গারো বিদ্রোহ ৩
কৃষক আন্দোলনের প্রেরণা গারো বিদ্রোহ
সময়টা ৩ মে ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দ। ইংরেজ বাহিনী রাতের অন্ধকারে অগ্রসর হয়ে গারো পাহাড়ের নিম্নভাগে মধুপুর নামক স্থানে ঘাঁটি গাড়ে। একদিন পরেই তারা জান্কুর বাসস্থান ও প্রধান কেন্দ্র জলঙ্গীর ওপর আক্রমণ শুরু করে। ফলে বিদ্রোহীগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে পাহাড়ের ভেতরে পালিয়ে যায়। অতঃপর ক্যাপ্টেন সিল তার সৈন্যদলকে তিন ভাগে বিভক্ত করে পূর্ব, পশ্চিম ও উত্তর দিকে অভিযান চালায়। এ সময় পশ্চিমদিকের দলটির সঙ্গে বিদ্রোহীদের খণ্ডযুদ্ধ চলে। বিদ্রোহীরা তখন পালিয়ে গেলেও ৮ মে তারিখে হঠাৎ ক্যাপ্টেন সিলের নেতৃত্বাধীন সৈন্যদলের ওপর আক্রমণ করে আবার সরে পরে।
অন্যদিকে, ৭ মে তারিখে লেফটেন্যান্ট ইয়ংহাজাব্যান্ড নালিতাবাড়ী থেকে অভিযান শুরু করলে তাদের সঙ্গে বিদ্রোহীদের কয়েক দফা যুদ্ধ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। অতঃপর তারা দোবরাজ পাথরের বাড়ি থেকে এক দারোগা, দুইজন বরকন্দাজ ও কয়েকজন জমিদারের কর্মচারীকে উদ্ধার করে বাড়িটি জ্বালিয়ে দিয়ে নালিতাবাড়ীতে ফিরে আসে।
এভাবে অস্ত্রশক্তিতে গারো-বিদ্রোহ দমন করা ইংরেজদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে তারা ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে। ক্যাপ্টেন সিল জান্কু পাথর ও অন্যান্য গারো-সর্দারগণের বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন এবং যারা তাদের পক্ষ নেবে তাদেরও একই প্রকার শাস্তি দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেন।
সিলের এই চেষ্টা সফলও হয়। ১০ মে তারিখে পাঁচজন প্রধান গারো-সর্দার বহু বিদ্রোহীসহ ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। অতঃপর তারা জান্কু ও দোবরাজকে ধরিয়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে তাদের ক্ষমা করে পুরস্কৃত করা হয়।
১৩ মে কালভদ্র ও পণ্ডিত মণ্ডল নামক দুইজন সর্দার অনুচরসহ ধরা পড়ে। এভাবে ক্রমেই শক্তিহীন হয়ে পড়ায় জান্কু পূর্বদিকে পালিয়ে যায়। ফলে ক্যাপ্টেন সিল তার কোনো সন্ধান না পেয়ে সৈন্যদল নিয়ে শেরপুরে ফিরে আসে। পরবর্তীকালে বিদ্রোহ চালানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়লে জুন মাসে গারো-সর্দারগণ প্রায় সকলেই ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে জান্কু পাথর ও দোবরাজ পাথরের আর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
এভাবে দ্বিতীয় পাগলপন্থী গারো-বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও বিদ্রোহীরা ওই অঞ্চলের ইংরেজ ও জমিদারগোষ্ঠীর মিলিত শাসনের এক ভয়ংকর চিত্র উন্মোচন করে দিয়েছিল। শোষণ-উৎপীড়ন হতে মুক্তি লাভের একমাত্র উপায় হিসেবে গারোরা যে স্বাধীনতা অর্জনের উদ্দেশ্যে মরিয়া হয়ে উঠেছিল, ওই বিদ্রোহের ফলে স্থানীয় জমিদার ও ইংরেজ শাসকগণও তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল।
জান্কু পাথর ও দোবরাজের বিদ্রোহের পর গারোরা প্রায় নিষ্ক্রিয়ভাবে দুই বছর কাটিয়ে দেয়। তাদের এই দুর্বলতার সুযোগে জমিদারগোষ্ঠী ও মহাজনেরা আবারও গারো অঞ্চলে কর শোষণের তাণ্ডব চালায়। সে সঙ্গে যুক্ত হয় ইংরেজ শাসকগণের শোষণ-উৎপীড়নও। এ সময় পুলিশদল মাঝেমধ্যে গারোদের গ্রামে প্রবেশ করে করের দায়ে তাদের সর্বস্ব লুট করে বাড়িগুলোতে আগুন ধরিয়ে দিতে থাকে। ফলে জীবনের তাগিদে গারোরা আবারও বিদ্রোহের জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ শাসক—এই তিন শক্রর বিরুদ্ধে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ পর্যন্ত তারা অবিরতভাবে বিদ্রোহ চালিয়ে যায়।
১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দের গারো বিদ্রোহ সম্পর্কে সরকারি গেজেটিয়ারে উল্লেখ রয়েছে ঠিক এভাবে—গারো বাজারগুলোতে তদারককারী জমিদার কর্মচারীগণ ও ব্যবসায়ী মহাজনদের শোষণ-উৎপীড়ন এই বিদ্রোহের প্রধান কারণ। তাদের শোষণ-উৎপীড়নে ক্ষিপ্ত হয়ে গারোগণ সীমান্তবর্তী জমিদারি ঘাঁটি ও জমিদারের কর্মচারীদের ওপর আক্রমণ শুরু করে। জমিদারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন ইংরেজ শাসকগণ। বিদ্রোহী গারোদের দমাতে একদল সৈন্য পাঠানো হয়। তাদের সঙ্গে কয়েকটি সংঘর্ষে পরাজিত হয়ে গারোরা সাময়িকভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
কিন্তু তবুও গারোরা বিভিন্ন সময়ে জমিদার ও ব্যবসায়ী মহাজনদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ চালিয়ে যেতে থাকে। জমিদার-মহাজনবিরোধী সংগ্রাম ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে চরম আকার ধারণ করে। সে সময় সরকারের কর প্রদান বন্ধ রাখে তারা। তখন একজন গারো সর্দার বিশ্বাসঘাতকতা করে জমিদার ও শাসকগণের পক্ষে চলে গেলে গারোগণ ক্ষিপ্ত হয়ে তাকেও সপরিবারে হত্যা করে। গারোদের এই বিদ্রোহ দমনের জন্য ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দের শেষভাগে ইংরেজ সৈন্যদল গারো অঞ্চলে প্রবেশ করে। ফলে নিজেদের রক্ষায় গারো বিদ্রোহীরা আশ্রয় নেয় গহিন জঙ্গলে।
এ সময় সরকারি পরামর্শে জমিদার-ব্যবসায়ীগণ গারো অঞ্চলের বাজারগুলো বন্ধ করে দিলেও তাতে কোনো ফল হয় না; বরং তখন গারোদের আক্রমণও ক্রমশই বৃদ্ধি পেতে থাকে। অতঃপর ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের প্রথম ভাগে একটি বৃহৎ সেন্য-বাহিনী দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে এক ভাগ গোয়ালপাড়া এবং অন্যভাগ ময়মনসিংহের মধ্য দিয়ে গারো অঞ্চলে প্রবেশ করে। তারা গারোদের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দিতে থাকে। ফলে গারো বিদ্রোহীরা আগের মতোই গহিন জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকে।
১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের কথা। সুসঙ্গের জমিদার গারো পাহাড় অঞ্চলে খাজনা ধার্য ও তা আদায় করার চেষ্টা করলে আবারও গারো পাহাড়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। ক্ষুব্ধ গারোগণ দলবদ্ধ হয়ে সমতলে নেমে এসে জমিদারের ঘাঁটিগুলোতে আক্রমণ চালাতে থাকে। ফলে জমিদারের বহু পাইক-বরকন্দাজ ও কর্মচারী নিহত হয়। গারোদের আক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করলে উপায়ান্তর না দেখে জমিদার ইংরেজ শাসকগণের সাহায্য চান। ইংরেজরা তখন সুসঙ্গ জমিদারি রক্ষায় ওই অঞ্চলে একটি সৈন্য-বাহিনী পাঠায়। আগ্নেয়াস্ত্র-সজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর ভয়ে গারো বিদ্রোহীগণ এবারও দূর পাহাড়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে।
এ ঘটনার পর ইংরেজরা বুঝে যায় যে, বাইরে থেকে এসে গারো বিদ্রোহীদের দমন করা সম্ভব নয়। তাই তারা উইলিয়ামসন নামক একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মচারীকে সৈন্যদলসহ ওই অঞ্চলে স্থায়ীভাবে অবস্থানের জন্য প্রেরণ করে। এই সামরিক কর্মচারী বহু প্রলোভন দেখিয়ে কয়েক গ্রামের গারোদের নিজেদের পক্ষে আনতে সক্ষম হয়। ফলে ধীরে ধীরে বিদ্রোহী গারোরা কিছুটা শান্তভাবে জীবন কাটাতে থাকে।
কিন্তু ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজগণ জরিপ-কাজের জন্য সদলবলে গারো পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করলে গারোগণ তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এক বছর পর জরিপের জন্য ইংরেজরা আবারও গারো পাহাড়ে গেলে একদল সশস্ত্র কুলির ওপর আক্রমণ চালিয়ে কয়েকজনকে হত্যা করে। বাকিরা তখন পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়।
এ ঘটনার পর ওই অঞ্চলের ডেপুটি কমিশনার সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে বিদ্রোহী গারোদের দমনের চেষ্টা চালায়। এ সময় কয়েকজন গারোকে গ্রেপ্তার করলে গারোগণ একটি পুলিশ ঘাঁটির ওপর আক্রমণ করে। এতে কয়েকজন পুলিশ নিহত ও আহত হয়। ফলে পুলিশ বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে বড় একটি সশস্ত্র দল নিয়ে গারো পাহাড় অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং বিদ্রোহীদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
ওই সময় ইংরেজ শাসকগণও স্বাধীন গারো অঞ্চলের অস্তিত্ব বিলুপ্ত করার লক্ষ্যে বিদ্রোহী গারোদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানের প্রস্তুতি নেয়। অতঃপর পাঁচশ সশস্ত্র পুলিশ ও তিন কোম্পানি নিয়মিত সৈন্য একটি অভিযান পরিচালনা করে। তারা তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে ময়মনসিংহ ও আসামের দিক হতে গারো অঞ্চলে ঢুকে এবং প্রধান কেন্দ্র দিলমাগিরি গ্রামটি দখল করে নেয়। এ সময় গারো বিদ্রোহীরা অতর্কিতে আক্রমণ করলে কিছু সংখ্যাক সৈন্য ও পুলিশ নিহত হয়। কিন্তু তাতেও সামরিক অভিযান বন্ধ না হলে একসময় তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।
১৮৭০-৭১ খ্রিস্টাব্দের গারো-বিদ্রোহের অবসানের পর গারো অঞ্চলের কমিশনার স্বাধীন আঠারখানা গ্রামের অধিবাসীদের পথঘাট নির্মাণের কাজে নিয়োজিত করেন। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের কথা। কর্তৃপক্ষের দুর্ব্যবহারের কারণে ওই গ্রামের গারোরা কাজ বন্ধ করে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। আশপাশের গারোরাও তাতে অংশ নেয়। ফলে গারো অঞ্চলে ইংরেজ শাসকগণের পথ নির্মাণের কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
এ সময় ডেপুটি কমিশনার শতাধিক সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে গেলে কয়েকশ গারো তীর-ধনুক নিয়ে তাদের ঠেকানোর প্রস্তুতি নেয়। কমিশনার তখন ভিন্ন পথে গারো অঞ্চলে প্রবেশ করে গারোদের অস্ত্র ত্যাগ করার আদেশ দেন। কিন্তু এতে কেউ না মানায় তিনি বিদ্রোহীদের দুটি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে গারোদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করান। এই বিদ্রোহ দমনের পর গারো অঞ্চলে আর কোনো বিদ্রোহের তথ্য পাওয়া যায়নি।
বিভিন্ন সময় গারো বিদ্রোহের ইতিহাস পরবর্তী কৃষক আন্দোলনের প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাই গারোদের গৌরবময় সংগ্রামের রক্তাক্ত ইতিহাস উদ্দীপ্ত করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে।