সমতলের আদিবাসীদের চৈত্র-বৈশাখ
তুরিদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ভারতের দুমকা থেকে। ঝুমটা নাচের গানেও পাওয়া যায় দুমকার অস্তিত্ব। দিনাজপুরের লোহাডাংগার তুরিদের মুখে শোনা গানটি— ‘কিনে দেব ঝুমকা/ ত লেয়ে যাব দুমকা’। এদের উৎসব ও আচারগুলো খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ।
দারিদ্রর মাঝেও এরা আকড়ে রেখেছে পূর্বপুরুষদের জাতধর্ম আর আদিবাসী সংষ্কৃতিটাকে। তুরিরা পুরনো বছরকে বিদায় আর নতুন বছরকে বরণ করে আদি রীতিতে।
বৈশাখের আগে এরা চৈত্র মাসের শেষ পাঁচদিন চৈতাবলির অনুষ্ঠান পালন করে। শুরুর দিন থেকেই ছাতুগুড় খেয়ে নাচগান করে। চৈত্রের শেষদিন বাড়িতে রান্না করে সাত পদের তরকারি। সাত পদ দিয়ে ভোজ সেরে এরা চৈত্রকে বিদায় দেয়। বিদায়ের সাথে সাথেই চলে নাচগান পর্ব।
চৈত্রের পরের দিনই বৈশাখ। বৈশাখ শুরু হলেই তুরিরা বন্ধ করে দেয় মাছ-মাংস খাওয়া। পুরো একমাস এরা খায় শুধুই নিরামিষ। প্রতিদিন মাটির প্রদীপ হাতে তুলসি ঠাকুরকে ভক্তি দেয় এরা। তুরি ভাষায় এটি ‘সান্দবাতি’। প্রদীপ জ্বালিয়ে পানি ছিটিয়ে উলুধ্বনি দিয়ে ভক্তি দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ঠাকুরের কাছে স্বামী, সন্তান আর সবার জন্য মঙ্গল কামনা।
বৈশাখের পুরো মাস প্রতি রাতে তুরি পাড়াতে চলে কীর্তন। কীর্তন করতে হয় শুধুই পুরুষদের। সৃষ্টিতত্ত্ব বিষয়ক কীর্তনই অধিক গাওয়া হয়। এ সময় কীর্তন শুনতে দূর দূরান্ত থেকে নানা বিশ্বাসের আদিবাসীরা ভিড় জমায় তুরি পাড়ায়। বৈশাখের শেষ দিকে এরা প্রতি বাড়ি থেকে চাউল তুলে একত্রে খিচরি (খিচুরি) রান্না করে খায়। ওইদিন আয়োজন হয় গান আর আদিবাসী নৃত্যের। এভাবেই বছরের প্রথম দিন থেকেই সৃষ্টিকর্তার কৃপালাভের আশায় চলে তুরিদের আদি আচারগুলো।
গবেষকরা মনে করেন মুণ্ডা জাতির পুরোহিতরাই ‘পাহান’ নামে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে বসবাসরত পাহানরা নিজেদেরকে আলাদা আদিবাসী জাতি হিসেবেই পরিচয় দেয়। এদের পূর্বপুরুষরা এসেছেন ভারতের ছোট নাগপুর ও রাঁচি থেকে।
পাহানরা মূলত সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। বৈশাখের আদি রীতি অনুসারে এরা নতুন বছরের প্রথম সকালে খেয়ে নেয় পানতা ভাত। কেন পানতা খায়? এমন প্রশ্নের উত্তর মিলে সত্তর বছর বয়সী শ্যামল পাহানের মুখে। তাঁর বাড়ি দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের শালবনের ভেতরের পাহান গ্রামে। গানের সুরে তিনি বললেন—
‘হামে লাগে প্রথমে আদিবাসীই
পনতা ভাত ভালোবাসি...’
ওইদিন দুপুরে ভাতের সাথে এরা ১২ ভাজা অর্থাৎ ১২ পদের তরকারি খেয়ে নেয়। সন্ধ্যায় ঠাকুরকে ভক্তি দিয়ে নাচগানের আসরের আয়োজন করে।
বৈশাখের মতো চৈত্রের শেষদিনেও পাহানরা আয়োজন করে নানা আচারের। এরা ওইদিন বাড়িঘর পরিষ্কার করে একে অপরের গায়ে কাঁদা আর রং ছিটায়। পূর্বপুরুষদের রীতি অনুসারে যার গায়ে কাঁদা বা রং দেওয়া হয় তাকেই খেতে দিতে হয় প্রিয় পানীয় হাড়িয়া। পাহানরা বিশ্বাস করে এতে তাদের বন্ধুত্ব আরো সুদৃঢ় হয়। চৈত্রের শেষদিন এবং বৈশাখের প্রথম দিনের এ উৎসবকে পাহানরা বলে সিরুয়া-বিসুয়া।
এ ছাড়া এরা চৈত্রমাসেই আয়োজন করে চৈতালিপূজার। রোগ থেকে মুক্তি পেতে ঠাকুরের কৃপা লাভই এ পূজার উদ্দেশ্য। এ পূজায় আগের রাতে উপোস থেকে পরেরদিন দুপুরে পূজার প্রসাদ দিয়ে উপোস ভাঙ্গাই নিয়ম। মঈনকাটা বা বেল গাছের নিচে মাটির উঁচু ডিবি তৈরি করে, লাল নিশান আর ধুপ কাঠি টাঙ্গিয়ে, পান, সুপারি,দুধ, কলা, দুর্বা ঘাস, বাতাসা, কদমফুল, সিঁদুর, হাড়িয়া দিয়ে ধুপ জ্বালিয়ে ঠাকুরকে পূজা দেওয়া হয় চৈতালিপূজায়। একই সাথে বলি দেওয়া হয় মানতের কবুতর, হাঁস কিংবা পাঠা। পূজা শেষে চলে খিচুরি খাওয়া। রাতভর চলে হাড়িয়া খাওয়া আর নাচগান।
সমতলের আদিবাসীদের মধ্যে সাঁওতালদের পরই ওরাওঁদের অবস্থান। বিহারের ছোট নাগপুর অঞ্চল থেকে এ দেশে এদের আগমন ঘটেছে। দিনাজপুরের বহবলদীঘির ওরাওঁ গ্রামের নিপেন টিগ্গাও জানান তেমনটি। ওরাওঁ গানেও তার সত্যতা পাওয়া যায়।
‘নাগপুরের নাগরাজা
নাভালায় বাত্তালানে
আদিবাসী হামিহেকী
ওরাওঁ জাতি...।’
ওরাওঁরা আদি থেকেই কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত। তাই তাদের উৎসবগুলো আবর্তিত হয় ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে। বৈশাখের প্রথম প্রহরেই এরা দল বেঁধে শিকারে বের হয়। কিন্তু তার আগেই পূজো দেয় বাঘমন্ত্রীকে। এদের বিশ্বাস এটা না করলে শিকার তো মিলবেই না বরং পড়তে হবে জীবন হারানোর মতো বিপদে। এ কারণেই তারা বনে ঢোকার আগে মাটিতে তীর-ধনুক রেখে, জল ছিটিয়ে দূর্বাঘাস ও আতপ চাউল রেখে ধূপ জ্বালিয়ে বাঘমন্ত্রীকে স্মরণ করে এবং তার সন্তুষ্টির জন্য পূজা দিয়ে থাকে। বিকেলে শিকার থেকে ফিরলে শিকারগুলো দিয়ে সম্মিলিতভাবে খিচুরি রান্না করা হয়। রাতভর চলে আদিবাসী নাচ-গান আর প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া। এভাবে বছরের প্রথম দিনটিকে এরা নানা আচার পালনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করে।
ওরাওঁরা অনেক গাছের পাতা খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। কেউ কেউ অভাবের সময় শুধু গাছের পাতা বা মূল খেয়ে বেঁচে থাকে। তাই চৈত্র মাসে এরা গ্রাম রক্ষাকারী আত্মাকে স্মরণ করে পূজা অর্চনা করে থাকে। এ সময় প্রতিটি পরিবার তাদের পূর্বপুরুষের কথা স্মরণ করে কিছু খাদ্য ভোগ হিসেবে তুলে রাখে এবং পূজা দেয়। পরিবারের সবার সুস্থতা কামনা করাই এর উদ্দেশ্য। কোনো কোনো পরিবার এ সময় মোরগ বলি দেয়। এ উৎসব চলাকালে নাচগানের মাধ্যমে প্রত্যেক ওরাওঁ পরিবার ঘরের প্রবেশ দরজায় প্রচুর পানি ঢালে এবং শালফুল ঘরের চালে ঝুলিয়ে দেয়।
সাঁওতালদের আদি উৎসবগুলো আবর্তিত হয় নানা ঋতুকে ঘিরে। আদি আচার পালনের মাধ্যমে এরা যেমন নতুন বছরকে বরণ করে তেমনি চৈত্রের শেষে বাহাপরব উৎসব পালন করে ধুমধামের সঙ্গে। দিনাজপুরের মহেশপুর গ্রামের বাহাপরব ও বৈশাখ উদযাপনের স্মৃতি আজও আমাদের আন্দোলিত করে।
সাঁওতালদের ভাষায় ‘বাহা’ মানে ‘ফুল ’ আর ‘পরব’ মানে ‘অনুষ্ঠান’ বা ‘উৎসব’। শালফুলকে সাঁওতালরা বলে ‘সারজম বাহার’। বাহাপরবের অনুষ্ঠানে এরা শালফুলকে বরণ করে নেয় কিছু আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে। এর আগে সাঁওতালদের ফুল ব্যবহারের নিয়ম থাকে না।
এ উৎসবে গোত্রপ্রধান উপোস অবস্থায় পুজো দেন বোঙ্গার (দেবতা) সন্তষ্টি লাভের জন্য। একটু উঁচু জায়গায় তিনটি ধনুক গেড়ে দেওয়া হয়। কুলার মধ্যে রাখা হয় চাল, সিঁদুর, ধান, দুর্বা ঘাস আর বেশকিছু শালফুল। উৎসবের প্রথমদিন পুজোর মাধ্যমে প্রথমে মুরগি বলি দেওয়া হয়। অতঃপর সাঁওতাল নারীরা শালফুল গ্রহণ করেন নানা আনুষ্ঠানিকতায়। একই সঙ্গে ওইদিনই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিলি করা হয় শালফুল। যে ফুল বিলি করে তাকে পা ধুয়ে বাড়ির ভেতরে নেওয়া হয়। সাঁওতালদের বিশ্বাস এভাবে ফুল রূপে দেবতা বা বোঙ্গাই তার ঘরে প্রবেশ করে ।
দ্বিতীয় দিনে সাঁওতালরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটানো অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এদের বিশ্বাস পানি ছিটানোর মধ্য দিয়ে পুরোনো যত হিংসা, বিদ্বেষ, শত্রুতা আছে তা দূর হয়ে যায়। বাহাপরবের তৃতীয় দিনটিতে চলে শুধুই নানা আনন্দ আয়োজন। খোঁপায় শালসহ নানা রঙের ফুল ঝুলিয়ে, হাত ধরাধরি করে নাচেন নারীরা। কণ্ঠ আকাশে তুলে তারা গায় ;
‘তোকয় কোকে চিয়ে লেদা বীর দিসাম দ:,
তোকয় কোকে টান্ডি লেদা বীর দিসাম দ:----’
বৈশাখের প্রথম প্রহরে সাঁওতালরা পুরোনো বছরের পানতা খেয়ে নতুন বছরের শুভ সূচনা করে। অতঃপর তাদের একদল তীর-ধনুক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে শিকারে। অন্য দলটি দলবেধে নদীতে ছুটে মাছ মারতে। মাছ মারাকে সাঁওতালরা বলে ‘হাকু গোজ চালাও’। নারীরা বাড়ি বাড়ি তেলের ও চিতল পিঠা তৈরি করতে থাকে। দুপুরে নানা পদ দিয়ে ভোজ সেরে নেয় এরা। এক সময় সাঁওতালরা বৈশাখে বিশ পদের রান্না দিয়ে ভোজ সারত। বিকেল থেকে সাঁওতাল গ্রামগুলোতে আয়োজন চলে ঝুমুর নাচের। সাঁওতাল নারীরা দলবেধে হাত ধরাধরি করে নেচে গেয়ে বরণ করে নেয় নতুন বছরকে। রাতভর চলে প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া।
অন্যান্য আদিবাসীর মতো ভুনজারদের জীবনপ্রবাহও নানা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে আবর্তিত হয়। শিকার, সিঁদুর ফোঁটা, খ্যামটা নাচ, ভক্তি পর্ব প্রভৃতি আদি আচারগুলো আজও সমৃদ্ধ করছে তাঁদের আদিবাসী সংস্কৃতিটাকে। চৈত্র মাসের শেষদিন আর বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি ভুনজাররা পালন করে বিশেষ আচারের মাধ্যমে। তাদের ভাষায় এটি চৈত-বিসিমা উৎসব। এ উৎসবের অংশ হিসেবে এরা চৈত্র মাসের শেষ সন্ধ্যায় বাসন্তী পূজা করে। এটি কেন করা হয়, তার উত্তরটি মিলে দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী বহবলদীঘির ভুনজার গ্রামের প্রধান বাতাসু ভুনজারের মুখে।
এক সময় আদিবাসী গ্রামগুলোতে চিকিৎসার ব্যবস্থা ছিল না। তখন ডায়রিয়া আর বসন্তে মারা যেত শত শত লোক। এ রোগ দুটো থেকে মুক্তি পেতেই ভুনজাররা মাটির ঘটিতে আমপাতা, কলা, নারকেল, ধূপ আর চার ফোঁটা সিঁদুর দিয়ে ঠাকুরের পূজা করে। বসন্ত রোগ থেকে মুক্তির পূজা বলেই এর নামকরণ হয়েছে বাসন্তী পূজা। কেউ কেউ এই দিনেই বলি দেয় মানতের হাঁস, মুরগি কিংবা পাঁঠা। এর আগে চৈত্রের শেষ শুক্রবার এরা উপোস থাকে। উদ্দেশ্য ঠাকুরের সন্তুষ্টি ও রুজি বৃদ্ধি। উপোস অবস্থায় খাওয়া যায় শুধুই ফলমূল আর দুধ। বাসন্তী পূজা শেষে ভুনজাররা কালাইসহ নানা ধরনের ছাতু-গুড় খেয়ে আনন্দ ফূর্তিতে মেতে ওঠে। রাতভর চলে নাচের আসর।
বৈশাখের প্রথম দিন খুব ভোরে ভুনজাররা দলবেধে বেড়িয়ে পড়ে শিকারের উদ্দেশ্যে। এটিই তাদের আদিবাসী রীতি। শিকারের আদি অস্ত্র তীর-ধনুক। তবে ঘর থেকে বের হওয়ার আগে এরা কাঁচা মরিচ আর পেঁয়াজ দিয়ে সেরে নেয় পানতা খাওয়া। এদের বিশ্বাস পানতা খেলে সারা বছর গায়ে রোদ লাগলেও তারা কষ্ট পাবে না। পানতার পানি বছর জুড়ে তাদের শরীরকে ঠাণ্ডা রাখবে। শিকার থেকে ফিরে ওইদিন বিকেলেই শিকারগুলো দিয়ে এরা সম্মিলিতভাবে খিচুরি রান্না করে। রাতভর চলে নাচ-গান আর প্রিয় পানীয় হাড়িয়া খাওয়া।
‘পানের ডেলা পানে রইল
সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল, মা
সুপারিতে ঘুনো লাগি গেল
হে সেবেল, সেবেল, ওয়াহাগলে, ওহাগলে, হে...’
একবার এক বৈশাখে বাতাসুর ছেলে রবি ভুনজার ও তার দলের কণ্ঠে উঠে আসে এমন গানের সুরটি। গানের তালে চলে খ্যামটা নাচ। একদল আদিবাসী নারী হাত ধরাধরি করে নানা ভঙ্গিমায় নাচে। নাচ-গান আর নানা আচারে ভুনজাররা বরণ করে নেয় নতুন বছরটিকে।