শোকগাথা
শাহীন! ও শাহীন!
এই শাহীন, তুই কোথায়?
তোর নম্বর থেকে ফোন করেছিল কে?
আমার ফোন তো সাইলেন্ট থাকে। কল রিসিভ করতে পারিনিরে, ভাই!
আজ এপ্রিলের এক তারিখ নাকি?
আশিক মুস্তাফা এপ্রিল ফুল করল?
না হলে এই টেক্সট কেন?
DADA, SHAHIN VAI NEI
কী এসব? ও শাহীন? তুই নেই কেন? তুই কোথায়?
তোকে কি আমি কখনো তুই বলতাম, ভাই? কত ছোট তুই। তাও ‘আপনি’। এখন তাহলে ‘তুই’ বলছি কেন?
তুই নেই বলে? কত বছর ধরে আমরা ভাই ভাই। খেলাঘর, ছোটদের পত্রিকা, ছোটদের মেলা, কত কত স্মৃতি। কত অর্থহীন। কত কষ্টের! তোর মতো সরল, সৎ, উদ্যমী ছেলে এই সময়ে আর কয়টা আছে বল? তুই এ রকম নেই হয়ে যাবি? কেন? সরল, সৎ, উদ্যমী আবার এতটাই ধীর, মনে হতো তুই সারাক্ষণ ঝিমোচ্ছিস। আমি তো সবার সঙ্গে মজা করি না। কিন্তু তোর সঙ্গে...। তোর একটা নাম দিয়েছিলাম। রানীক্ষেত শাহীন। আপনজনরা সবাই এরপর এই নামেই তোকে ডাকত। এ নিয়ে তোর কী অভিমান একদিন!
‘কী শাহীন? এই বছরের ছোটদের মেলা সাহিত্য পুরস্কার কবে দিচ্ছেন?’
‘আমিরুল ভাই তো টাকা দিচ্ছে না।’
আমিরুল ভাই মানে শিশুসাহিত্যিক আমিরুল ইসলাম। ‘ছোটদের মেলা’ সাহিত্য পুরস্কারের একমাত্র আর্থিক জোগানদার। অন্যবার টাকা দেয়, এবার দেবে না? কেন? কী হয়েছে!
‘কেন? আমিরুল ভাইয়ের কি টাকার ক্রাইসিস?’
‘আরে না! ওই যে আপনি আমার একটা নাম দিয়েছেন না? আমীরুল ভাই বলল, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না ব্যাটা! ধ্রুব তোর একটা নাম দিয়েছে না, তুই ওটাই। শালা রানীক্ষেত! তোকে টাকা দিয়ে কী হবে? এই বছর টাকা নিয়ে তুই তো পুরস্কার দিবি দুই বছর পর।’
আহারে শাহীন! তোর অভিমান দেখেশুনে সেদিন এত হেসেছিলাম। বলেছিলাম কি?
‘আচ্ছা, আমি আমীরুল ভাইকে বলব। রানীক্ষেত হলেও আমাদের শাহীন কাজের।’
বলিনি। বলব বলব, এই সময় তুই ফোন করলি একবার, ‘ধ্রুবদা, আমার তো ক্যানসার।’
‘কী বলেন, শাহীন?’
‘হ্যাঁ, ধ্রুবদা।’
কী নিরুত্তাপ ছিল তোর গলা!
কত বছর বয়স হয়েছিল তোর? মরে গেলি যে! এত এত কাজ করলি ছোটদের জন্য! ছোটদের কাগজ ‘ছোটদের পত্রিকা’, প্রকাশনা ‘ছোটদের মেলা।’ আর কত কি।
কয়দিন ধরে আমি আর ঢালী ভাই, হুমায়ূন কবীর ঢালী, তোর কথা খুব বলছিলাম তো। তোকে দেখতে যাবে ঢালী ভাই। আমি যাব না। রোগক্লিষ্ট তোকে দেখব না। তাই বলে আর কোনোদিনই দেখব না?
আমি তো তেমন কোথাও যাই না। তোর বিয়েতে গিয়েছিলাম। তোর বিয়ের কার্ড লিখেছিলাম, বানিয়েছিলাম। কত ফুর্তি! ছেলে হলো তোর। কত ফুর্তি!
‘ধ্রুবদা, ছেলের একটা নাম তো লাগবে।’
‘নির্ণয় রাখেন।’
নির্ণয়। তোর খুবই পছন্দ হলো নাম। আবু হাসান শাহীনের ছেলে, নির্ণয় হাসান বা নির্ণয় শাহীন।
সম্পর্ক! ভাই ভাই! কিন্তু আমরা তোর জন্য কী কী করলাম বল তো?
কিছুই তো করতে পারলাম নারে, ভাই! ক্যানসারের সঙ্গে ভীষণ একা একটা যুদ্ধ করতে করতে চলে গেলি তুই! মানুষ মানুষের জন্য, হ্যাঁ? তোর জন্য কেউ তবে কিছু করল না কেন? এত স্বার্থপর হয়ে গেছি আমরা! তোর জন্য কেউ কোথাও ছিল না? এখন কি আছে? তারা কারা?
আমি তোর লাশ দেখতে যাব না। জানাজায় যাব না। কোনো শোকসভায় যাব না। কী হবে গিয়ে? বাঁচানোর জন্য কিছু করতে পারলাম না, মরার পর আহাজারি করব? ধিক্!
আশিক মুস্তাফা টেক্সট পাঠিয়েছে কখন?
৯টা ২৮ মিনিটে।
এখন বাজে ১০টা ৫২।
আমি তোর জন্য কাঁদছিরে ভাই। ও শাহীন, আমি তোর জন্য কাঁদছিরে ভাই।
শাহীন! ও শাহীন!
৪ এপ্রিল,২০১৬
শাহীনের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি
আবু হাসান শাহীন, সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ছোটদের পত্রিকা সম্পাদক, ছোটদের মেলা প্রকাশনা সংস্থার প্রকাশক ও খেলাঘর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাধারণ সম্পাদক। দীর্ঘদিন ক্যানসারের সঙ্গে লড়েছেন। চিকিৎসা নিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের বেঙ্গালুরুর সিএমসি হাসপাতালে। আজ সকাল ৭টায় ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায় নিজ বাসায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর। তিনি স্ত্রী ও এক ছেলে রেখে গেছেন। আবু হাসান শাহীন বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর.কমে নিউজরুম এডিটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিন বছর। অসুস্থতার কারণে স্বেচ্ছায় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেন তিনি। এর আগে দৈনিক ভোরের কাগজ ও দৈনিক দিনের শেষে পত্রিকার সহসম্পাদক ছিলেন শাহীন। তবে শিশুসাহিত্য নিয়ে তিনি আমৃত্যু কাজ করেছেন।