ঢাকার কথা ১১
ঢাকায় ছাপাখানা ও মুসলমানি পুঁথিপট্টি
বৃহত্তর বাংলায় উনিশ শতকের আগে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মধ্যযুগে বাংলায় নানা ধরনের সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছিল। তবে তা সবই ছিল পাণ্ডুলিপি। যে কারণে সাধারণ্যে সাহিত্যের বিস্তার ঘটা সম্ভব হয়নি। উনিশ শতকের শুরুতে খ্রিস্টধর্ম প্রচার করতে স্যার উইলিয়াম কেরি বাংলায় আসেন। কলকাতার কাছে শিরামপুরে তিনি মিশনারি স্থাপন করেছিলেন। এই ডাচ মিশনারি বাঙালির সামনে ইংরেজি শিক্ষার দ্বার খুলে দেন। যিশুর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ছাপাখানার প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন তিনি। তাই জার্মানি থেকে মুদ্রণযন্ত্র কিনে এনে এ দেশে ছাপাখানার যাত্রা শুরু করলেন। এই ছাপাখানা সংবাদপত্র ছাপার যাত্রাও সূচনা করেছিল। কেরি নিজেই ‘সমাচার দর্পণ’ নামে বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। টেক্সট বই প্রকাশিত হয় তাঁর ছাপাখানা থেকে। এভাবে ছাপাখানা উনিশ শতকে শিক্ষা ও সাহিত্য বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
ঢাকায়ও একই ধারাবাহিকতায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এখানেও খ্রিস্টান মিশনারিরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। একটি সূত্র থেকে জানা যায়, ১৮৪৮ সালে পুরান ঢাকার ছোটকাটরায় একটি ছোট আকারের ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই ছাপাখানা স্থাপন করেন ব্যাপ্টিস্ট মিশনারিরা। ছাপাখানাটির সঙ্গে যাঁর নাম জড়িয়ে আছে, তিনি হচ্ছেন আলেকজান্ডার ফারবেক। অবশ্য এর কিছুটা আগে রংপুরে একটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকায় স্থাপিত এই ছাপাখানার নাম ছিল ‘ঢাকা প্রেস’। অবশ্য এই প্রেসে কোনো বাংলা টাইপ ছিল না। ইংরেজিতেই সবকিছু মুদ্রিত হতো। ঢাকা প্রেস থেকে প্রকাশিত হতো ‘ঢাকা নিউজ’ নামে একটি সংবাদপত্র।
এরই পদাঙ্ক অনুসরণ করে ১৮৬০ সালে ঢাকায় কিছুটা বড় আঙ্গিকে একটি বাংলা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। সাধারণভাবে ‘বাঙ্গালা যন্ত্র’ নামে এর পরিচিতি ছিল। এই ছাপাখানা প্রতিষ্ঠায় ব্রজসুন্দর মিত্র, ভগবান চন্দ্র বসু প্রমুখের নাম জড়িয়ে আছে। একটি ছাপাখানাকে কেন্দ্র করে শিক্ষা ও সাহিত্যচর্চার বিকাশ ঘটে থাকে। ঢাকার এই বাঙ্গলা যন্ত্রও তৎকালে ঢাকার সাহিত্যচর্চায় বিশেষ প্রণোদনা দিয়েছিল। এই বাঙ্গালা যন্ত্রে ১৮৬০ সালে দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীল দর্পণ’ ছাপা হয়। ছাপাখানাটির সঙ্গে ঢাকার সাহিত্য বিকাশের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ঢাকার প্রথম সাহিত্য পত্রিকা ‘কবিতাকুসুমাবলী’ এই প্রেস থেকেই ছাপা হয়। ‘ঢাকা প্রকাশ’ ছিল সে যুগে ঢাকার বিখ্যাত সংবাদ সাময়িকী। ঢাকা প্রকাশের অফিসও ছিল বাঙ্গালা যন্ত্রের কার্যালয়ে।
১৮৬৩ সালে ঢাকার ইমামগঞ্জে আরেকটি ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নাম ছিল ‘সুলভযন্ত্র’। প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাম পাওয়া যায় হরিশচন্দ্র মিত্র নামের একজন কবির। এই ছাপাখানার বিশেষত্ব হচ্ছে, এখানে মুসলমানি পুঁথি ছাপার উপযোগী বিশেষ ধরনের হরফ ছিল। তাই প্রেসটি থেকে প্রথম বেশ কয়েকটি মুসলমানি পুঁথি প্রকাশিত হয়।
১৮৬৬ সালের মধ্যে ঢাকায় স্থাপিত ছাপাখানার সংখ্যা ছিল মোট তিনটি। এসব ছাপাখানা থেকে নানা গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। এভাবে ছাপাখানাগুলোকে কেন্দ্র করে ঢাকায় পাঠক ও সাহিত্যসমাজ গড়ে ওঠে। তবে এ পর্যন্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর থেকে ছাপাখানা প্রতিষ্ঠায় কেউ এগিয়ে আসেনি। মুসলমান মালিকানায় ঢাকায় প্রথম ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭৩ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মুন্সি মোহাম্মদ জান। আগা ফজলে আলী বাজারের কাছে তাঁর বাড়ি ছিল। এই বাজারই পরবর্তীকালে মৌলভীবাজার নামে পরিচিত হয়। তাঁর প্রেসের নাম দেওয়া হয় ‘মুহম্মদীযন্ত্র’। মুসলমান মালিকানার দ্বিতীয় প্রেসের নাম ‘আজিজিয়া প্রেস’। এটি স্থাপিত হয়েছিল ছোটকাটরার চম্পাতলীর গলিতে ১৮৭৬ সালে। প্রেসের মালিকের নাম মুন্সি ফয়েজ উদ্দিন। আগা ফজলে আলী বাজারে আরেকটি প্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৯৫ সালে। মোহাম্মদ এমদাদুল্লাহর মালিকানাধীন এই প্রেসের নাম ছিল ‘ইমদাদুল এসলামিয়া প্রেস’। এসব ছাপাখানা থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানি পুঁথি ছাপা হয়।
ঢাকার ছাপাখানায় পুস্তক প্রকাশনার যাত্রা উনিশ শতকের আগে শুরু হওয়ার কথা জানা যায় না। খ্রিস্টান মিশনারিদের ধর্মীয় পুস্তক এবং দু-একটি হিন্দু সাহিত্যিকের গ্রন্থ প্রকাশ বাদ দিলে উনিশ শতকের প্রথম পর্বের শেষ দিকে এবং দ্বিতীয়ার্ধে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমান কবির রচিত পুঁথি প্রকাশিত হতে থাকে। এভাবে চকবাজারে ‘কেতাবপট্টি’ নামে পুঁথি প্রকাশ ও বিক্রয়কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।
সতেরো ও আঠারো শতকে মুসলমান কবিরা অনেক পুঁথি রচনা করেন। তখন ছাপাখানা ছিল না। এসব পুঁথি পাওয়া গেছে পাণ্ডুলিপি আকারে। তখন পুঁথি গ্রামবাংলার শিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত মানুষের মুখের ভাষায় রচিত হতো। প্রচুর আরবি, ফারসি শব্দ ব্যবহার করতেন কবিরা। এই ভাষা একসময় মুসলমানি বাংলা নামে পরিচিতি পায়। চকবাজার থেকে প্রকাশিত পুঁথিগুলো সাধারণত একই আকৃতির হতো। গ্রামের মানুষ যাতে কূপির আলোতে সহজে এসব পুঁথি পড়তে পারে, তাই ছাপা হতো অপেক্ষাকৃত বড় অক্ষরে। পুঁথির প্রচ্ছদ তৈরিতে ব্যবহার করা হতো সাদা অথবা রঙিন কাগজ। চারদিকে লতাপাতা এঁকে অঙ্গসজ্জা করা হতো প্রচ্ছদপটে।
সাধারণ ক্রেতার কথা বিবেচনা করে এসব পুঁথির দাম ধরা হতো খুব কম। চকবাজারের পুস্তক প্রকাশকরা পুঁথির প্রচারের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতেন। শুরুর দিকে চকবাজারের পশ্চিম দিকে কয়েকটি পুস্তক বিপণি প্রতিষ্ঠিত হয়। এদিকে ছাপাখানাও স্থাপিত হয়েছিল। এর আগে ‘ইতিহাসের খেরোখাতায়’ ছাপাখানার কথা লেখা হয়েছে। আসলে ছাপাখানাকে কেন্দ্র করেই পুঁথি প্রকাশের যাত্রা শুরু হয়।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুন্সি হায়দার জান নামে ঢাকায় একজন পুঁথি রচয়িতা ছিলেন। চকবাজারের মুসলমানি পুঁথিপট্টিতে তাঁর একটি দোকান ছিল। এই কবির রচিত কাব্যগ্রন্থের নাম ছিল ‘খলিল গোলজার’। পুঁথিপট্টির আরেক দোকান মালিকের নাম মুন্সি আলিমুদ্দিন। তিনি প্রকাশ করেন কবি গোলাম মাওলার লেখা পুঁথি। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য পুঁথিগুলো হচ্ছে ‘শাহরুমের কেচ্ছা’, ‘জেবল মুলক ও মেহের জামাল’ এবং ‘তজহিজ তকফিন’। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুসলমানি পুঁথি প্রকাশিত হয়েছিল আজিজিয়া প্রেস থেকে। এই প্রেসের মালিক মুন্সি ফয়েজউদ্দিন নিজে একজন পুঁথিকার ছিলেন। তাঁর বইয়ের দোকান ছিল মোগলটুলিতে।
এ যুগে প্রকাশকরা পুঁথির মধ্যে নানাভাবে বইয়ের বিজ্ঞাপন দিতেন। যেমন মুন্সি ফয়েজউদ্দিন তাঁর ‘তালেনামা’ পুঁথিতে বিজ্ঞাপন দেন এভাবে, ‘এই সকল কেতাব যাহাদের দরকার হইবে তাহারা মোকাম ঢাকায় মোগলটুলি আমার কেতাবের দোকানে শ্রীযুক্ত হাফেজ মনিরুদ্দিন ছাহেবের নিকট কিম্বা ঠাটারুবাজার আমার বাটিতে তালাশ করিলে পাইবেন।‘ আবার মুন্সি আলিমউদ্দিনের দোকানের বিজ্ঞাপনের ভাষা ছিল এমন, ‘এই কেতাব যাহার আবিশ্বক হইবে তিনি অত্র শহরের চৌকবাজারের পশ্চিম অধিনের কেতাবের দোকানে তত্ত করিলে পাইবেন।’
মুসলমানি পুঁথিপট্টি ক্রমে চকবাজার ছাড়িয়ে অন্যত্রও বিস্তার লাভ করে। যেমন বেশ কয়েকটি দোকান ছিল মোগলটুলি, বড়কাটরা, ছোটকাটরা, চম্পাতলী, ইমামগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায়। এ যুগে বইয়ের দোকান ছাড়াও ছাপাখানা, প্রকাশক ও লেখকের বাড়িতেও বই বিক্রি করা হতো।
পুস্তক প্রকাশ বা বিক্রি ছাড়াও ঢাকার পুঁথিপট্টির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। তা হচ্ছে পুঁথিকারদের নিয়ে একটি সাহিত্য সংগঠন গড়ে তোলা। এই সাহিত্য সংগঠন যাঁদের পদচারণায় মুখরিত হতো, তাঁরা হচ্ছেন ফয়েজউদ্দিন, খোয়াজ ডাক্তার, মনিরউদ্দিন ডাক্তার, হায়দার জান, মোহাম্মদ জহিরউদ্দিন প্রমুখ। ঢাকার মুসলমানি পুঁথি রচয়িতারা তাঁদের পুঁথির পাঠকশ্রেণি তৈরি করতে পেরেছিলেন। ফলে ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে পুঁথির সমাদর বেড়ে গিয়েছিল।