ঢাকার কথা ২০

চক মসজিদ

Looks like you've blocked notifications!

চক বাজারে মোগল আমলে নির্মিত মসজিদটি সাধারণ্যে চক মসজিদ নামেই পরিচিত। অনেকে বলেন চকবাজার শাহী মসজিদ। মসজিদটি এখন আধুনিক ঔজ্জ্বল্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও এটি যে প্রায় চারশ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে আছে বর্তমান প্রজন্মের তা বোঝার উপায় নেই। আমাদের দুর্ভাগ্য হাজার বছরের ঐতিহ্য লালিত এই দেশের অধিবাসী হয়েও আমরা ততটা ঐতিহ্য সচেতন নই। ঐতিহ্য সংরক্ষণে সচেতন পদক্ষেপ খুব একটা নিতে পারি না। সরকারিভাবে যাদের দেখভাল করার কথা তারা অনেক সময় দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। আবার তাদের অনেক সীমাবদ্ধতাও থাকে। স্থানীয় মানুষদের অসচেতনতা ও প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপেও অনেক স্থাপনার ঐতিহ্য অবলুপ্ত হয়ে যায়। এমনই দুর্ভাগ্য বরণ করতে হয়েছে চকবাজার মসজিদেরও। ঐতিহ্য সচেতন যেকোনো দেশে এমন একটি প্রত্ন ঐতিহ্যকে আগলে রাখত পরবর্তী প্রজন্মকে অহংকারী করে তুলতে। নিজ দেশের ঐতিহ্যিক আভিজাত্যকে ভবিষ্যতের সামনে উন্মোচিত করতে। সম্ভব ছিল চক বাজার মসজিদটিকে আগের অবস্থায় সংরক্ষণ করে অন্য কোথাও নামাজের জন্য আধুনিক মসজিদ নির্মাণ করা।

সুবাদার শায়েস্তা খান চকবাজারের পশ্চিম প্রান্তে ১৬৭৬ সালে এই মসজিদ নির্মাণ করেন। মসজিদটির বাড়তি গুরুত্ব এই যে সুবাদার এই মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়েই চকবাজারের উদ্বোধন করেছিলেন। এরপর মসজিদকে ঘিরে বাজার সম্প্রসারিত হওয়ায় এখন মসজিদটি চকবাজারের কেন্দ্রস্থলে বলে মনে হবে। বর্তমানে মসজিদটির উত্তর দেয়াল ভেঙ্গে সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আর পূর্বদিকের বাড়তি অংশে নির্মাণ করা হয়েছে বহুতল ভবন। এই তিনগম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটির গম্বুজ ভেঙে আরেকটি তলা নির্মাণ করা হয়েছে। এই দ্বিতল ছাদের ওপর নতুন তিনটি গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। যদিও এখন আগের বৈশিষ্ট্য নেই তবুও এককালে এই মসজিদের দেয়াল ছিল মোগল রীতি অনুযায়ী পুরু। প্রবেশ দরোজার খিলানগুলো ছিল চওড়া আর প্রশস্ত। এই ধরনের রীতি প্রচলিত ছিল আওরঙ্গাবাদ ও আহমদ নগরে। শায়েস্তা খান একজন খ্যাতিমান নির্মাতা হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। তিনি দক্ষিণ ভারতীয় রীতি এ দেশে জনপ্রিয় করে তোলেন। মোগল মসজিদগুলো সাধারণত মাটি থেকে উঁচু প্লাটফরমের ওপর তৈরি করা হতো। চক মসজিদটির প্লাটফর্ম ছিল মাটি থেকে দশফুট উঁচুতে। আদিতে মসজিদটির দৈর্ঘ্য ছিল ৫০ ফুট আর প্রস্থ ২৬ ফুট।

মসজিদের দুইপাশে দুটি আর মাঝখানে ছিল চারটি খিলান। চারকোণে চারটি প্রান্ত বুরুজের ওপর ছোট ছোট মিনার ছিল। মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে ছিল সুউচ্চ মিনার। বর্তমানে এর উচ্চতা আরো বাড়ানো হয়েছে। এই মিনারের নিচে ছিল মসজিদের প্রধান প্রবেশ দ্বার। দক্ষিণ দিক দিয়েও মসজিদে প্রবেশ করা যেত। সেই যুগে চক মসজিদ ঢাকার কেন্দ্রীয় মসজিদ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। মাইকের প্রচলন না থাকায় আজান দেওয়া হতো উঁচু মিনার থেকে। কাছাকাছি অন্যান্য মসজিদের মুয়াজ্জিনরা চক মসজিদের আজান শুনেই আজান  দিতেন। রমজান বা ঈদের চাঁদ দেখা দিলে এই মসজিদের সামনে থেকে তোপধ্বনি দেওয়া হতো। রমজান মাসে তারাবির নামাজের সময় মসজিদের ভেতরটায় ঝাড়বাতির আলোয় আলোকিত করা হতো। ইফতারির সময় বিভিন্ন বাড়ি ও দোকানপাট থেকে ইফতারি আসত মসজিদে। আরেকটি সামাজিক রীতি ছিল চক মসজিদকে ঘিরে। জুম্মার নামাজের দিন চারপাশের বাড়ি থেকে মিষ্টান্ন পাঠানো হতো। নামাজ শেষে বিতরণ করা হতো এই মিষ্টান্ন।

এক সময় চক মসজিদের সামনে একটি খোলা আঙিনা ছিল। এখন আঙিনাকে ঘিরে মসজিদের আয়তন বাড়ানো হয়েছে। মসজিদের আয়তন এখন আগের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। কেন্দ্রীয় প্রবেশ পথের সামনে একটি অর্ধগম্বুজ ভল্ট রয়েছে। ভল্টে চমৎকার নকশা শোভিত। মসজিদের অভ্যন্তরে প্রবেশ করার জন্য পূর্ব দিকে তিনটি প্রবেশ পথ রয়েছে। এই প্রবেশপথগুলোর সমান্তরালে পশ্চিম দেয়ালে রয়েছে তিনটি মিহরাব। অবশ্য মিহরাবগুলোর আদিরূপ অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এগুলো নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় মিহরাবটি আদি বৈশিষ্ট্য রেখেই অর্ধ অষ্টকোণাকৃতি করা হয়েছে। বাকি দুটো আয়তকার। মিহরাবগুলো আধুনিক টাইলস দিয়ে মোড়ানো।