গল্প
পরজীবীর সঙ্গে বসবাস
গভীর স্বপ্নোচ্ছ্বাস নিয়ে জেগে উঠলাম। কাল রাতে শিথানের পাশে একে একে দাঁড়ালেন পূর্বপুরুষরা। তাঁদের হাস্যোজ্জ্বল মুখাবয়ব স্পষ্ট। এই সন্ধ্যা, এই সারস সময় অবিমিশ্র ক্ষমা ও ঘৃণায় বাক্সময়। এখানে একদিন হরিণ জননীরা খুলেছিল দ্বিধার বসন। আর কোনো অঙ্গীকার নেই। হেঁটে যাই শ্যাওলা রঙিন পথ ধরে। পদপ্রান্তে পুষ্প ও পাথর পড়ে থাকে...
পুষ্প ও পাথর খুঁজে খুঁজে হয়রান ইশাররাত শবনম। কোথায় পুষ্প আর কোথায় পাথরের সন্ধান পাওয়া যাবে তারই তালাশ করতে থাকে। দীর্ঘ দীর্ঘ জীবন কেটে যায়। পার হয় একেকটি কুয়াশা ঋতু। দীর্ঘ পথপরিক্রমায়ও সে দেখতে পায় দূর মাঠে সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে। একথা মনে হলেই তার ভালো লাগতে থাকে। ভালো লাগতে থাকে সন্ধ্যার আলো-আঁধারি। সে বলেছিল, সন্ধ্যা মানেই সুন্দর, সন্ধ্যা মানেই আলো-আঁধারির মলিন। সন্ধ্যা মানেই সন্ধি। সন্ধ্যা দুটো জানো তো, সায়ন সন্ধ্যা আর প্রাতঃসন্ধ্যা। ইশাররাত মুগ্ধ হয়ে শোনে। সন্ধ্যা দুরকম। দুটোই সুন্দর। কিন্তু সেই সুন্দরকে দেখার চোখ তার কোথায় নিজেকে ফিরে দ্যাখো ইশাররাত। বুদ্ধ বলেছেন, বারবার নিজের দিকে তাকাতে হয়। এই যে সময় সময় নিজের দিকে তাকানো তা আসলে নিজেকেই পরখ করা। নিজেকেই উদ্ধার করা। মানুষ তো নিজেই নিজের প্রভু। মানুষ নিজেই নিজের আশ্রয়।’ সে লেখার টেবিল, বারান্দা, ঘর কোথাও শান্তি খুঁজে পায় না। আলো-আঁধারি ধরে হাঁটতে থাকে। জীবনের আলো-আঁধারি - কী আলো, কী অন্ধকার ! অনন্ত কাল ধরে তো এর মধ্যেই সে হাঁটছে। তবু তার মনে হয় সে কখনো সন্ধ্যা দেখেনি। তাহলে জীবনে কি কোনো সন্ধি নেই তার!
কী লেখেন ইশাররাত শবনম?
চমকে ওঠে সে। যেন একটানে কেউ তাকে সদর রাস্তায় দাঁড় করিয়ে দিল। যেন মুহূর্তে সমস্ত অনুভূতি বিবর্ণ, বিস্বাদ হয়ে গেল। যেন একটা কটু স্বাদ পাকস্থলী থেকে বেয়ে বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। উঠতে উঠতে তা তার গলার মধ্যে আটকে রইল।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন সালাম দুররানি। দ্রুত লেখার কাগজটি সরিয়ে ফেলে সে।
আরে সালাম ভা, আপনি? কখন এলেন? আমারে খবর দিতেন। আমি নিজে গিয়া আপনার সঙ্গে দেখা কইরা আসতাম।
সালাম দুররানি হাসেন।
আরে আইছি কি সাধে? আমি হইলাম সালাম দুররানি, ‘হরির লুটের বাতাসা’র সম্পাদক। আমারে হুমকি দেয় টেলিফোনে?
এই জন্য আপানাকে ছুটতে হবে? দেন নাম্বার দেন- দেখি কী করতে পারি।
এই জন্যই তো আপনের কাছে আইছি। আমি জানি আপনেই পারবেন এর ফয়সালা করতে। আপনারে দেখলেই তো আমার শান্তি লাগে। পৃথিবীর কোনো বেডা মানুষ যা পারে না আপনি মুহূর্তের মধ্যে তা কইরা দেখান।
সালাম দুররানি টিভির রিমোট হাতে নেন, টিভির ভলিউম বাড়িয়ে এক পা, দুপা করে তার দিকে আসতে থাকেন।
আপনে আরাম কইরা বসেন সালাম ভাই, আমি কফি বানাইয়া আনি।
এই যে, এইডাও আপনি আমার মনের মতো কথা কইছেন। হ, কফিই লইয়া আসেন। এক লগে বইসা কফি খাই।
দুররানিকে পাশের ঘরে বসিয়ে সে কফি বানাতে যায়। কেটলিতে জল ফুটছে। সে ক্রিস্টালের মগে কফি ব্লেন্ড করতে থাকে চামচ দিয়ে। জল ফুটছে, কফি ব্লেন্ড হচ্ছে। সবকিছু ঠিক আছে, তার অফিস কক্ষে ‘হরির লুটের বাতাসা’র সম্পাদক বসে আছেন। কিন্তু কী যেন ঠিক হতে হতেও ঠিক মনে হয় না তার কাছে। আচ্ছা, এই কফি বানানো নিয়েই তো সে একবার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল বোধহয়। আর ওই ‘হরির লুটের বাতাসা’র চাকরি তো ছেড়েছে দশ বছর আগে। প্রতিদিন তার অ্যাসাইনমেন্ট নতুন নতুন মানুষের সাক্ষাৎকার নেওয়া।
আপনি একটা কাজ করেন, যাগোর ইন্টারভিউ নিবেন তার একটা তালিকা বানাইয়া ফালান।
ইশাররাত তালিকা বানায়। দার্শনিক, কবি, সাহিত্যিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী। ফুটনোট দিয়ে লেখে : বৃক্ষের দাগ লাগা মানুষদের সাক্ষাৎকার নিতে চায় সে। সালাম দুররানী তার তালিকা দেখে খুশি হন। জানতে চান, বৃক্ষের দাগ লাগা মানুষ বলতে ইশাররাত কী বুঝিয়েছে?
ইশাররাত আনন্দের সঙ্গে ব্যাখ্যা করতে থাকে। এই যেমন ধরেন, শতবর্ষী মানুষ। বিচিত্র পেশার মানুষ। তাদের জীবনবোধ। তাদের দর্শন নিয়ে ইন্টারভিউ করতে চাই।
ঠিক আছে করবেন। এই তালিকা থাকুক আমার কাছে। আমি একটা তালিকা করছি। এইডা লন। আগে এই মানুষগুলার ইন্টারভিউ নেন। পরে আপনার তালিকা ধরবেন। মানুষ বুইঝা ইন্টারভিউ করবেন- এইডা তো আপনারে কইয়া দিতে হইবো না। তবে একটা কমন প্রশ্ন বেবাকতেরে করবেন, আপনার কি কিছু বলার আছে?
ইশাররাত তালিকা দেখে হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝতে পারে না। তালিকায় সব রাজনীতিবিদদের নাম। এমন সব রাজনীতিবিদ তারা যে ওইসব মূর্খ-ভাঁড়দের নাম পর্যন্ত সে মনে রাখতে চায় না। এই নামগুলো কখনো তার মস্তিষ্কের হার্ডডিস্কে ঢুকবে এও সে চায়নি।
নিজেকে টেনে টেনে নিয়ে যায় ওই লোকদের সাক্ষাৎকার নিতে। তার কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে থাকে। মস্তিষ্ক হাতড়ে হাতড়ে শব্দ বের করে। একশটি সাক্ষাৎকার নেওয়ার পর একদিন অফিসে গিয়ে দেখে তালা ঝুলছে। কোথাও কাউকে পাওয়া যায় না। একে ওকে জিজ্ঞেস করে সে জানতে পারে সালাম দুররানি মালয়েশিয়া না মালদ্বীপ কোথায় যেন চলে গেছে। কিন্তু আজ কোত্থেকে এলো? সে ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে থাকে। তারপর মগে জল ঢালে, দুধ ঢালে। কফি প্রস্তুত। নিজের জন্যও এক কাপ বানায়। মগ দুটো নিয়ে তার কক্ষে আসে।
সালাম দুররানির মুখোমুখি হওয়ার জন্য মানসিক শক্তি সঞ্চয় করে। ইশাররাত তো জানে না, সেখানে তার জন্য অপেক্ষা করছে আরেক বিস্ময়।
আপু আপনি কত্তো ভালো- কখন থেকে মনে মনে চাইছি এক কাপ চা বা কফি দরকার।
তুমি কখন এলে?
কখন এলাম মানে? আমি তো সকাল থেকেই অফিসে। আপনি যখন ঢুকলেন তখন গুড মর্নিং বললাম। আপনি বললেন, রুমা ভালো আছো?
তাই?
কী হয়েছে আপা মন খারাপ? আজ আপনের মন খারাপ, আমারও অনেক মন খারাপ। সেই কথা বলতেই তো এলাম।
হায় ঈশ্বর! রুমা কেন এসেছে? তার সঙ্গে কী হচ্ছে এসব? কেন এসেছে?
কী হয়েছে রুমা? তোমার বাচ্চা কেমন আছে?
বাচ্চা! আমার আবার বাচ্চা হলো কবে? তবে একটা বাচ্চা নেয়ার জন্য অনেক কিছু করছি। কিন্তু কী করবো আমার স্বামীর স্পার্ম দুর্বল। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অথচ আমার কোনো অসুবিধে নেই। কী করবো আপু, একটা বাচ্চা না হলে আমি কী নিয়ে বাঁচবো?
ইশাররাত ভেবে পায় না, মেয়েটি বাচ্চার জন্য এতো মরিয়া হয়ে উঠেছে কেন? একটা মানবশিশুকে পৃথিবীতে এনে এত অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলার কী মানে হয়, তা সে বোঝে না। নিজেদের জীবনেরই নিরাপত্তা নেই, কে কখন কোথায় লাশ হয়ে যাবে, গুম হয়ে যাবে। তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আর এই মেয়ে বাচ্চার জন্য লাফাচ্ছে।
আমি যাই আপু, কাজল এসেছে। বাসায় যাব।
কাজল? মানে তোমার স্বামীর বন্ধু!
হ্যাঁ।
ওই যে ছেলেটি তোমাদের বাসায় থাকে?
হ্যাঁ।
আসলে ও আমার বন্ধু। ও না থাকলে তো এই শহরে আমার থাকার জায়গাই থাকত না। আজ যাই আপু, কাল দেখা হবে।
সমস্ত আলো নিয়ে রুমা ঝলমল করতে করতে চলে যায়। ইশাররাত ধন্ধে পড়ে যায়।
‘খাঁটি সোনায় যেমন গয়না হয় না, তেমনি নিরেট সত্যের ওপর ভিত্তি করে জীবন চলে না, জীবনকে এগিয়ে নিতে হলে চাই সত্যের সঙ্গে মিথ্যের মিশেল; একটু প্রলেপ। আর নিজের সম্পর্কে কখনো পুরোপুরি ইনফরমেশন কাউকে দিতে হয় না।’ এ দর্শন রুমার। ইনফো প্রাইভেটের ফ্রন্ট ডেস্ক এক্সিকিউটিভ। ফর্সা, সুন্দর মুখে সব সময় ঝকঝকে একটা হাসি ঝুলিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে ব্রাউন আই পেনসিল দিয়ে ভ্রু দুটোকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে।
ভাদ্রের ভাপসা গরমে বাইরে চলমান বিড়ম্বিত মানুষকে রেখে অফিসে ঢোকে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ ইশাররাত শবনম। রুমা ওকে ঘাম মোছার জন্য টিস্যু এগিয়ে দেয়। বসতে বলে। এসির ঠান্ডা আরেকটু বাড়িয়ে দেয়। তার ভালো লাগে। রুমাকে তার সহোদরার মতো মনে হয়। যদিও তার কোনো সহোদরা নেই, সহোদরা থাকলে তার সঙ্গে সম্পর্ক কেমন হয় সে জানে না, তবে প্রীতির সম্পর্ক হয় নিশ্চয়ই।
প্রতিষ্ঠানটিকেও তার ভালো লেগে যায়। অবশ্যই তা ইনটেরিয়র ডেকোরেশনের জন্য। অফিসসজ্জাকে এরা প্রায় শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। এটা অবশ্য এ জন্য যে, অফিসকে যাবতীয় স্বাচ্ছন্দ্য দিয়ে পূর্ণ করো, যারা এখানে কাজ করতে আসবে তাদের যেন বাড়ি যেতে ইচ্ছে না হয়।
ইশাররাতের মনে হয় সে এখানে চাকরি করতে নয়, এসেছে রুমার সঙ্গে দেখা করতে। কিংবা রুমার সঙ্গে দেখা হবে বলেই এখানে আসা। কোনো পরিচয়কেই তার অযৌক্তিক মনে হয় না, নতুন কারো সঙ্গে পরিচয় হলেই মনে হয় তার সঙ্গে দেখা হবে বলেই সে এ পর্যন্ত এসেছে। সেদিন তো কথায় কথায় একজনকে বলেই ফেলল, তোমার সঙ্গে দেখা হবে বলেই তো বেঁচে আছি। বিষয়টি কী পাগলামির পর্যায়ে পড়েছে কি না, এটাই সত্য।
‘তোমার মাঝে অনেক কথা আছে রুমা।’ বলার সঙ্গে সঙ্গে সে লাফিয়ে ওঠে। ‘তুমি কী করে বুঝলে আপু। আসলেই ফ্রন্ট ডেস্কের মেয়ের মধ্যে অনেক গল্প থাকে।’
‘শুধু ফ্রন্ট ডেস্ক নয়, প্রত্যেক মানুষের মধ্যে কিছু না কিছু গল্প থাকে।’
‘ফ্রন্ট ডেস্কে বেশি থাকে।’
‘কারণটা কি?’
‘কারণ অসংখ্য। যে মেয়ে ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করে তার জীবনটা অভিশপ্ত। হয় সে, না হয় তার পূর্বপুরুষ অনেক পাপ করেছে। সেই পাপে মেয়েটিকে ফ্রন্ট ডেস্কে কাজ করতে হয়।’
পাপ! হবে হয়তো!
ইশাররাত বিস্মৃতির ঘ্রাণ পায়!
‘মেঝেতে ময়লা, কাপ-পিরিচে ময়লা এগুলো খেয়াল করো না কেন?’ বসের রাগ। ইশাররাতের জানা ছিল না রিশিপশনিস্টকে এগুলো খেয়াল করতে হয়।
‘আপনাকে কেন রাখা হয়েছে? আমার টয়লেটের তোয়ালেটা ময়লা, এটা দেখবেন না।’
‘স্যার আপনার টয়লেটে তো আমি ঢুকি না। তা ছাড়া টয়লেটের তোয়ালে অপরিষ্কার কি না, তা দেখবে আপনার ব্যক্তিগত সহকারী কিংবা জমাদার।’
‘ঠিক আছে আমার কফিটা তো বানিয়ে দেবে!’
‘চা-কফি বানানোর জন্য তো আমি অফিসে আসি নাই, অফিসে এসেছি অফিশিয়াল কাজ করতে।’
বস অবাক। তার মুখের ওপর কোনো কর্মচারী এভাবে কথা বলতে পারে!
ইশাররাত এক মুহূর্তও দেরি করে না। বসের সামনে পদত্যাগপত্র রেখে চলে আসে। যাই হোক, সে সালাম দুররানির জন্য কেনই বা কফি বানাল আর তার বানানো কফি কেনই বা পান করল রুমা ভেবে পায় না সে। রুমার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল গত বছর; নিউমার্কেটে। দেখা হওয়ার পর জেনেছিল সে মা হতে যাচ্ছে। আর কাজলের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। বাচ্চাটা কাজলের কি না জানতে ইচ্ছে করছিল খুব। কিন্তু জিজ্ঞেস করেনি। কারণ সন্তান মায়ের, এটাই সে বিশ্বাস করে। বাবা তো কেবল হয়ে ওঠা, যেমন নারী ও পুরুষ উভয়কে মানুষ হয়ে উঠতে হয়।
ইশাররাত শবনম হঠাৎই আবিষ্কার করে তার ঘরের মধ্যে একটি বোলতা উড়ছে। বোলতাটিকে সে তাড়াতে চায়, যেমন করে একাকিত্ব তাড়াতে চায় জনাকীর্ণ নগরীর বাসিন্দারা। অবশেষে ইশাররাত শবনম বুঝতে পারে সে আসলে বিছানায় শুয়ে আছে।
‘আমার কী হয়েছে?’ কাকে প্রশ্ন করে ঠিক বোঝা যায় না। তবে একটা উত্তর আসে ঠিকই। যেন তার মাথার ভেতর থেকে কেউ কথা বলছে।
‘তুমি ২০ দিন ধরে অসুস্থ।’ অথচ বিশ দিন কেউ আমাকে কেউ দেখতে আসে নাই?
হ্যাঁ, কেউ তোমাকে দেখতে আসে নাই। তুমি একা একা ডাক্তারের কাছে গেছ, ওষুধ এনেছ, খাবার খেয়েছ। একবার ভেবেছিলে গ্রামের বাড়িতে চলে যাবে। কাপড়চোপড়ও গুছিয়ে ছিলে কিন্তু যেতে পারো নাই।
কেন বাড়ি চলে যেতে চেয়েছিল সে? মনে পড়েছে, কয়েকদিনের জ্বরে তার মনে হলো সে মরে যাচ্ছে। একা একা মরে গেলে কেউ জানবে না, ঘর থেকে দুর্গন্ধ বের হবে। তার চেয়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যাওয়া ভালো, সেখানে অন্তত মানুষের মধ্যে মরতে পারবে।
আচ্ছা কেউ তোমাকে দেখতে এলো না কেন পিপুলের পাতা?
পিপুলের পাতা!
‘তুই হবি পিপুলের পাতা।’ নানিজান বলত তাকে। সেই ছোটবেলায় নানিজান তাকে প্রায়ই লেবুবাগানের ভেতর নিয়ে যেত, গাছগুলোর যত্ন করার জন্য। বিশাল বাগানের ভেতর সারি সারি গাছগুলো বাঁশের খুঁটি দিয়ে সোজা করে রাখা। ঈষৎ পেকে যাওয়া লেবুগুলো থেকে হলুদাভ আভা ছড়াচ্ছে। নানিজান একটা আগাছাজাতীয় গাছ থেকে কয়েকটি পাতা তুলে তার হাতে দেন, এর নাম হইল পিপুলের পাতা।
পিপুলের পাতা দিয়া কী হয় নানিজান?
মাছ রান্ধে, তরকারি রান্ধে। ধর, কোনো মাছ একটু নরম হইয়া গ্যালো, তাইলে কি তা ফালাইয়া দিমু? না, অপচয় করণ যাইব না, তখন ওই মাছটা পিপুলের পাতা দিয়া রানলে খাইতেও সোয়াদ লাগে আর অপচয়ও হইল না। পিপুলের পাতার আরেক নাম হইল বিশুদ্ধিকরণ পাতা, বুজছস! জীবনে চেষ্টা করবি পিপুলের পাতা হইতে। বড় হইলে কত রকম মানুষের লগে তর দেখা হইব। তুই যদি পিপুলের পাতা হস তাইলে নিজেরে নিয়া তর চিন্তা করতে হইব না।’
ইশাররাত মাথা কাত করে নানিজানের কথায় সায় দেয়। সে পিপুলের পাতা হইতে চায়, সে পিপুলের পাতা হইতে চায়- এই রকম জপ করতে করতে সে বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয় পার হয়। তার প্রিয় মানুষদের কাছে সে বিশুদ্ধকরণ হয়ে থাকতে চায়।
কিন্তু এতদিন হয়ে গেল কেউ তাকে দেখতে আসেনি কেন? তার কি কোথাও কেউ নেই। তার আত্মীয়স্বজন কোথায়, এই নগরে তার কি কেউ নেই? সেই ভয় তার উদভ্রান্ত চেতনায় আছড়ে পড়তে থাকে।
আজ তো তার আসার কথা ছিল। কিন্তু এলো না। আজ, কাল করে কত দিন পার হয়ে গেল!
‘কেন প্রত্যাশা করি আসলে কেউ আমার পাশে থাকবে?’
‘কেন থাকবে না; পৃথিবীতে হতভাগ্য মানুষ সেই যে তার প্রিয়জনের পাশে থাকে না। তুমি অবশ্যই প্রত্যাশা করতে পারো।’
‘ না পারি না, আমি পিপুলের পাতা। তা ছাড়া ও হয়তো অনেক ব্যস্ত। বৃহত্তর জীবনের জন্য তার ব্যাপ্তি। আমাকে তো তা মেনে নিতে হবে ।’
‘তুমি হলে কী করতে?
‘ছুটে যেতাম। একনজর হলেও দেখে আসতাম।’
‘এইটাই, তুমি কি তার কাছে সামাজিক মর্যাদা চেয়েছ, অর্থবিত্ত চেয়েছ, চাওনি। চেয়েছ সহমর্মিতা, চেয়েছ পাশে থাকার অঙ্গীকার। পাশে থাকা মানে তো গায়ের সঙ্গে গা লেপ্টে বসে থাকা নয়। পাশে থাকা মানে, সুখে না হোক দুঃখে-বিপদে পাশে দাঁড়ানো।’
‘তুমি কে? এত কথা বলছ কেন?’
‘আমি হলাম পরজীবী। তোমার শরীরের ভেতর পাকাপাকি অবস্থান করে নিয়েছি।’
ক্লান্ত ইশাররাত ঘুমিয়ে যাওয়ার আগে বসে বসে নতুন ছক তৈরি করে। বেঁচে থাকার জন্য যেন ‘ভ্যানগগের লাস্ট লিফ’। নতুন করে জীবনের লক্ষ্য উদ্দেশ্য সাজাতে থাকে সে। হাঁটা-চলা-খাবার-ঘুম-পড়াশোনা-লেখালেখি। -ঘড়ি ধরে খুব ভোরে উঠতে হবে। ঘুম ভাঙলে আর শুয়ে থাকা যাবে না।
কী লিখছ, কোনো লাভ নেই, যা পারবে না তা নিয়ে স্বপ্ন দেখে লাভ কি?
তুমি কেন আমার পেছনে লেগেছ, ব্লাডি প্যারাসাইট! এতোদিন ধরে আমার রক্ত পান করে নিজেকে জিইয়ে রেখেছ!
যতোই গালি দাও আমাকে, অতো সহজে তাড়াতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। এখনো ভাবছ সে আসবে? তোমার মতো বোকা আমি দ্বিতীয়টি দেখিনি। ভালো, অপেক্ষা করো। অপেক্ষা করে করে কী লাভ হয়েছে দেখেছ? আমি একটি পরজীবী পাকাপাকি ভাবে চলে এসেছি।
ইশাররাত হতাশ হয়ে পড়ে। মনে হচ্ছে দেয়াল বেয়ে বেয়ে যত কীটপতঙ্গ সব তার ঘরে উঠে আসছে। সে কি তবে মরে যাচ্ছে। কোথাও কোনো ভালোবাসা নেই, তার জন্য। কে যেন বলেছিল, প্রেমমায়া, ভালোবাসা এগুলো আভিধানিক শব্দ। আমি এগুলো বিশ্বাস করি না। শুনেছ, ইশাররাত শবনম বিশ্বাস করে না, এগুলো কেবল আভিধানিক শব্দ। প্রেম, ভালোবাসা, মায়া প্রত্যেকটি শব্দের অনেক অনেক ক্ষমতা। সে আসবেই, অবশ্যই আসবে। ‘আমি জানি যতক্ষণ পর্যন্ত সে এসে আমার হৃৎপিণ্ডে মুখ না রাখবে ততক্ষণ আমার মরণ হবে না।’
ঝিম ধরা নিস্তব্ধতা চারদিকে। সে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকে। যেন সমস্ত শরীর ভাঁজ হয়ে তার পেটের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে চাইছে। বাইরে পাহারাদারের বাঁশি আর ফ্যানের একঘেয়ে শব্দ শোনা যাচ্ছে।
মাঝে মাঝে রান্নাঘরের কল থেকে টপটপ করে জল পড়ছে। সেই সঙ্গে চিনচিনে একটা ব্যথা ছড়িয়ে পড়ছে তার সমস্ত শরীরে। অজ্ঞান হয়ে যাবে নাকি। তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো ধীরে ধীরে আলাদা হতে থাকে। তারা ঘরের মধ্যে সাঁতার কাটছে। তার দিকে তাকিয়ে মুখ ভ্যাঙচাচ্ছে।
‘না, আমি অত ভিড়ে যেতে পারব না, ভিড়ের মধ্যে গেলে আমার ভয় লাগে। ভিড়ের মধ্যে গেলে মনে হয় হারিয়ে যাব। বাবা, আপনি কোথায়? আমার হাতটা ছেড়ে দিয়েন না।’
তার ঘুম পেতে থাকে। কিন্তু জানালার পাশে কী একটা মুখ থুবড়ে পড়ল! সবাই দৌড়াচ্ছে কেন? সাদা বিশাল ডানার অ্যালবাট্রস। অ্যালবাট্রসে আগুন ধরে গেছে। রেডিয়েশন ছড়াচ্ছে। বোমারু বিমান এটি! ধুপধুপ পায়ের আওয়াজ। নারী-শিশুর কান্নার আওয়াজ চারিদিকে। তার চোখের সামনে দাউ দাউ অগ্নিশিখা। পোড়া মাংসের গন্ধ বেরুচ্ছে- সে আরো ভালো করে দৃশ্যগুলো দেখতে চায় !
ওহ গড! একটি নারীর পোড়া কটিদেশ দেখা যাছে। ওই পাশে কী? পোড়া মুরগির রোস্ট! বিয়ের কনে ছিল মেয়েটি। স্বপ্ন সমেত পুড়ে গেছে।
ইশাররাত শবনম!
কে একজন তাকে ডাকে। কণ্ঠস্বরটি তাকে ডেকেই যাচ্ছে। সে কি সাড়া দেবে!