ঋতুর নারী
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যদি বাংলা সাহিত্যে মেয়েদের মনের কথা বলে থাকেন, তবে বাংলা ছবিতে মেয়েদের মন পড়তে পেরেছেন একমাত্র ঋতুপর্ণ ঘোষ। তাঁর প্রথম ছবি ‘হীরের আংটি’ শিশু চলচ্চিত্র হলেও দুজন নারী চরিত্র কিন্তু ছিলেন। বাড়ির দুই বউ। একজন বড় বউ যেমন হয়। তখন বাণিজ্যিক ছবিতে মা মানেই শকুন্তলা বড়ুয়া। ঋতুও বড় বউয়ের চরিত্রে শকুন্তলাকেই নির্বাচন করলেন। অন্যদিকে বিদেশ থেকে আসা মেজো বউ কাকে করবেন ভেবে ঋতু প্রথম আলাপ করতে গেল মুনমুন সেনের সঙ্গে, তাও এয়ারপোর্টে। মুনমুন বললেন, এখানে কথা বলবেন? বাড়ি আসুন। সেই আলাপ, তারপর তো রাইমা-রিয়ারাও বাংলা শিখল, ছবিতে এলো ঋতুর হাত ধরে।
‘উনিশে এপ্রিল’, প্রসেনজিৎ দেবশ্রীর সদ্য বিয়ে হয়েছে তখন। একদিন অপর্ণা সেনের বাড়িতে আড্ডা দিতে দিতে ঠিক হয়ে গেল সবাই মিলে করে ফেলবেন ফিল্মটা। প্রযোজনা করলেন রেণু রায়। বিশাল সাফল্য পেল। এরপর তো সবার জানা, জাতীয় পুরস্কার সব বাংলা পেত তখন।
সিরিয়াল যখন করলো ‘বাহান্ন এপিসোড’ তখনও সুপ্রিয়া দেবী থেকে রিতা কয়রাল, গার্গী রায়চৌধুরী কাউকে মেক আপ করতে দিতেন না। ন্যাচারাল লুক চাইতেন। ঋতুপর্ণ কত অন্য জগতের মানুষকে তাঁর ছবিতে অভিনয় করিয়েছে। ‘অসুখ’, দেবশ্রী-সৌমিত্র, বাবা-মেয়ের গল্প। ঠিক যেন ‘উনিশে এপ্রিল’-এর উল্টো দিক। সেখানে মায়ের চরিত্রে বাচিকশিল্পী গৌরী ঘোষ। যার গলা অনেক জায়গায় ঋতুপর্ণ নিজে ডাবিং করে দিয়েছে। এর আগে অবশ্য অপর্ণা সেনের ‘পরমা’য় ছোট্ট রোল করেছেন গৌরী ঘোষ। ঋতু যে কতজনের গলা ডাবিং করে নিজের কণ্ঠ বসিয়েছেন, তার শেষ নেই।
‘চোখের বালি’-তে সুচিতা রায়চৌধুরীর কিছু জায়গা, ঐশ্বরিয়ার কিছু জায়গা। ‘দোসর’-এ কঙ্কনার বাড়িওয়ালীর গলা কিংবা ‘নৌকাডুবি’তে প্রসেনজিতের মা হয়েছিলেন যিনি আমু চ্যাটার্জি, ধৃতিমান চ্যাটার্জির স্ত্রী, ওনার ওই নারীদের গলা সম্পূর্ণ ঋতুপর্ণ’র কণ্ঠ।
‘দহন’-এর রোমিতা ঝিনুকের লড়াই যেমন তেমনি ‘আবহমান’-এ শিখা দীপ্তির টক্কর। ‘বাড়িওয়ালী’র বনলতার বাড়ি আগলে অপার শূন্যতা ও অপূর্ণ প্রেম যৌনতার ফ্যান্টাসি। ‘বাড়িওয়ালী’র বনলতাকে অনেকটাই খুঁজে পাই ঋতুর টেলিছবি ‘বনমালী নস্কর লেন’-এ সোমা চক্রবর্তী, অবিবাহিতা ভাইদের সংসারে থাকা বোনের চরিত্রে। ওটা তো টেলিছবির চেয়েও ছবি একটা যেন। ‘শুভ মহরত’, রাখী শর্মিলার কোন্দল যা ‘দাগ’ ছবি করতে গিয়ে হয় সত্তর দশকে, মেটান ঋতু, রাঙা পিসিমা পদ্মিণী চৌধুরী মিলেমিশে যায় হরিদাসীতে।
তারপর তো নিজেকে চেনার খেলায় মাতলেন ‘ঋতুপর্ণ’, ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ কিংবা ‘চিত্রাঙ্গদা’ করে। আজ ঋতু নেই। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট নারীরা রয়ে গেছেন। ঋতু চলে যেতে আমার প্রথম কোনো অচেনা মানুষের চলে যাওয়ায় চোখে জল এসেছিল। আমাদের ছোট থেকে বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ঋতুর ছবিগুলো আসত। আরো কত কাজ বাকি ছিল ঋতুর করার। কিন্তু কাজের চেয়েও মনের মানুষ খোঁজা হারানো বঞ্চনা অবমাননা নিজের যৌনসত্তার বিচ্ছুরণ সেটার প্রতিষ্ঠা সব মিলিয়ে যেন একবুক হাহাকার নিয়ে চলে গেল ঋতু।