের ব্যবস্থা করে থাকেন। স্বামীর ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি ভালো আচরণ না করে, অন্য কোন পুরুষের সঙ্গে যদি গোপন সম্পর্ক গড়েন, কিছু লোকাচার যেমন—সন্ধ্যায় বাইরে যাওয়া, রাস্তায় চুল খুলে বসে থাকা প্রভৃতি কারণে বিয়ের বিচ্ছেদ চাইতে পারেন। এ ক্ষেত্রেও স্ত্রীকে দুইবার সর্তক করে শেষবার বিচ্ছেদ ঘটানো হয়।
ত্রিপুরা আদিবাসী সমাজে অবৈধ যৌন মিলনের মতো অপরাধে পাড়া প্রধান, মাতব্বর ও মুরব্বিগণ সালিশির মাধ্যমে সামাজিকভাবে নিষ্পত্তি করে থাকেন। সাধারণত অবৈধ যৌনাচারের জন্য সংশ্লিষ্ট পুরুষ ও নারীকে আর্থিক দণ্ড দিতে হয় এবং শূকর জবাই করে পাড়ার মুরব্বি ও লোকজনদের খাওয়াতে হয়। কিন্তু ধর্ষণের ক্ষেত্রে আর্থিক দণ্ড ও ভোজ ছাড়াও ধর্ষণকারীকে বেত্রাঘাত করে গলায় জুতার মালা ও শূকরের নাড়িভুঁড়ি পরিয়ে পাড়ায় হাঁটানো হয়। আবার অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত কোনো অবিবাহিতা মেয়ে যদি গর্ভধারণ করে তাহলে ছেলেমেয়ের বিয়ে দিয়ে পাড়ার লোকদের ভোজ খাইয়ে সমাজিক স্বীকৃতি নিতে হয়। এ ছাড়া বিবাহিত নারী গর্ভবতী হলে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে যার সঙ্গে সে যৌনাচারে লিপ্ত হয়েছে তাকে পাড়ায় ভোজের ব্যবস্থা করে পিতৃত্ব স্বীকার করে নিতে হয় এবং সন্তানের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করতে হয়। বিধবা ও তালাকপ্রাপ্ত নারীর ক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট পুরুষকে সন্তানের ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা ছাড়াও পাড়ায় ভোজের আয়োজন করা হয়।
বিয়ে নিয়ে ত্রিপুরা সমাজে বেশ কিছু লোকবিশ্বাস প্রচলিত রয়েছে। এরা বিয়েতে নবদম্পতির ভবিষ্যৎ জীবন কীরূপ হবে এর জন্য চমৎকার এক পরীক্ষা করে থাকে। এই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজন হয় কাঠাল ও বাঁশপাতার। পুরোহিত ডান হাতের মধ্যমা ও অনামিকা আঙুলের মাঝখানে দুটো পাতা রেখে হঠাৎ মাটিতে নিক্ষেপ করে। যদি পাতা দুটো একত্রে চিত হয়ে পড়ে তবে তাদের দাম্পত্যজীবন খুব সুখের হবে। আর যদি পাতা দুটো উল্টো হয়ে পড়ে তবে তাদের মধ্যে অমিল দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে ত্রিপুরা আদিবাসীরা বিশ্বাস করে।
ত্রিপুরা আদিবাসীরা বিশ্বাস করে, বিয়ের মাধ্যমে একটি সুখী পরিবারের সৃষ্টি হয়। তাই সৃষ্টিকর্তার কৃপা লাভের আশায় এরা বিয়ের আচারগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে থাকে। মূলত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমেই ফুটে ওঠে ত্রিপুরাদের আদি সংস্কৃতিটি। যুগে যুগে, যা সমৃদ্ধ করেছে আদিবাসী সাহিত্যকেও।