বিজয়ের ৪৪ বছর
কথাসাহিত্যে অর্জন, মোটা দাগে
আগামী ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার ৪৫ বছরে পা রাখবে বাংলাদেশ। এই সময়টার মধ্যে আমাদের সাহিত্যে যা কিছু অর্জন তার একটা ভিত্তি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়িয়ে ৪৭-এর ভাষা আন্দোলন পর্যন্ত বিস্তৃত। বৃক্ষের রূপক ব্যবহার করলে আমরা দেখব, গাছের ডালপালা সমেত যে অংশটা আমরা দেখতে পাই, সেটা হলো ১৯৭১ সাল থেকে বর্তমান সময়টা পর্যন্ত। মাটির তলে গাছের যে অংশটা, সেটি ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত সময়টা। আর বৃক্ষের কাণ্ডটা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের চূড়ান্ত নয় মাস। অর্থাৎ বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে কথা বলতে হলে, শুরুটা করতে হবে ভাষা আন্দোলন থেকে; আর আলোটা এসে পড়বে স্বাধীনতার পরের সময়টাতে।
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগের ২৩ বছর ছিল আমাদের প্রস্তুতির সময়- জাতীয়তাবাদ প্রশ্নে, রাজনৈতিক প্রশ্নে, শিল্পসাহিত্য প্রশ্নে, আমরা একটু একটু করে দাঁড়াতে শুরু করেছিলাম। সাহিত্যের একটা বিরাট অংশ তখন সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে লেখা হয়েছিল। ১৯৩৫ সালে জার্মান কমিনটার্নের বিশ্ববরেণ্য নেতা ডিমিট্রিয়ফ সাহিত্যিকদের কাছে আবেদন করেছিলেন, ‘help us, help us the party of the working class, the commintern—give us a keen weapon in artistic form in poetry, novels and short stories—to use in this struggle’। সেই আবেদনে সাড়াও মিলেছিল বেশ। একইভাবে আমরা দেখেছি, সময়ের ডাকে বাংলার সাহিত্যিকরাও নড়েচড়ে বসেছেন। এই ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে তাদের পুরোনো গদ্যরীতি বা বিন্যাসরীতি বাতিল করে নতুন করে ভাষা ও বর্ণনাশৈলী নির্মাণ করতে হয়েছে। বিদ্যাসাগরী গদ্য, আলালী গদ্য, বঙ্কিমী গদ্য অবসরে চলে গিয়েছিল আগেই। নতুন গদ্যরীতি থেকে ফার্সি, আররি ও উর্দু শব্দের ব্যবহার কমে গেল।
সাংস্কৃতিক আন্দোলন হিসেবেই বাংলার বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাকে সাহিত্যিকরা তুলে আনলেন লেখনীতে। মোটাদাগে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ নোয়াখালীর, শামসুদ্দীন আবুল কালাম আজাদ বরিশালের, শাহেদ আলী সিলেটের, আবু ইসহাক বিক্রমপুরের, আলাউদ্দিন আল আজাদ চট্টগ্রামের এবং হাসান আজিজুল হক বরেন্দ্র অঞ্চলের ভাষা ব্যবহার করলেন। সাহিত্য হয়ে উঠল এক অর্থে গণসাহিত্য। ভাষার সরলীকরণের সঙ্গে যোগ হলো আধুনিক চেতনা ও বিশ্ববোধ। সবমিলে বাংলাদেশের সাহিত্যের একটা স্বকীয় চেহারার শক্ত ভিত গাঁথা হয়ে গিয়েছিল ১৯৭১-এর আগেই। সেটি যেমন কবিতায়, তেমন গল্পে, তেমন প্রবন্ধে, তেমন নাট্যে। এবং এর দৃশ্যত যে অর্জন সেটি পেতে থাকলাম আমরা দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমাদের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ অর্জন হলো ভাষা। খাতা-কলমে ১৯৫৬ সালে সংবিধান পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান করা হয় বটে; কিন্তু ১৯৭১ সালে কোনো কারণে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত হলে বা স্বাধীনতা অর্জন বিলম্বিত হলে, ভাষার ওপর আবার একটা আঘাত আসত। বাঙালিরা নতুন-পুরোনো মিলে বাংলা সাহিত্যের যে ঐতিহ্য, সেটি লালন করার এমন অপার সুযোগ পেত না। ফলে এটাকে আমরা একটা বড় অর্জন হিসেবে দেখতে পারি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পূর্ববর্তী লেখকরা মনের আনন্দে কলম ধরলেন। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের কবি-সাহিত্যিকরা উজ্জীবিত তরুণ হয়ে গেলেন যেন! তারা মনের আনন্দে লিখতে শুরু করলেন। তবে বেদনা একটা নিশ্চয় ছিল- নতুন দেশ, নানা সংকট। এরই মাঝে খুন হলেন জাতির জনক। বীভৎস নির্মমতার শিকার হলো তাঁর পরিবার। ক্ষমতায় এলো স্বৈরাচারী শাসক, সেনাবাহিনীর উত্থান ঘটল। মৌলবাদী রাজাকারদের ক্ষমতায় পুনর্বাসন করা হলো। এসব তো কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশের চিত্র ছিল না। কাজেই নতুন দগদগে ঘা থেকে নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হলো।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে বাংলা সাহিত্য নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য থেকে গণমুখী চেতনা থেকে সরে এসে ব্যক্তিমুখী হতে থাকল। কারণ, স্বাধীন দেশে সমষ্টির মতোই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল একক। প্রত্যেক ব্যক্তি তখন তার অধিকার নিয়ে জেগে উঠেছে। দলে দলে মানুষ শিক্ষিত হচ্ছে। মানুষ শহরমুখী হচ্ছে আর তার ঝটকা গিয়ে লাগছে গাঁগুলোতে। রাষ্ট্রের সঙ্গে, আমলাতন্ত্রের জটিলতার সঙ্গে নতুন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ছে ব্যক্তি। অন্যদিকে দেশে একটা নব্য শ্রেণি গড়ে উঠছে, তাদের হাত ধরে গড়ে উঠছে পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা। এটা আশির ও নব্বইয়ের দশকের একটা আপাত চিত্র। করপোরেট ব্যবস্থা ঝেঁকে বসল আরো খানিকটা পরে।
স্বাধীনতার পরের সাহিত্যকে আমরা দুটো অংশে ভাগ করতে পারি। এক. একাত্তর থেকে নব্বই পর্যন্ত। দুই. নব্বই থেকে বর্তমান পর্যন্ত। একাত্তরের আগে যেমন ষাটের দশক, তেমন একাত্তরের পরে আশির দশক বাংলা সাহিত্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই সময়কে আমরা হিস্ট্রি অব মোমেন্টস বলতে পারি।
বাংলাদেশের কথাসাহিত্যের ভিত্তিপ্রস্তর নির্মাণে যাঁদের অবদান অপরিসীম, তাঁদের যে কয়েকজনের নাম এই মুহূর্তে আমার মাথায় আসছে তাঁরা হলেন : রশীদ করীম, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আবদুল গাফফার চৌধুরী, সৈয়দ শামসুল হক, রাবেয়া খাতুন, শওকত আলী, আবুল ফজল, শওকত ওসমান, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্, সরদার জয়েনউদ্দীন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, হাসান আজিজুল হক, আবদুশ শাকুর, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, হুমায়ুন কাদির, দিলারা হাশেম, রিজিয়া রহমান, আবুবকর সিদ্দিক, সেলিনা হোসেন, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, মাহমুদুল হক, রাহাত খান, হাসনাত আবদুল হাই, আবদুল মান্নান সৈয়দ, কায়েস আহমেদ প্রমুখ সাহিত্যিক।
আশির দশকে আমরা নতুন সাহিত্যিক হিসেবে পেলাম শহীদুল জহির, হরিপদ দত্ত, নাসরিন জাহান, মঞ্জু সরকার, মামুন হুসাইন, ইমতিয়ার শামীম, শাহাদুজ্জামান, হুমায়ূন মালিক, ওয়াসি আহমেদ, মহীবুল আজিজদের। এঁদের কয়েক বছর আগে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ইমদাদুল হক মিলন, মইনুল আহসান সাবের ও হুমায়ূন আহমেদকে। নব্বই দশক থেকে আমরা পেলাম রফিকুর রশিদ, আহমেদ মোস্তফা কামাল, প্রশান্ত মৃধা, জাকির তালুকদার, পাপড়ি রহমান, অদিতি ফাল্গুনীসহ আরো অনেককে। স্বাধীনতার অন্যতম অর্জন হলো সাহিত্যিকদের এই পরম্পরা।
আশির দশক থেকে বাংলা সাহিত্যে ইমদাদুল হক মিলনের হাত ধরে যে জনপ্রিয় সাহিত্যের ধারা তৈর হলো এবং যেটি চূড়ান্ত রূপ পেল হুমায়ূন আহমেদের হাত ধরে, তাকেও আমরা আমাদের সাহিত্যের অর্জন হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। তাঁরা আসার আগে পশ্চিম বাংলার জনপ্রিয় লেখকরা পূর্ববাংলায়ও ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু এক হুমায়ুন আহমেদের কারণেই আমাদের পাঠকরা ঘরমুখী হলেন।
লেখক : কথাসাহিত্যিক