সুনীলের জীবন
জীবনানন্দ দাশের পরে বাংলা সাহিত্যে যে মানুষটি আরেক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যদিও বা বেড়ে উঠেছিলেন কলকাতায়, কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মস্থান এই বাংলাদেশেই। ১৯৩৪ সালের আজকের এদিনেই বাংলা আলো করে জন্মেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা-ব্যক্তিত্ব হিসেবে সর্ববৈশ্বিক বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর কাছে ব্যাপকভাবে পরিচিত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্মস্থান আমাদের মাদারীপুর জেলাতেই। জন্ম এ দেশে হলেও বেড়ে উঠেছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু ফরিদপুরের স্মৃতি তিনি কখনোই মুছে ফেলতে পারেননি। সেই প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমার শৈশবের কিছুটা অংশ পার করেছি এই মাইজপাড়া গ্রামে। বাকিটা সময় কেটেছে কলকাতায়। ছোটবেলায় বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে পাটক্ষেতে দৌড়াদৌড়ি করতাম, হারিয়ে যেতাম, গ্রামের পুকুরজলে সাঁতার কাটতাম। কাগজের ঠোঙা দিয়ে নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দিতাম। শৈশবের সেই স্মৃতিগুলো এখনো আমাকে প্রবল আনন্দ দেয়। আমার লেখালেখির শুরু কলকাতায় হলেও পূর্ববঙ্গের শৈশব-স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত। এটা লেখালেখির সূচনাপর্ব থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত আছে বলে মনে হয়।’
সুনীলের বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক। ব্যাংকের পিয়নের চেয়েও স্কুলশিক্ষকের বেতন ছিল কম। সুনীলের মা কখনোই চাননি তাঁর ছেলে শিক্ষকতা করুক। পড়াশোনা শেষ করে কিছু দিন তিনি অফিসে চাকরি করেছেন। তার পর থেকে সাংবাদিকতায়। আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের প্রধান কলকাতায় এলে সুনীলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। সেই সূত্রে মার্কিন মুলুকে গেলেন সুনীল ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে। ডিগ্রি হয়ে গেলে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপগ্রন্থাগারিক হিসেবে কিছুদিন কাজ করেন সুনীল।
সুনীলের কবিজীবন শুরুর কাহিনীটা বেশ মজার অবশ্য। তাঁর বাবা তাঁকে টেনিসনের কবিতা দিয়ে বললেন তা অনুবাদ করতে। অন্য ছেলেরা বাইরে আড্ডা মারত, আর সুনীল বিরক্তি নিয়ে বাবার আদেশ পালন করতে কবিতা অনুবাদ করতেন। সেই কবিতা অনুবাদ করতে গিয়েই সুনীল কবিতার প্রেমে পড়ে গেলেন। তারপর কবিতা লিখতে লিখতে কবি হয়ে গেলেন। ভাগ্যিস বাবা সুনীলকে টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করতে দিয়েছিলেন। তা না হলে তো হয়তো কবি সুনীলের জন্মই হতো না।
নীললোহিত সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছদ্মনাম। নীললোহিতের মাধ্যমে সুনীল নিজের একটি পৃথক সত্তা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। নীললোহিতের সব কাহিনীতেই নীললোহিতই কেন্দ্রীয় চরিত্র। সে নিজেই কাহিনীটি বলে চলে আত্মকথার ভঙ্গিতে। সব কাহিনীতেই নীললোহিতের বয়স সাতাশ। সাতাশের বেশি তার বয়েস বাড়ে না। বিভিন্ন কাহিনীতে দেখা যায় নীললোহিত চিরবেকার। চাকরিতে ঢুকলেও সে বেশিদিন টেকে না। তার বাড়িতে মা এবং দাদা বৌদি রয়েছেন। নীললোহিতের বহু কাহিনীতেই দিকশূন্যপুর বলে একটি জায়গার কথা শোনা যায়। যেখানে বহু শিক্ষিত সফল মানুষ কিন্তু জীবন সম্পর্কে নিষ্পৃহ একাকী জীবন-যাপন করেন। সত্যি বলতে বাঙালি বেকারদের একটা ক্রেজই হয়ে উঠেছিলেন নীললোহিত।
লেখক হিসেবে চূড়ান্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ ছিলেন সুনীল। প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে লিখতে বসতেন, পঞ্চাশ বছর ধরে অবিরল লিখে চলেছেন তিনি। ১৯৫৩ সাল থেকে তিনি কৃত্তিবাস নামে একটি কবিতা পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টোব্দে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা’ ‘এবং কয়েকজন’ এবং ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে প্রথম উপন্যাস ‘আত্মপ্রকাশ’ প্রকাশিত হয়। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’, ‘শ্যামবাজারের মোড়ের আড্ডা’, ‘অর্ধেক জীবন’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘অর্জুন’, ‘প্রথম আলো’, ‘সেই সময়’, ‘পূর্ব পশ্চিম’, ‘ভানু ও রানু’, ‘মনের মানুষ’ প্রভৃতি। শিশুসাহিত্যে তিনি ‘কাকাবাবু-সন্তু’ নামে এক জনপ্রিয় গোয়েন্দা সিরিজের রচয়িতা। মৃত্যুর পূর্বপর্যন্ত তিনি ভারতের জাতীয় সাহিত্য প্রতিষ্ঠান সাহিত্য একাডেমি ও পশ্চিমবঙ্গ শিশুকিশোর একাডেমির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০১২ সালের ২৩ অক্টোবর বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পাড়ি জমান না ফেরার দেশে। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যে সুনীল যুগের অবসান ঘটে। আজ এই মহান সাহিত্যিকের জন্মদিন। তাঁর প্রতি রইল শ্রদ্ধা।