গ্রন্থালোচনা
শিঙা যখন বাজে
আমরা আমাদের জীবনটাকে নানাভাবে উপলব্ধি করি। ডান, বাম, সামনে, পেছনে, কিংবা ওপর-নিচ সব দিক দিয়েই যাপকের জীবনটাকে অনুধাবন করা যায়। অথবা বলা যায় সেভাবেই এক-একজন করে থাকে। এর অনেক কিছুই যেন ঘটে যায় আমাদের অগোচরে। কেউ হয়তো তেমন করে খেয়াল করে না। ওয়াসি আহমেদ আমাদের জীবনের বাস্তবতার পরিপূরক এই অনুভূতিকে তুলে ধরেন তাঁর গল্পে। গল্পকারের শক্তি তাঁর লেখনীর আপাত সরল গতি। এই গতিই তাঁর গল্পকে দেয় অন্য এক মাত্রা। জনপ্রিয় ধারার লেখক বলতে যা বোঝায় তা তিনি না। ওয়াসির গল্পের ভেতরে ঢুকতে তাই দরকার নিরবচ্ছিন্নতা। তবে একটা কথা বলতেই হয়, ওয়াসি আহমেদের গল্প পড়তে পড়তে একা(র) হয়ে যাওয়াটা অবধারিত। ‘শিঙা বাজাবে ইসরাফিল’ গল্পগ্রন্থে সংযুক্ত হয়েছে দশটা গল্প।
প্রথম গল্পটার নাম ছোঁয়া। মূল চরিত্র এতে রানু নামের এক তরুণী আর খয়েরি রঙের একটা মোটসোটা বেড়াল। চেনা বাস্তবকে তুলে ধরার জন্য এদের সঙ্গে আছে রানুর মেয়ে লোপা। রানুর সাধারণ জীবনযাপনের ছন্দে অন্য এক সুর তোলে খয়েরি বেড়ালটা। কার্ণিশ থেকে হঠাৎ করেই ছিটকে পড়ে সেটা পোর্চের ছাদে। যেটা দেখে আঁতকে ওঠে রানু। যখন সে ছিটকে পড়া বেড়ালের শেষ পরিণতিটা দেখার জন্য তাকায়, তখনই ঘটনাটা ঘটে। নেহাত বেড়াল বলে সেটা আবার উঠে দাঁড়ায়। আর নিজের পতনের হেতু খুঁজতে কার্ণিশের দিকে দেখতে গিয়ে চোখ পড়ে রানুর চোখে। রানুর চোখে তখন বিস্ময়, আশঙ্কা আর হৃদয় মোচড়ানো একটা চিড়িক। এটার পরেই রানুর জীবনের একটা অন্য অর্থ দাঁড়িয়ে যায় তখন। আসলে জীবন যন্ত্রণার অসম্ভব ভেতর পিঠটা যে দেখতে পায় তার জগৎই পাল্টে যায়। আর দশটা মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে তার পার্থক্য ঘটে যোজন যোজন। আর তখনই অন্য মানুষ বা অন্য কোনো অস্তিত্বে বিলীন হওয়ার আনন্দ বা দুঃখ কোনোটাই ভর করতে পারে। তার জীবনের এই অন্য জগৎ তাকে অনবরত দূরে সরাতে থাকে চেনা ছবি থেকে। তবে এই বাস্তবের সঙ্গে রানুর জগতের যোগসূত্র তৈরিতে থাকে রানুর মেয়ে লোপা। সেই সূত্রেই গল্পের পরিণতি। শেষে ওয়াসি লেখেন, ‘দিনে দিনে রানুর বোধবুদ্ধি পোক্ত হয়। সে তখন বোঝে, বুকে হাত চাপলে ক্ষতি নেই, এমনকি চোখের কোল ভাসিয়ে বড় বড় ফোঁটায় কান্না ঝরালেও না, কেবল ছুঁয়ে যেতে নেই, ছুঁয়ে যেতে নেই।’ গল্পটা পড়তে গিয়ে ফ্রাঞ্জ কাফকার ‘মেটামরফোসিস’-এর কথা মনে পড়ে। হয়তো লেখককে এই গল্প অনুপ্রাণিত করেছে কিন্তু অবশ্যই বলতে হবে ‘ছোঁয়া’ একান্তই ওয়াসি আহমেদের গল্প।
‘বনসাই’ গল্পে এমন এক যুবকের কথা বলা হয় যে আমাদের সমাজের অতি চেনা। কোনো এক বিচিত্র কারণে মানুষের নিজের প্রতি ঘৃণা জন্মে। হয়তো একের পর এক ব্যর্থতা অথবা নিজের প্রতি অতিবিশ্বাস তাকে হতাশ করে তোলে। তবে মানুষের বিচিত্র মনের খবরও তো বলা যায় না। তাই তখন মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশকে, মনে পড়ে ‘... মরিবার হলো তার সাধ।’ তবে যদি মানুষ একবার তার নিজের পথ থেকে নিজেকে হারিয়ে ফেলে তাহলে যা হয়, তা হলো পলায়ন। নিজেকে নিয়ে নিজের আশপাশটা নিয়ে কেবলই খোড়লে লুকিয়ে পড়া। সবাই ভাবে, আত্মবিশ্বাস হারানো মানুষ। যা কিছুই ঘটে না কেন সমস্ত কিছুই তার বিরুদ্ধে যায়। কাঠি শেষ হয়ে যাওয়া দেয়াশলাইয়ের বাক্সের মতো এক পাশে ফেলে রাখে সবাই। তখন হয়তো মনে হতেই পারে যে নিয়তির খেলা। অবশ্য এমনি করেই মানুষ অদৃষ্টে বিশ্বাসী হয়। এত সবের পরেও কিন্তু প্রত্যেক মানুষের ভেতরই স্বপ্নের মতো বাড়তে থাকে বেঁচে থাকার তীব্র বাসনা। আতিক নামের যুবকটিকে হয়তো পদ্মের মতো মুখের কোনো রমণী মন্ত্রণা দেয়। আবার ফিরে দেখার মন্ত্রণা। জেগে ওঠার এক নতুন আলোর ঝলকানি তাকে ইশারা দেয়। যে শেকড়কে সে শুধুই কেটে কেটে ছোট করেছে। তারই পোক্ত বন্ধনে সে প্রথিত হয় জীবনের জমিতে। তার ডালপালা বিস্তৃত হয় আকাশজুড়ে। কিংবা কোনো এক প্রেরণা তাকে তাড়িয়ে আনে চেনা সংসারে। আর এই বাস্তবতাই একসময় তাকে টেনে বের করে আনে আলোর পৃথিবীতে।
‘কলাপাতা-শাড়ি ও হাবুল সেখের বাড়ি ফেরা’ গল্পে লেখক সমাজের এমন এক ঘটনা বলেন, যেটার অনুষঙ্গ যাই হোক না কেন কার্যকারণসমন্ধ একই। জীবনের ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত দুর্ঘটনার কাল সাক্ষী ভিকটিম নিজেই। যে কোনো কৌশলই তাকে সেটা ভোলাতে পারে না। অন্যরা অনেকেই সেটাকে ভুলে থাকার ভান করে। আবার এও ঠিক যে সেটার সামনে যেতে ভয়ও পায়। এই অজ্ঞানতাই মনে স্বস্তি এনে দেয় ‘সবকিছু গুছিয়ে ফেলা গেছে’ ভেবে। সরাসরি মুখোমুখি হওয়ার সাহস ভুলে যে প্রলেপ তাতে দেওয়া হয় তা যে মেকি সেটাও প্রমাণ হয়। নিজেকে আলী আমজাদ উদার ভাবতে পেরেই খুশি। এমনকি সেদিন তার স্ত্রীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনা, ডাকাতদের সেই গণধর্ষণ তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে ঠিকই। কিন্তু সে হয়তো সাময়িক দুঃস্বপ্নের মতো সেটাকে কিছুদিন লালন করে। বা নিজের চৌকস বুদ্ধির ছকে ফেলে সেটাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক সমাধানে আনে। এ থেকেই তাঁর পরিতৃপ্তির শ্বাস-প্রশ্বাস। প্রকৃতার্থে ব্যথা অনুভবের সুতীক্ষ্ণ মেরুতে সে কোনোদিনই পৌঁছাতে পারে না। বা বলা যায় বুঝেসুজেই নিজেকে গুটিয়ে রাখে একটা নিজের গড়া সত্যের গণ্ডিতে। তাই তো নিজেই নিজেকে ভ্যাট দিতে কার্পণ্য করে না। কার্পণ্য করে না জীবন উপভোগের সব সম্ভার আয়োজনে। তবে বলতেই হয় আমজাদের ভেতরে সত্যটা ঠিকই রয়ে যায়। এ বিষয়ে স্ত্রীর সামনে তার স্বাভাবিক আচরণ সামিনাকে স্বস্তি দিয়েছে। তার যত্নে নেওয়া পদক্ষেপ স্ত্রীর চোখে তাকে মহানুভব বানিয়েছে। কিন্তু স্ত্রীর চোখের আড়ালে যখন আমজাদ নিজেই নিজের সামনে দাঁড়িয়েছে, ভেতর থেকে সত্য তাকে নির্মম করেছে। এমনকি অন্য নারী সম্ভোগে আমজাদ নিজেকে মাঝে মাঝে ধর্ষকের ভূমিকায়ও দেখে। কিন্তু তার জীবনের উত্থান, করপোরেট ভাবধারা একসময় সব সত্যকে একটা মায়াজালে ঢেঁকে রাখে। তার প্রভাব সমানভাবে পড়ে তার পরিবারেও। সত্যকে আগলে রেখে জীবন-যাপন করা। সত্যের চশমায় দেখা মানুষের মন সম্পূর্ণ ভিন্ন গতিতে চলে। আর তাই তো হাবুল সেখ সত্যটাকে মেনে নিয়েছে। সে এটার কোনো অন্য মানে বের করতে চায়নি। সত্যতে হয়তো পারিপাট্য নেই কিন্তু আছে তীব্রতা। যার সামনে দাঁড়ালে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যেতে হয়। আলি আমজাদ যখন এই সত্যের মুখোমুখি হয়, তখন সেটাকেও চেয়েছে মেকি পর্দায় ঢেঁকে দিতে। সত্যের আসনে স্থির হাবুল সেখকে দেখে তার সাজানো পৃথিবী দুলে ওঠে। আদতে মানুষকে সত্যের কাছে মাথা নত করতেই হয়। সেটা কখন করতে হবে কেউ তা জানে না। অথচ সবাই ভাবে সেটা বুঝি কোনো দিনই আসবে না। আসলে সত্যটা যে মনের ভেতর অনবরত নাড়া দেয় সেটাকে চেপে রেখে আমাদের জীবনের পথপরিক্রমা চলতে থাকে। লেখক আলি আমজাদকে সেই সত্যের সামনে দাঁড় করিয়ে সমাজকে নাড়া দিতে চেয়েছেন।
এর পরের গল্পটা ‘মিস নমিতা’। একটা সদ্য কৈশোর পার হওয়া তরুণীর গল্প। যার আসল নাম ময়না। ময়না নামটা তার আগের জীবনের। অর্থাৎ যখন সে বাসাবাড়িতে কাজ করেছে তখনকার। বলা যায় নমিতা নামটা সে নেয় তার পরবর্তী কর্মস্থল এক গার্মেন্টসে ঢোকে। এখানে আসলে তার পুনর্জন্ম হয়। ভাগ্য অন্বেষণে আসা গ্রামের সরল কিশোরী। নানা ঠোক্কর খেয়ে সে গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। আর সেই থেকেই তার জীবনের গতিপথ এক নতুন মোড় নেয়। সরল চাওয়া-পাওয়া থেকে তার জীবন-যাপনের নিত্য সঙ্গী হয় কৌশল। পয়সা কামানোর কৌশল। পুরুষদের সন্তুষ্ট করে চাকরি বাঁচানোর কৌশল। এমনকি তার প্রেমিক জোটানোর সময়ও সে কৌশলটা ভোলে না। এর সব কিছুই তার জীবনের নানা বাঁকে ঠোক্কর খেতে খেতে শেখা। বাসায় কাজ করার সময় যে ঠোক্কর সে খেয়েছিল তা তাকে হয়তো শেখায়নি কিছু, কিন্তু জীবনের এক উপলব্ধি এনে দিয়েছিল। এতে নগদ প্রাপ্তি নেই ঠিকই কিন্তু পুরো জীবনটাকে চিনে নেওয়ার এক ইঙ্গিত সে পায়। তার জীবনের নানা অলিগলির গল্পের সঙ্গে আমাদের দেশের নানা সংস্থার ক্রিয়াকর্মের একটা পরিচিতি লেখক সবাইকে দেন। সহজ ভাষায় আপাত সমাজ সংস্কারকের সুযোগসন্ধানী চেহারা ফুটিয়ে তোলেন তিনি। আর এমনি করেই ময়না থেকে মিস নমিতা হতে চাওয়া মেয়েটার পেছন ফিরে দেখার চিত্রটা আমরা পেয়ে যাই। এই গল্পটা সম্বন্ধে একটা কথা বলে শেষ করা যাক।
শুরুতেই মিস নমিতা নামটা পড়েই মনে পড়ে যায় ‘মিস শেফালী’র নাম। ভারত স্বাধীনের পর তখনো কলকাতায় এ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। কলকাতার তদানীন্তন এলিট সমাজে ক্যাবারে ড্যান্সের চল ছিল। বিভিন্ন হোটেলে তখন চলত এই নাচের আসর। সাধারণত এ্যাংলো ইন্ডিয়ান বা একটু সচ্ছল পরিবার থেকেই আসত এসব নাচিয়ে। বাঙালি শুধু নয়, পূর্ববাংলায় থেকে যাওয়া একেবারেই নিম্ন পরিবারের একটি মেয়ে হয়ে ওঠে ক্যাবারে ড্যান্সার। তার আত্মজীবনীর বইতে দেখা যায় কীভাবে বাসার কাজ করতে করতে সে ক্যাবারে ড্যান্সার হয়। তাকেও পুরুষের হাতে নিগৃহীত হতে হয়। ঠেকে ঠেকে শিখতে হয় জীবনকে। সেই কারণে বলা যায় ওয়াসি আহমেদের এই গল্পটা নতুন কিছু না। বলা যায় এটা একটা চিরন্তন গল্প যার প্রেক্ষাপটটা নতুন। তার গল্পের সারিতে এটার জন্য তেমন কোনো বিশেষণ রাখা যাচ্ছে না।
“আমাদের ‘মিনা’ গল্পের প্রধান চরিত্র মিনা নামের একটা স্কুল পড়ুয়া মেয়ে। তাদের স্কুলে মন্ত্রী আসবে বলে সাজ সাজ রব। তাদের নানাভাবে শেখানো হয় কীভাবে মন্ত্রীকে বরণ করতে হবে। মিনার দায়িত্ব গান গাওয়ার। যথাসময়ে সুরমা রঙের হেলিকপ্টারে চড়ে মন্ত্রী আসেন। মিনা গায় “আমরা করব জয়”। আর এই গানেই মন্ত্রীর মন জয় করে নেয়। মন্ত্রী ছোট্ট মেয়েটাকে কাছে ডাকেন। সবাই যখন সন্ত্রস্ত, তখন মেয়েটা নির্বিকার। মন্ত্রী তাকে পাশে বসিয়ে কথা বলেন। আর মিনা তাদের স্কুলের ভবনটাকে দোতলা করে দিতে বলে। তাদের অঙ্কের শিক্ষকের বেতন বাড়িয়ে দিতে বলে। এমনি নানা কিছু, যা তার কাছে জরুরি মনে হয়। সেদিন থেকে তার আলাদা একটা মর্যাদা দাঁড়িয়ে যায় এলাকায়। তাকে ঘিরেই সবাই স্বপ্ন দেখতে থাকে কবে মন্ত্রী তাদের চাহিদা পূরণ করেন। এই স্বপ্নই মিনাকে বিভোর করে রাখে। সেই সঙ্গে দিনের পর দিন আশায় বুক বাঁধে এলাকার মানুষ। সেই আশা ফিকে হতে থাকে যথানিয়মে। আমাদের দেশের নিত্যকার এই গল্প অন্য ভাষায় লিখেছেন লেখক। আর তাঁর সেই ভাষাই গল্পটাকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে।
“মধ্যদিনের গান” গল্পটা একজন অভিবাসীর গল্প। এটাকে উদ্বাস্তু বলা যায় না কারণ বিষয়টা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে দেশ বদল। সেই রকম একজন মানুষ যার বোধ-বুদ্ধিতে সিদ্ধান্ত বিষয়টা পেন্ডুলামের মতো দোলে। একবার এদিকে একবার ওদিকে। যুক্তি, বাস্তবতা এক একদিকের জন্য এক একরকম। যেন দুই দিকেরটাই সত্যি। এই দোদুল্যমানতা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। তাড়িয়ে বেড়ায় এপার থেকে ওপারে, আবার ওপার থেকে এপারে। গল্পের শুরুটা বর্ডার পার হওয়ার খুব বাস্তব একটা দৃশ্য দিয়ে। কিন্তু এই বাস্তবতাকে উড়িয়ে, তাড়িয়ে নিয়ে ফেলে তাকে এক পরাবাস্তব জগতে। তার সেই গোপন ভাবনার বর্ণনা লেখক দেন এভাবে- ‘হাজিরপুরে দুপুরগুলো ছিল শূন্য, খাঁ খাঁ। প্রকাণ্ড, হা-খোলা আগুন ঠিকরানো সব দুপুর। হু হু করে আগুনের হলকা উঠত হাওয়ায়, আর উঠত আচমকা থেকে থেকে এক একটা টান, লু হাওয়া গনগনে রোদে পাক খেতে খেতে শুখা খটখটে মাটির কলজে ধরে টানটা দিত-শব্দহীন একটা নিঃসীম বাজনা উঠত পৃথিবীর কান্নার মতো। কিন্তু তারপরও অদ্ভুত ঘটনা ঘটত, বুক মোচড়ানো আকুল কান্নাটা হঠাৎ হঠাৎ যেন ঘুমঘোরে তার কানে টোকা দিয়েই হারিয়ে যেত। সে তখন এলোমেলো হয়ে পড়ত। সুস্থির হয়ে বসে কান্নাটা, বাজনাটা কানের পর্দায় ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করত। পারত না কিছুতেই। তার তখন নিজেরই কান্না পেত, বুক দাপিয়ে অশান্ত তোলপাড়ে কান্নাটা তাকে কাঁদাত। কেন, কিছুতেই বুঝতে পারত না। শূন্য দুপুরের হু হু কান্না নিয়ে মাশুক আলী পাগল হয়ে পালাল।’ তার এই অনুভূতির সঙ্গে আছে এপারে বা ওপারে থাকার নানা রকম ঘটমান সত্যি। যার কোনোটাকেই ছুড়ে ফেলা যায় না। অন্তত তাৎক্ষণিক পারিপার্শ্বিকতার বিচারে। এই সব কঠিন বাস্তবের সঙ্গে জানা-শোনা হওয়ার পরও সেই অদৃশ্যমান বাস্তবের পুরোটাই তার চিত্তকে চঞ্চল করে তোলে। যেটার বাস্তবতা তার হৃদয়ে অতি সত্যি এবং দৃশ্যমান। যে অদেখা নাড়িছেঁড়া টান আপন শেকড়ের জন্য, তাই সমস্ত গল্পের পরতে পরতে ছড়িয়ে দেওয়া। আর এই সকল অস্তিত্ব আচ্ছন্ন করা ছুতো তাকে উতলা করে তোলে। উদ্ভ্রান্তের মতো সে খুঁজতে থাকে তার উৎস।
“শীত পিপাসার দেও-দানব” গল্পটাকে যদি “মধ্যদিনের গান” গল্পের পরিপূরক বলি, তাহলে খুব একটা ভুল হবে বলে মনে হয় না। তবে হয়তো দুটো গল্পের “মোটিভ” দুই রকমের। তাহলেও একই প্রেক্ষাপট, একই কালকে উপস্থাপন করে গল্প দুটো। শীত পিপাসার দেও-দানব গল্পের মিহির দেবনাথ থানায় যান ডায়েরি করতে। তাঁর ছেলে পলাশ তিনদিন ধরে নিখোঁজ। এর পরের গল্পটা একেবারেই আমাদের দেশের আর দশটা ঘটনার মতো। মানে সেই আইনশৃঙ্খলা আর তার রক্ষাকর্তাদের নোংরা ঘাঁটার দুর্গন্ধে ভরপুর। একটা সার্বক্ষণিক আতঙ্ক থেকে দেশত্যাগের তাড়না, যা এক মিহির ছাড়া পরিবারের অন্য সবাইকেই উৎকণ্ঠিত করে রাখে। মিহির দেবনাথ নিজ মাতৃভূমি ত্যাগে বোধ হয় কখনোই মন থেকে সায় পায় না। অথবা অন্য একটা দেশে গিয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ না করতে পারার আশঙ্কা চেপে ধরে মিহিরকে। কারণ হয়তো অন্যদের মতো সে না, ভারতকে মিহির অন্য দেশ ভাবতে পারে এখনো।
“উদ্বাস্তু” কবিতার নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত পুরুষ যেমন বলে, সে যাচ্ছে এখন তার নিজের দেশে, তেমনি করে মিহির বলতে পারে না। অথচ তার স্ত্রী বা আত্মীয়-স্বজন সবাই তার বিপক্ষে। দুর্বলের ওপর সবলের নিপীড়ন সর্বদাই দেখা যায়। বস্তুত একটা দেশে সংখ্যালঘুরা দুর্বলই বটে। যদিও নিপীড়ক জাতি ধর্ম নির্বিশেষে তার কর্ম চালিয়ে যায়। তবুও সহজতর লক্ষ্য বস্তু পাওয়া গেলে সেটাকেই আগে আক্রমণ করা হয়। আর দুর্বলের চেয়েও দুর্বল সাধারণত সংখ্যালঘু।
“ঋতুচক্র” গল্পটায় আছে নিঃসন্তান এক যুগলের কথা। দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবনে তাদের কোনো সন্তান হয়নি। হয়তো এসব কারণে কি দীর্ঘ সময় পার হওয়া সংসারে আর কোনো চমক থাকে না। আর তাই তাদের জীবনের ছকটা যেন অন্যরকম। নিরিবিলি, নির্ঝঞ্জাট, সন্তানবিহীন জীবনে যেমন সাংসারিক ব্যস্ততা কম তেমনি হয়তো একটা গোপন হতাশাও কাজ করে। যার জন্য চমকহীন জীবনটা কোনো নিরালায় কাটিয়ে দিতে পারলেই ভালো মনে হয়। সেই জন্য তাদের বাসা বদল। শহর থেকে দূরে একটা নির্জন এলাকায় বাসা নিয়ে খুশি হয় দু’জনেই। সেই বাড়ির পাশের আগাছা পূর্ণ একটা জমিতে হঠাৎ করেই তারা ফসল ফলানোর সিদ্ধান্ত নেয়। জমি কর্ষণ, বীজ বপন আর তাতে জল সিঞ্চনের মতো কাজে নিশ্চয়ই তাদের জীবনেও একটা পরিবর্তন আসে। প্রকৃতি বোধহয় এমনি করে তাদের জীবনে একটা পরিবর্তন এনে দেয়। অকস্মাৎ বিলুর সন্তান সম্ভাবনায় বদলে যায় তাদের পৃথিবী। জমিতে গাছ যেমন বড় হতে থাকে তেমনি করে বিলুর শরীরেও আসে পরিবর্তন। কিন্তু বহুদিনের ফসল না ফলা জমি আর অনভিজ্ঞতা সমস্ত আশাকে নিভিয়ে দেয়। নষ্ট হয় যেমন জমির ফসল তেমনি বিলুর সন্তান। তবে এমনি করে হেরে যায় না তারা আবার নতুন উদ্যমে প্রথম থেকে শুরু করে।
“ভারহীন দৃষ্টিহীন” এই বইয়ের শেষ গল্প। তারিখ নামের এক অতি চেনা নগরবাসীকে দিয়ে যেন আমাদের দৈনদিন জীবনের চালচিত্র বা বলা যায় গভীরে ঢুকে যাওয়া দৃষ্টিপথে পড়া দৃশ্যগুলোর বর্ণনা দেওয়া। আমরা যখন কোনো ধরনের অস্বস্তিতে পড়ি তখনই সেটাকে পাশ কাটাতে চাই। মুখোমুখি হওয়ার শক্তি যেন আজ আমরা হারিয়ে ফেলেছি। ক্লেদমুক্ত করার চেয়ে ক্লেদকে না দেখার চেষ্টায় চোখ বন্ধ করে নিজেকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছি। জীবনের এই পলায়নপরতা আজ যেন আমাদের সকলকেই তাড়া করে ফেরে। বইয়ের নাম গল্পটা হলো, “শিঙা বাজাবে ইসরাফিল”। যদিও ক্রম অনুযায়ী গ্রন্থে এটার অবস্থান আরো আগে। সমাজের প্রতিপত্তির বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য থেকে উদ্গীরিত গরল আমাদের মজ্জাগত। এই অভ্যাস থেকেই হয়তো মানুষ অদৃশ্য মহাশক্তির দ্বারস্থ হয়। আবার এও দেখা যায় নিজের জীবনের দীনতাকে আড়াল করতে অন্য আরেকজনের বৈভবকে অবৈধ বলে নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়া। মনের সুপ্ত বাসনায় কিন্তু নিজেকে ওই স্থানে দেখার ইচ্ছাটাই কাজ করে। পাশাপাশি বিত্তের দ্বার যাদের অবারিত তাদেরও মনের কোনে বাসা বাঁধে নানা কুসংস্কার। এ এক অদ্ভুত গল্প। একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িয়ে গেছে অবিচ্ছেদ্যতায়। একদল নিজের কৃতকর্মের অনুশোচনার জন্য যেমন অলৌকিক আঁধারের আতঙ্কে থাকে। তেমনি অন্যদল না পাওয়ার আক্ষেপ পূরণে অলৌকিক ভাগ্যে বিশ্বাস রাখে। ওয়াসি আহমেদ মানুষের এই অতিচেনা বিষয় নিয়ে গল্প ফাঁদেন। মানুষের তৈরি করা জগতের অতিবাস্তব কাহিনী। কিন্তু পড়তে পড়তে পাঠক একসময় আবিষ্কার করে সে পৌঁছে গেছে বাস্তব ছেড়ে অনেক দূরে। অথচ এ তাদেরই কথা, তাদেরই গড়া জীবন কিন্তু ধোঁয়াশার মতো ঘুরে বেড়ায়। যাকে দেখেও যেন বুঝতে পারে না তাদের করণীয় কী? শুধুই অপেক্ষা পথ তাদেরকে কোথায় নিয়ে ফেলে।
ওয়াসি আহমেদের গল্পগুলো নেহাত আলোচনার ছকে ফেলে বোঝার চেষ্টা করায় পরিপূর্ণতা আসবে না। প্রকৃত সৃষ্টির সঙ্গে সরাসরি সংযোগ ছাড়া তার অস্তিত্ব নিরূপণের সুযোগ খুব একটা নেই। তবুও বলতে হয় তাঁর গল্পের বিন্যাসের কথা। বলতে হয় তাঁর ভাষার ব্যবহারের কথা। বা তাঁর গদ্যের বাক্যে শব্দ সংযোজনের নতুনত্ব। তিনি বেশির ভাগ গল্পে কোনো ঘটনা পরম্পরার গল্প বলেননি। বরং তিনি কোনো একটি ঘটনার অনুভূতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন নানা মাত্রার বাক্য সাজিয়ে। তাঁর শব্দ চয়নে পারদর্শিতা শব্দের বাচ্যার্থকে আলংকারিক অর্থে পৌঁছে দিয়ে বাক্যকে করেছে অনন্য। আর এই সব বাক্য সাজিয়ে তিনি যখন গল্প লেখেন, তখন তা আমাদের নিয়ে যায় তীব্র অনুভূতির তারে।
বইয়ের নাম : শিঙা বাজাবে ইসরাফিল
লেখক : ওয়াসি আহমেদ
প্রচ্ছদ : ধ্রুব এষ
প্রকাশক : ঐতিহ্য
পৃষ্ঠা : ১২০
মূল্য: ১১৫ টাকা