কাহলিল জিবরানের মৃত্যুদিন
লেবানিজ সাহিত্যের বীরের কথা
কাহলিল জিবরান। আরবিতে পুরো নাম জিবরান কাহলিল জিবরান। কিন্তু বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি পরিচিত কাহলিল জিবরান নামে।
কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চিত্রকর, দার্শনিক, নাট্যরচয়িতা- কত পরিচয় তাঁর। ১৮৮৩ সালের ৬ জানুয়ারি তৎকালীন উসমানীয় সাম্রাজ্য জাবাল লেবানন মুতাশরিফাত, বর্তমান লেবাননের উত্তরে পাহাড়ঘেরা বাশারি শহরে স্বল্পবিত্ত এক মেরোনিক-ক্যাথলিক পরিবারে তাঁর জন্ম। বাবা কাহলিল বে। ছিলেন মদ্যপ আর জুয়ারি। মা কামিলা রাহমি। তিনি আগে আরেকটি বিয়ে করেছিলেন। কামিলা রাহমিরা ছিলেন খ্রিস্টান। তাই ছেলের নাম রাখা হলো জিবরান। এই জিবরানই বড় হয়ে ঘুরিয়ে দেন আরবি ভাষায় কবিতা লেখার মোড়টা। বালক জিবরান বড় হন মুসলিম আর খ্রিস্টান ধর্মের একটি যৌথ আবহের মধ্য দিয়ে। এগুলো তাঁর পরবর্তী লেখক জীবনে বেশ প্রভাব ফেলে।
নিজের এই বাস্তবতা সম্পর্কে একটি চিঠিতে কাহলিল জিবরান লিখেছিলেন, “বছরের ঋতুর মতোই এই জীবন। আনন্দময় গ্রীষ্মের পর আসে বিষাদময় শরৎ, বিষণ্ণ শরতের পর ক্রোধী শীত। ভয়ানক শীত গেলে হয় চমৎকার বসন্তের আগমন। আমি জানি না, তবে উপলব্ধি করি এক ধরনের দেনা-পাওনার প্রক্রিয়াই জীবন। এটি আমাদেরকে ‘আজ’ দেয়, ‘কাল’ ফিরিয়ে নেয়ার জন্যই। তারপর আবারও আমাদেরকে দেয়, পুনরায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। আমরা ক্লান্ত-শ্রান্ত হতে হতে চিরনিদ্রায় নিজেকে সমর্পণ না করা পর্যন্ত চলে দেওয়া-নেওয়ার এই চক্র।”
এই কথাগুলো লেখার পেছনের কারণটি হলো, বড় অভাব-অনটন আর দুঃখ-দুর্দশার মধ্যে বড় হয়েছেন তিনি। ভাগ্য বদলের লক্ষ্যে অল্প বয়সে তিনি পরিবারের সাথে অভিবাসী হন যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে তিনি শিল্পকলা নিয়ে পড়াশোনা করেন ও শুরু করেন সাহিত্য জীবন। তার পেছনেও একটি গল্প আছে : জিবরানের জন্মের কিছু দিন পর বাবা কাহলিল জুয়ায় হেরে হয়তো বা সরকারি অর্থ কিছুটা নয়-ছয় করেছিলেন। আর তাই আইনি জালে ফেঁসে হাজতবাসী হন। ১৮৯৪ সালে যখন মুক্তি পেলেন তখন সবই বেদখল হয়ে গেছে। বাড়িটিও নেই। তাই ভাইয়ের বাড়িতে ওঠেন। পাহারা দিতে লাগলেন ভাইয়ের বাদামের বাগান। অন্যদিকে কামিলা আর দ্বিতীয় স্বামীর ঘর করলেন না। ভাইয়ের সঙ্গে চললেন যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৯৫ সালে ২৫ জুন ১২ বছরের জিবরানও রওনা দিলেন মায়ের সঙ্গে জুবেই বন্দর দিয়ে। সেই মদ্যপ কাহলিল বে পড়ে রইলেন বাদাম বাগানেই। লেবানন ছেড়ে যেতে কেঁপে উঠেছিল বালক জিবরানের মন। বিষণ্ণ বালক মনে মনে বলেছে, “আমি আবার ফিরে আসব গাছ। আমি আবার ফিরে আসব মাটি। আমি আবার ফিরে আসব পাহাড়। পাখি ও পবিত্র সিডার বন।” ঠিকই ফিরে এসেছিলেন জিবরান। ১৯৩১ সালে ৪৮ বছর বয়সে বুকে তীব্র ব্যথা নিয়ে নিউইয়র্কের একটা হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, বিশারি গ্রামের মার সারকিস চ্যাপেলের কাছে আমার কবর দিও। সেই যে জলপাই গাছে ঘেরা। তাই হয়েছিল শেষে।
ইংরেজি ও আরবি দুই ভাষাতেই লিখতেন জিবরান। আরব বিশ্বে তাঁকে সাহিত্য ও রাজনৈতিক বিদ্রোহী হিসেবে দেখা হয়। আধুনিক আরবি সাহিত্যের রেনেসাঁয় তাঁর রোমান্টিক ধারা ধ্রুপদী ধারা থেকে আলাদাভাবে জায়গা করে নিয়েছে, বিশেষত তাঁর গদ্য কবিতা। লেবাননে তিনি এখনো সম্মানিত হন সাহিত্যের বীর হিসেবে।
জীবন আর প্রকৃতির নিগূঢ় সব সত্যের এক অনন্য পরিদর্শক আরব সাহিত্যে আধুনিকতার অন্যতম এই রূপকার। ইংরেজিভাষী বিশ্বে তিনি মূলত পরিচিত ১৯২৩ সালের বই ‘দ্য প্রফেটে’র কারণে। তাঁর বইটি ১৯৩০-এর দশকে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ১৯৬০-এর দশকেও তা জনপ্রিয় ছিল।
জীবন আর যাপন নিয়ে সূক্ষ্ম দর্শনের রূপকার কাহলিল জিবরান। জগৎ আর জীবন মিলে যায়, মিশে একাকার হয় তাঁর অনন্যসাধারণ লেখনীর অক্ষরের রূপায়ণে। স্বচ্ছজলের অবাধ গতিময়তা আর স্বপ্নসম গীতিময়তার আখ্যানের আত্মীকরণে তিনি জন্ম দেন- জিব্রানিজম নামের নতুন রেখাময়তার অনুপম ছাপচিত্রের। জিবরানের অমিত অর্ন্তদৃষ্টির, দিব্যতার রহস্যময়তা আর প্রজ্ঞাপারমিতার সংযোগ তাই তাকে অভিধা দেয়– লেবাননের আধুনিক নবী! আর এটাও অজানা হয় তো শেকসপিয়র এবং লাও-সুর পরই সর্বাধিক পঠিত হয় জিবরানের পঙ্ক্তিমালা; তৃতীয় বহুল বিক্রিত বইয়ের কবি। ‘নুবতাহ ফি ফান আল মুসিকা’ আরবি ভাষায় জিবরানের প্রথম গ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে। ‘দ্য ম্যাডম্যান’ ইংরেজিতে প্রকাশিত তাঁর প্রথম গ্রন্থ। এটি প্রকাশিত হয় ১৯১৮ সালে। এ ছাড়া আরবি ও ইংরেজি ভাষায় জিবরান আরো প্রায় ১৪টির মতো কাব্য ও গল্পগ্রন্থ লিখেছেন। ব্রোকেন উইংস জিবরানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য রচনা। নিউইয়র্কের পেন লীগের হয়ে যুক্ত ছিলেন সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে।
শিল্প, সংস্কৃতি আর সাহিত্যের অনেক বিষয়ের ওপরই ছিল জিবরানের প্রবল আগ্রহ। তবে সংগীত ও চিত্রকলায় আগ্রহ ছিল বেশি। তার চিত্রকর্মগুলোও অনন্য। লেবাননে থাকাকালে চিত্রকলায় মনোযোগী হন তিনি। সেখানকার প্রকৃতি আর মানুষই ছিল তার চিত্রকলার অনুপ্রেরণা।
অনেকের কাছেই জিবরান রহস্যময় মানুষ। মানুষের অন্তর্গত প্রকৃতি আর মানসিকতাকে চিত্রকলা ও লেখার মাঝে ধারণ করতে চাইতেন বলেই কারো কারো কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন রহস্যময় এক শিল্পী। তাঁর অন্তর্দৃষ্টির জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন। দার্শনিক প্রজ্ঞা আর আত্মোপলব্ধি দিয়ে তিনি সন্ধান করেছেন সত্যিকারের জীবনবোধের। ১৯৩১ সালের ১০ এপ্রিল মাত্র ৪৮ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটিতে মারা যান এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কসম শিল্পী।