এমিল জোলার জন্মদিন
কেরানি থেকে লেখক হওয়ার গল্প
বিশ্বের ‘ঔপন্যাসিকদের ঔপন্যাসিক’ হিসেবে খ্যাত ছিলেন তিনি। নাম তাঁর এমিল এডওয়ার্ড চার্লস এন্টোনি জোলা, সংক্ষেপে যাঁকে আমরা এমিল জোলা বলে চিনি। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিশ্বখ্যাত ফরাসি লেখক। ফ্রান্সের রাজনৈতিক উদারনৈতিকতার জন্য সব সময় কাজ করে গেছেন তিনি। শুরুতে ফরাসি শুল্ক বিভাগের একজন করণিক ছিলেন জোলা। পরে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে বিভিন্ন পত্রিকায় ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকতা শুরু করেন। ওই সময়ে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ফ্রান্সের পরিবেশবাদী আন্দোলনে।
প্রকৃতিবাদী চিন্তাধারার অত্যন্ত জোরালো প্রবক্তা জোলা তাত্ত্বিক প্রকৃতিবাদ বিকাশে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ফ্রান্সের রাজনৈতিক উদারীকরণের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তিনি। মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত সামরিক কর্মকর্তা আলফ্রেড ড্রেফুসের মুক্তিতেও তাঁর ভূমিকা স্মরণীয়। এমনকি নেপোলিয়নের প্রতি ব্যক্তিগত বিরাগ তিনি লুকাতেন না। ১৯০১ ও ১৯০২ সালে দুবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন জোলা।
১৮৭১ থেকে ১৮৯৩ সালের মধ্যে তাঁর প্রসিদ্ধ উপন্যাসমালা ‘লে রুগঁ-মাকুয়াখত’ প্রকাশিত হয় ২০ খণ্ডে। এগুলোর মধ্যে কয়লাখনির শ্রমিকদের নিয়ে লিখিত ‘ঝে য়ারমিনাল’ তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি রূপে স্বীকৃত। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘নিনা’, ‘লা তেরা’, ‘লা মিরর’ প্রভৃতি। দি আর্থ (বাংলায় অনূদিত গ্রন্থ মাটি) বা দ্য জার্মিনাল (বাংলায় অনূদিত গ্রন্থ অঙ্কুর)-এর মতো উপন্যাসসহ আরো অনেক কালজয়ী উপন্যাসের রচয়িতা ছিলেন এমিল জোলা।
১৮৪০ সালের ২ এপ্রিল ফ্রান্সের প্যারিসে এমিল জোলার জন্ম। তাঁর বাবা ফ্রাঙ্কোয়িজ জোলা ছিলেন ইতালিয়ান প্রকৌশলী এবং মা ফ্রান্সের মেয়ে এমিলি অবার্ট। ১৮৪৭ সালে জোলার বয়স যখন মাত্র সাত, তখন তাঁর বাবা মারা যান। এরপর তিনি বড় হতে থাকেন মায়ের কাছেই। বাবার মৃত্যুর পর ১৮৫৮ সালে জোলার পরিবার চলে আসে ফ্রান্সে। একই বছর পড়াশোনার জন্য জোলা পাড়ি জমান প্যারিসে। সেখানে বন্ধু হিসেবে পান বিখ্যাত চিত্রকর পল সেজানকে। এ সময় তিনি লেখালেখি শুরু করেন রোমান্টিক ধাঁচে। জোলার মায়ের পরিকল্পনা ছিল ছেলেকে আইন পড়াবেন এবং আইনেই ছেলের ক্যারিয়ার গড়বেন। কিন্তু মায়ের সেই আশার গুড়ে বালি। লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় বাকা লরিয়েট পরীক্ষায় (সে দেশে মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষে অনুষ্ঠিত পরীক্ষা) অকৃতকার্য হন জোলা। পরবর্তী সময়ে আর তাঁর আইন পড়া হয়ে ওঠেনি।
লেখালেখির শুরুতে জোলা লেখেন ছোটগল্প ও গদ্য, চারটি নাটক ও তিনটি উপন্যাস। তাঁর প্রথম বই প্রকাশিত হয় ১৮৬৪ সালে। ১৮৬৫ সালে তাঁর জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি পুলিশের তোপের মুখে পড়েন। লেখক হিসেবে পরিচিত হওয়ার আগে তিনি বিপণনকেন্দ্র এবং জাহাজ কোম্পানির কেরানির কাজ করতেন। তখনো তিনি পত্রিকায় সাহিত্য ও শিল্প সমালোচনা লিখতেন সাংবাদিকদের মতো। শুরুতে তিনি ছিলেন ফরাসি শুল্ক বিভাগের একজন কেরানি।
১৮৬৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস ‘থেরেস রিকুইন’। এরপর এমিলি দ্বিতীয় ফরাসি সম্রাটের পরিবার নিয়ে দীর্ঘ ধারাবাহিক লিখতে শুরু করেন। জোলা ও সেজানের মধ্যে ছিল বেশ ভালো বন্ধুত্ব। কিছুটা ছন্নছাড়া ভবঘুরে জীবনযাপন করতেন জোলা আর সেজান। একটি উপন্যাসে জোলা তাঁদের ছন্নছাড়া শিল্পীজীবনের জীবনচিত্র আঁকার পর তাঁদের জীবনে কিছুটা পরিবর্তন আসে। অপরাধীদের সঙ্গে মেশার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে জেল খাটার অভিজ্ঞতাও ঘটেছে জোলার জীবনে।
জোলা বলতেন, ‘সত্য সব সময় চলমান এবং তাকে কখনোই থামিয়ে রাখা যায় না।’ সব সময় তিনি একটি নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন দেখতেন। ১৮৯৮ সালের ১৩ জুলাই ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টকে উদ্দেশ করে তিনি একটি খোলা চিঠি লেখেন এবং দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় তা প্রকাশিত হয়। একজন আর্টিলারি অফিসারের বেআইনি কারাদণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেন ওই চিঠিতে। এ ছাড়া বিচারব্যবস্থার কিছু ত্রুটি এবং মামলার গুরুত্বপূর্ণ দলিল মুছে ফেলার কথাও বলেন তিনি। ফলে রাজরোষে পড়েন এবং ১৮৯৮ সালে তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কারাদণ্ড এড়াতে তিনি ইংল্যান্ডে আত্মগোপন করেন এবং দেশে ফেরেন তাঁর পরের বছর।
১৯০২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ৬২ বছর বয়সে ঘরের চিমনি বন্ধ হয়ে বিষাক্ত কার্বন-মনোঅক্সাইডজনিত গ্যাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান কেরানি থেকে লেখক হয়ে ওঠা এমিল জোলা। মৃত্যুর জন্য তাঁর শত্রুদের দায়ী করা হলেও কোনো প্রমাণ ছিল না এতে। তবে বলা হয়ে থাকে, শত্রুরা তাঁকে হত্যার উদ্দেশ্যেই ঘরের চিমনি বন্ধ করে দিয়েছিল। জোলাকে সমাহিত করা হয় প্যারিসে। কিন্তু মৃত্যুর ছয় বছর পর অর্থাৎ ১৯০৮ সালের ৪ জুলাই তাঁর মরদেহ সরিয়ে নেওয়া হয় সর্বদেবতা মন্দিরে।