আলবেয়্যার কামু : নৈরাশ্য ও ভালোবাসায় এক ভ্রমণ
সুখ ছাপিয়ে যাঁরা নীতিকেই প্রাধান্য দেন, তাঁরা আদতে সুখী হওয়ার বিষয়টিকেই মানতে চাননি-জীবনের শেষদিকে নিজের নোটবুকে এভাবেই কথাগুলো লিখেছিলেন আলবেয়্যার কামু। ১৯৬০ সালের এই দিনটিতেই (৪ জানুয়ারি) ৪৭ বছর বয়সে চলে গিয়েছিলেন তিনি। সত্যিই তো, আমাদের নীতি সব সময়েই আমাদের দৈনন্দিন অভ্যাসের খাঁজে আটকে থাকে, তাতে আর যাই হোক- সুখী হয়ে ওঠার সাধ বা সক্ষমতা বাড়ে না এতটুকুনও।
এই দৈনন্দিন অভ্যাসের থেকে হঠাৎ করে ছুটি মিললে বা অভ্যাস থেকে সরে এলে সুখের স্বরূপ মেলে একটুর জন্য হলেও। কামু সেটা জানতেন। নোবেল পুরস্কার অর্জনের এক দশক আগে, তাঁর বয়স তখন মোটে বাইশ, তখনই তিনি ‘লাভ অব লাইফ’ নামের এক অসামান্য নিবন্ধে জানিয়েছিলেন এ বিষয়ে তাঁর মনোভাব। মানব মানসের বহুমাত্রিক জটিলতা আর অপার্থিব সৌরভ যেন জমাট বেঁধেছিল তাঁর ওই লেখায়।
স্পেনীয় ক্যাবারেতে অনন্য ছন্দে নাচতে থাকা এক নারীকে বুঁদ হয়ে দেখতেই দেখতেই কামু লিখেছিলেন অনেক কিছু। কামু সারা জীবনই বলতে চেয়েছিলেন, ‘ব্যাপারখানা এমন যে সুখী হওয়াটা বাধ্যতামূলক কিছু একটা’! কামু লিখেছিলেন-
“কাফে আর পত্রিকা ছাড়া তো ভ্রমণ করাটা ঝক্কির। ওতে ভর করে অন্যদের সঙ্গে সন্ধ্যেয় ঘাড় গুজে গুঁতোগুঁতি করা যায়, আমরা সহজাত পারিবারিক আচরণগুলো করতে পারি, আর পুরো জিনিসটা তো আমাদের নিজেদের ভাষায় লেখা। অনেক দূর থেকে তো আমাদের নেহাত এক আগন্তুকের মতোই দেখায়। সংশয়ই ভ্রমণের মাঝে এনে দেয় অনেক দাম। আমাদের ভেতরকার খোলনলচেটা গুঁড়িয়ে দেয় ভ্রমণ। দপ্তরে কিংবা কারখানায় কাটিয়ে দেওয়া ঘণ্টাগুলোর খোলসের আড়ালে নিজেকে সবাই লম্বা সময় ধরে লুকিয়ে রাখতে পারে না, ধোঁকা দিতে পারে না নিজেকে (আমরা ওই সময়টাকে খুব গুরুত্ব দিয়ে জিইয়ে রাখি, বিশ্বাস করে উঠতে চাই যে ওই সময়টা আমাদের একাকী হয়ে ওঠা থেকে রক্ষা করে)। আমি সব সময়েই এমন সব উপন্যাস লিখতে চেয়েছি যেখানে নায়করা বলে উঠবে, ‘বটে, অফিসে কাজ না করলে আমি করবটা কী?’ কিংবা আবার বলবে, ‘আমার স্ত্রী গতকাল মরে গেছে, তবে এই চালানের হিসাবটা আমার কাল নাগাদ সেরে ফেলতেই হবে।’ এমন হাল থেকে ভ্রমণ মোটামুটি আমাদের একেবারে ছিনিয়ে নিয়ে যায় উদ্ধত ডাকাতের মতো। আমাদের নিজেদের মানুষজন, নিজের ভাষা, পোশাক-আশাক, বেশভূষো, আমাদের মুখোশে আঁটা মুখ-সব থেকে আমাদের হটিয়ে দিয়ে, নিয়ে আসে আমাদের প্রকৃত, নিজস্ব চারণভূমিতে। সেই সঙ্গে সবকিছুই আমরা গুছিয়ে নিই, সবকিছুকে সেগুলোর খাঁটি দামটা দিই। মাথায় কোনো চিন্তা ছাড়াই একজন নারী নেচে যাচ্ছে, টেবিলে রাখা একখানা বোতল, পর্দার আড়াল থেকে এক লহমার চাহনি-প্রতিটি প্রতিচ্ছবিই যেন একান্ত প্রতীক। পুরো জীবনের প্রতিফলন ফুটে ওঠে এতে, এক মুহূর্তে পুরো জীবনের হিসাবটাও সংক্ষেপে তুলে ধরে এই ছবি। প্রতিটি উপহার নিয়ে আমরা যখন সন্দিহান হয়ে পড়ি, তখন এর যে বৈপরীত্যের ধার, সেটিও আমরা উপভোগ করি বটে আর তার তৃপ্তি লিখে প্রকাশ করার নয়।”
অবশ্য তিনি এভাবেও বলেছেন একই সঙ্গে-
‘জীবনের জন্য আমার সবটা ভালোবাসাই এখানে, এক নিমগ্ন তাড়না- যা আমায় পেরিয়ে যাবে, অগ্নিশিখার আড়ালে তিক্ততা রয়ে যাবে। প্রতিটি দিন আমি যখন আমার পথ থেকে সরে সরে আসি, চলে যাই অন্য কোথাও, নিজের থেকে-পৃথিবীর নৈমিত্তিক ব্যাপারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে বুঝি, নৈরাশ্য ছাড়া জীবনের জন্য কোনো ভালোবাসার অস্তিত্বও নেই।’
উৎপাদনশীলতার দিকে লাগামহীন ছোটাছুটি আমাদের কীভাবে সুখের মুখ থেকে সরিয়ে দেয়, তা নিয়ে কামু বলেছেন এভাবে-
‘জীবনটা খুব ছোট, কাজেই সময় নষ্ট করাটাও পাপ। সবাই বলে যে আমি চালু রয়েছি, কিন্তু আমি চালু থাকা মানেই কিন্তু অন্য কারো সময় নষ্ট করা- যদি সে অন্য মানুষটি নিজে চালু থাকতে গিয়ে নিজেই অনবরত হারতে থাকে। আজকের সময়টা বিশ্রামের, আর আমার হৃদয় নিজেই নিজেকে খুঁজে বেড়ানোর অভিযাত্রায় নেমেছে। এখন আমার পুরো অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে আটকে নেই, এর পরিধি ছাড়িয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে আমার চৈতন্যের জগৎ। এই সূর্য আর ছায়া, বাতাস থেকে ভেসে আসা উষ্ণতা আর শীতলতা : অবাক হওয়ার কী আছে যদি এতে আক্ষেপ আর মৃত্যুর নিশ্বাস থাকে; আর যদি আমার এই দুঃখগুলো জানালার গরাদ গলে আছড়ে পড়া সূর্যালোকে মিশে থাকে? আমি একমুহূর্তে এটাই বলতে পারব, আর এটাই বলব যে, মানুষ হয়ে ওঠা আর সাধারণ হয়ে ওঠাটাই আসল কথা। তবে শুধু এটাই না, সত্যই শাশ্বত, আর তাতে সবই খাপ খায়- সাধারণ থাকা, মনুষ্যত্ব। আমিই যখন পৃথিবী, তার চেয়ে বেশি সত্য আমি আর কখনই বা হতে পারি? আমি এখনকার জন্য সুখ চাই না, নেহাত একটু মনোযোগ চাই।’
ব্রেইন পিকিংস অবলম্বনে