বইয়ের কথা
যুদ্ধের বিপরীতে কালো অবিলিস্ক
জার্মান সাহিত্যিক এরিক মারিয়া রেমার্কের বিখ্যাত যুদ্ধবিরোধী উপন্যাস ‘অল কোয়ায়েট অন ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’ পড়েননি এমন পাঠক কমই পাওয়া যাবে। রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী কয়েকটি কালজয়ী উপন্যাসের ভেতর একটি হলো ‘দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক’। শেখ আবদুল হাকিমের অনুবাদে বইটি প্রকাশ করেছে প্রথমা প্রকাশন।
‘দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক’ নিয়ে বলার আগে রেমার্কের যুদ্ধবিরোধী ক্ষুরধার লেখনীর পেছনের ইতিহাসটা ছোট করে বলে রাখা দরকার। তরুণ রেমার্ককে প্রথম মহাযুদ্ধে পাঠানো হয়েছিল জোর করে। সেই যুদ্ধের বীভৎসতা রেমার্কের মনে প্রচণ্ড দাগ কেটেছিল। যুদ্ধে আহত হয়ে হাসপাতালে বসেই তিনি লিখতে শুরু করেন। পরে যুদ্ধবাজ ফ্যাসিস্ট হিটলার এই লেখককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে, পুড়িয়ে ফেলে তাঁর বইগুলো।
‘দ্য ব্ল্যাক অবিলিস্ক’ উপন্যাসে যুদ্ধ ফেরত এক সৈনিকের জীবনসংগ্রাম দেখাতে গিয়ে লেখক যুদ্ধবিধ্বস্ত জার্মানি ও সেখানকার সাধারণ মানুষের করুণ চিত্র তুলে ধরেছেন। জনগণের ওপর মুদ্রাস্ফীতির অভিশাপ, হিটলারের একনায়কতন্ত্র, নাৎসিবাদীদের দাঙ্গা-হাঙ্গামা, সাম্প্রদায়িকতা, নিরাপত্তাহীনতা ইত্যাদির মধ্যে আরেকটি মহাযুদ্ধের ভয়াবহতা পাঠককেও বেদনায় আচ্ছন্ন করে ফেলে।
উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র লাডউইগ বডমার প্রথম বিশ্বযুদ্ধফেরত এক সৈনিক। ২৫ বছরের টগবগে এক যুবক সে। যুদ্ধ শেষে এতিম লাডউইককে ওয়ার্ডেনব্রাক শহরে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দেয় একই ফ্রন্টে যুদ্ধ করা সহযোদ্ধা জর্জ। যদিও জর্জের বয়স ৪০ পেরিয়েছে, তবু তারা দুজন প্রাণের বন্ধু। জর্জ তার পৈতৃক ক্রল কোম্পানিতে কাজ দেয় লাডউইককে। এই কোম্পানিটি মৃতদের সমাধিতে নামফলক ও অন্যান্য জিনিসপত্র সরবরাহের কাজ করে। তবে দেশে মুদ্রাস্ফীতির কারণে ব্যবসাটাকে টিকিয়ে রাখাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। জর্জের বাবার আমল থেকে ৫০ বছর ধরে বাগানে পড়ে থাকা একটা কালো রঙের অবিলিস্ক (বিশেষ ধরনের দামি ও ভারী নামফলক) এই উপন্যাসে একটা বিশেষ প্রতীকী অর্থ বহন করে, সে ব্যাখ্যার আগে গল্পটা বলে নেই।
আর্থিক দৈন্যের কারণে লাডউইগ মানসিক প্রতিবন্ধীদের একটি আশ্রমের গির্জায় অর্গান বাদক হিসেবেও কাজ করত। পারিশ্রমিক কম হলেও এখানে ভালো খাবার জুটত লাডউইকের। আর এখানেই লাডউইকের পরিচয় হয় সুন্দরী-শিক্ষিত তরুণী ইসাবেলের সঙ্গে। তবে ইসাবেল স্কিৎজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত। তার মধ্যে ইসাবেল ও জেনি নামে দুটি আলাদা সত্ত্বা বাস করে। ডাক্তার ওয়ার্নিকের অনুরোধে ইসাবেলের সঙ্গে মেলামেশা শুরু করে লাডউইগ। ইসাবেলকে পছন্দ করত লাডউইক, দেশের অস্থিরতায় যাপিত বিপন্ন জীবনের মাঝখানে ইসাবেল লাডউইকের জীবনে এনে দিয়েছিল কিছু সুন্দর মুহূর্ত। কিন্তু একসময় ইসাবেল সুস্থ হয়ে যায়। তখন সে লাডউইককে আর চিনতেও পারে না। ইসাবেলের সুস্থতায় লাডউইকের খুশি হওয়ার কথা। অথচ বাস্তবে তার কাছে বন্ধু ইসাবেলের যেন মৃত্যু হলো। এমনকি সেই মৃত্যুর ব্যাপারটাও ইসাবেল জানতে পারল না।
একসময় লাডউইক বার্লিনে একটা খবরের কাগজের চাকরি নিয়ে প্রিয় শহর ওয়ার্ডেনব্রাক ও বন্ধু জর্জকে ছেড়ে চলে যায়। সেখানে সে ভালোই উন্নতি করে। একদিন ওয়ার্ডেনব্রাকে আসতে চাইলেও হিটলারের নিপীড়ন বৃদ্ধি পাওয়া সে চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালে আমেরিকায় আটকে থাকে লাডউইক। সাত বছর পর সে ফিরতে পারে জার্মানিতে।
১৭ বছর পর চিরচেনা ওয়ার্ডেনব্রাকে ফিরে আসে লাডউইক। কিন্তু ততদিনে এই শহর একবারেই অচেনা হয়ে গেছে যুদ্ধের তাণ্ডবে। তাই বারবার পথ হারায় লাডউইক। চিরতরে হারিয়ে গেছে বন্ধু জর্জও। হিটলারের উগ্র সমর্থকদের ষড়যন্ত্রে দেশদ্রোহের দায়ে বন্দিশিবিরে অমানুষিক অত্যাচারে মারা যায় জর্জ। হারিয়ে যায় ডাক্তার ওয়ার্নিকও।
স্মৃতিবিজড়িত সেই শহরে পড়ে ছিল শুধু বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি, আর সেই কালো রঙের অবিলিস্কটা। আবর্জনার স্তূপে অবিলিস্কের গায়ে তখনো খোদাই করা ছিল এক নর্তকীর নাম। ক্রম কোম্পানির সবচেয়ে দামি অবিলিস্ক ছিল এটি। শহরের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে টিকে থাকা সেই অবিলিস্কটা যেন দাঁড়িয়ে আছে যুদ্ধের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে।
অসংখ্য মানুষের মৃত্যু সম্পর্কে এ উপন্যাসে লেখকের একটি কথা এখনো অমর হয়ে রয়েছে : ‘মাত্র একজন মানুষের মৃত্যু বিয়োগান্তক, কিন্তু লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু কেবলই পরিসংখ্যান।’ পাঠক এই কথার সঙ্গে মিল পাবেন চার্লি চ্যাপলিনের বিখ্যাত সিনেমা মসিয়ে ভেঁর্দুর এক বিখ্যাত সংলাপে : One murder makes a villain. Millions a hero.