বইয়ের নাম ‘গল্পতুচ্ছ’
শহরে অনেক গল্প থাকে। চেনা গলির অজানা কত গল্প চাকচিক্যের এ শহরে ঘুরে বেড়ায়। তাদের সঙ্গে যেন আশীফ এন্তাজ রবির পুরোনো সম্পর্ক। রবিও যেন শহরের গলিতে তাঁর চেনা-অচেনা মানুষের ভেতরের গল্প হাতড়ে বেড়ান। যে শহরের মানুষ অপরাধী কিংবা নিরপরাধী। যে শহরের অসংখ্য গোপন কথা রয়েছে, যে শহরে ক্রমাগত একে অন্যের সঙ্গে বাজিখেলায় মেতে ওঠে একসময় ভরঘুরে হয়ে বেড়ায়, সেই শহরের মানুষের গল্পই যেন বলতে চেয়েছেন আশীফ এন্তাজ রবি তাঁর ‘গল্পতুচ্ছ’ বইয়ে।
যে শহরের মানুষ তুচ্ছ, সে শহরের মানুষের গল্প তো তুচ্ছই হবে। যাইহোক, গল্পতুচ্ছ বইয়ে রয়েছে ১০টি ছোটগল্প। এসবের মধ্যে তুচ্ছ কয়েকটি গল্প নিয়েই আলোচনা করা যেতে পারে।
কয়েকজন নিরপরাধী
গল্পের সময় রাত ১১টা। তখন জামাল সাহেবের টয়লেট হচ্ছিল না। তাই তিনি কড়া দুই কাপ চা এবং একটি সিগারেট ধরিয়ে পাঁচতলা ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসে টয়লেট আসার অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ করে তিনি দেখলেন তাঁদের পাঁচতলা বাড়ির মেইন গেটের সামনে একগাদা পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এই দেখে জামাল সাহেবের টয়লেট পেয়ে গেল। তিনি দৌড় দিলেন টয়লেটে। ভয়ে তাঁর পেট একদম ক্লিয়ার! পুলিশ তখন চিৎকার শুরু করল। তারা বাড়িওয়ালাকে খোঁজা শুরু করে দিল। বলল গেটটা খুলে দিতে।
বাড়িওয়ালার নাম রশিদ উদ্দিন। তিনি ভাবলেন, পুলিশের ড্রেস পরে নিশ্চয় ডাকাতি করতে এসেছে। তিনি ভয়ে ভয়ে বারান্দা থেকে পুলিশের কাছে ওয়ারেন্ট দেখতে চাইলেন। পুলিশ দিল গালি। তাতেই তিনি ভয় পেলেন। গেলেন পাশের ফ্ল্যাটে। সেখানে কী হয়েছে বলব না। তবে বলে রাখি পাশের ফ্ল্যাটের ভদ্রলোক বোরহান উদ্দিন আহমেদ একজন উকিল।
রশিদ সাহেব এরপর গেলেন দোতলায় ইমাম হোসেন সাহেবের ঘরে। সেখানে তাঁর বউকে জিজ্ঞেস করছেন, ইমাম ভাই নাই? এরপর স্ত্রীর জানান তাঁর স্বামী ঘরে নেই। কিন্তু আসলে তিনি লুকিয়ে ছিলেন খাটের তলায়। অন্য আরেক ফ্ল্যাটে চলছিল পরকীয়া প্রেম। চারতলার গৃহকর্তা আবদুল হালিম বাসায় নেই। তাঁর স্ত্রী আবিদা একা। আবিদা পুলিশ এসেছে শুনে কান্নাকাটি করতে করতে মান-ইজ্জতের কথা চিন্তা করা শুরু করে দিল। সবাই বিচলিত পুলিশ এসেছে শুনে। পুলিশ কাকে অ্যারেস্ট করবে? সবাই যে সবাইকেই অপরাধী ভাবছে। এই অপরাধীরা তারপর তো মেইন গেটটা খুললই। বাকিটুকু না হয় গল্প পড়েই জেনে নিলেন।
এ গল্পে আসলে ফুটে ওঠে আমাদের মনের ভেতরের আতঙ্কের কথা। প্রতিটি মানুষ তাঁর সারা দিনের কাজের ভেতর কোনো না কোনো অপরাধ করে বেড়ান। সেই সব অপরাধের ছবিই তাঁদের ভেতর ভেসে ওঠে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর প্রতি মানুষের অহেতুক আতঙ্কও উঠে এসেছে গল্পে।
মতিন স্যারের থার্ড পিরিয়ড
সমাজে শিক্ষক দ্বারা ছাত্রীর ওপর যৌন নিপীড়নের কথা আমাদের সবারই জানা। প্রায়ই আমরা শুনতে পাই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলছে অনেক অসুস্থ শিক্ষকের বিভিন্ন কুকীর্তি। তেমন বিষয়টিকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন ‘মতিন স্যারের থার্ড পিরিয়ড’ গল্পে।
গল্পে মতিন স্যার একজন শিক্ষক। তিনি আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের ধর্ম শিক্ষক। তাঁকে দেখেই ক্লাসের মেয়েরা ওড়না ঠিক করে। কেন ঠিক করে? এটা তো সবারই জানা। ধর্ম বিষয় পড়ানোর মধ্যে যৌন হয়রানির এ দৃশ্য আমি নিশ্চিত, বহু স্কুল-কলেজে অহরহ ঘটছে, যেখানে ক্রমাগত কোমল বয়সের মেয়েরা এসবের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন কিংবা কেউ সহ্য করে নিচ্ছেন। আর তাঁদের সঙ্গে লড়াইয়ে অংশ নিলেন রবি।
গোপন কথা
গল্পের নায়ক শাহেদ। নায়িকা তার স্ত্রী তনিমা। মাত্র তিন মাস তাদের বিয়ে হয়েছে। তাদের মধ্যে অনেক প্রেম হয়। ভালোবাসা হয়। দুই রোমান্টিক জুটির মধ্যে প্রেম দেখে মনে হয় এ যেন অনেক চেনা সম্পর্ক আমাদের। তনিমা কথা বলার সময় অনেক রহস্য করতে পছন্দ করে। রহস্য ছাড়া তনিমা কথা বলতে চায় না। আবার শাহেদও তনিমার সব কথা শুনতে চায়। কিন্তু তনিমা অনেক সময় বলে না। বলতেও চায় না। তার নাকি লজ্জা লজ্জা লাগে। তো এই সুখী দম্পতির জীবনে একটা ঘটনা ঘটে। যার মধ্যে তনিমা চায় শাহেদকে বলতে। কিন্তু শাহেদ আর সেটা শুনতে চায় না। শাহেদ যে চায় না সেটাও গোপন থাকে। তনিমা যে বলতে চায় সেটাও গোপন থাকে। এই গল্পের শেষ লাইন খুব ভালো লেগেছে। ‘এভাবে একটা গোপন কথা নিয়ে তারা, দুজন জেগে থাকে। সারা রাত। গোপনে।’
বাজি
এই গল্প শুরু হয় এটা চিঠি নিয়ে। সেটা চলে যায় জমির দলিলের দিকে। গল্পের প্রধান চরিত্র রোমেন। জমির ঝামেলা মেটাতে সে গ্রামের বাড়ি যায়। সেখানে পায় এক চিঠি। যে চিঠির বক্তব্য দুটি ধারণা পেশ করে। একটি হলো মুক্তিযুদ্ধ, আরেকটি হলো ২০০২ সালের যৌথ বাহিনীর অভিযান। এ নিয়ে শুরু হয় তর্কবিতর্ক। নানাভাবে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু হয় চিঠি নিয়ে। শেষ পর্যন্ত বাজি হয় এই চিঠি ২০০২ সালের নাকি ১৯৭১ সালের। সেই বাজিতে কে জেতে জানা নেই।
ভবরোগ
গল্পের নায়িকা ইভা ও তার স্বামী জহির। এই গল্পে ইভা থাকে প্রতিবন্ধীদের স্কুলের শিক্ষক। আর জহির অনেকটা আমাদের মতোই। নায়িকা দেখতে পছন্দ করে, চিৎকার করে কথা বলতে পছন্দ করে, টয়লেটে সময় বেশি কাটাতে পছন্দ করে। কিন্তু ইভা একটু অন্যরকম। আমরা যাকে বলি খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী। সে ক্যাচাল পছন্দ করে না। বাংলা সিনেমা পছন্দ করে না। হৈহুল্লুড় পছন্দ করে না। তবুও তাদের সংসার অনেকদিন হয়ে গেছে। ইভার সঙ্গে জহির খুব সাবধানে থাকে। গল্পকথকের মতে জহির তার স্ত্রীর প্রেমে পড়েছে বিয়ের দুই বছর পর। মানে একদিন জহির তার স্কুলে যায়। গিয়ে দেখে প্রতিবন্ধী বাচ্চারা ইভাকে খুব জ্বালাচ্ছে, কিন্তু তবু ইভা কিছু বলছে না। সহ্য করছে। এমন অনেক ঘটনা দেখে ইভাকে সে ঘরে গিয়ে সব বলে। তুলনা করে। তারপর আবারও ক্লাইমেক্স। ওই ক্লাইমেক্স জানতে হলে গল্পটা পড়েন। ‘ভবরোগ’ গল্পটা মোটেও তুচ্ছ না। অনেক অসাধারণ গল্প। মনে হয়েছে প্রতিটি মানুষের জীবনে এমন ভবরোগ এলে খারাপ হয় না।
শুরুতেই বলেছি এই বইয়ে রয়েছে ১০টি গল্প। অসাধারণ বুননে রচিত প্রতিটি গল্প। তবে গল্পকার খুব সংক্ষেপে গল্প বর্ণনা করেন। মনে হয় যেন গল্প শুরু হতেই শেষ হয়ে গেল। আরো একটি বিষয় লক্ষণীয়- গল্পের বর্ণনাকে অনেক সময় মনে হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের ছায়া। তবে গল্পের চরিত্রগুলো সুন্দর। ছোট ছোট সংলাপে গল্প রওনা দেয় তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। যাত্রাপথে চরিত্রগুলো কীর্তিকলাপ পাঠক খুব উপভোগ করবে বলেই মনে হয়।
লেখক : আশীফ এন্তাজ রবি
বই : গল্পতুচ্ছ
প্রচ্ছদ : সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক : আদর্শ
মূল্য : ১৫০ টাকা