গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের গল্প
গভীর মনোবেদনায় সেই তিন স্বপ্নচর
তাকে বাড়ির এক কোনায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পেলাম। বিশেষত তার জিনিসপত্র আনার আগে অর্থাৎ তার কাপড়চোপড় যেগুলো থেকে সদ্য টুকরো করে কাটা কাঠের গন্ধ বের হচ্ছিল, কাদায় হাঁটার জন্য তার ওজনহীন জুতো নিয়ে আসার আগে কেউ একজন বলেছিল, এরকম মন্থর জীবনের সঙ্গে সে মানিয়ে নিতে পারবে না, কারণ তার সুস্থ রুচি কিংবা কোনো আকর্ষণ কিছুই নেই, থাকার মধ্যে আছে কেবল জটার মতো এক কঠোর নিঃসঙ্গতা, যা তাকে সর্বদা তাড়া করে বেড়াত। আরেকজন বলেছিল-তার একটা শৈশবও ছিল, যা মনে করতে আমাদের বেশ কিছুটা সময় লেগেছিল। হয়তো সে সময় তা আমরা বিশ্বাস করতে চাইনি; কিন্তু তাকে এক কোনায় ভয়ার্ত চোখে ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে বসে থাকতে দেখে হয়তো আমরা বিষয়টি মেনে নিয়েছি যে একদা তার এক শৈশব ছিল; সে এমনই স্পর্শকাতর ছিল যে সে বুঝতে পারত বৃষ্টির পর ঠিক কেমন ঠান্ডা পড়বে, এমনকি নিজের শরীরের ভেতর সে সর্বদা এক অপ্রত্যাশিত ছায়ার নকশা বয়ে বেড়াত।
এই সবই, বরং আরো কিছু বেশি আমরা সেই বিকেলে বিশ্বাস করেছিলাম। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম যে ভয়ঙ্কর অন্তর্জগতের বাইরে সে এক সম্পূর্ণ মানবী। আমরা হঠাৎ এসব দেখলাম, যেন ভেতরে কোনো কাচের পাত্র ভেঙেছে, যখন তার মানসিক যন্ত্রণা চিৎকার হয়ে বেরিয়ে আসছে, যখন সে আমাদের প্রত্যেককে নাম ধরে ডেকেছিল, যতক্ষণ না তার পাশে বসছিলাম, সে কান্নার মধ্যে কথা বলছিল; আমরা গান গাইতে ও হাততালি দিতে শুরু করলাম, যেন আমাদের চিৎকার ভাঙা কাচের টুকরোগুলোকে পুনরায় জোড়া লাগাতে পারবে। ঠিক তখনই আমরা বিশ্বাস করতে পারলাম যে একসময় তার একটা শৈশব ছিল। মনে হলো যেন তার চিৎকারে কোনোকিছুর বিস্ময়কর প্রকাশ ছিল, যেন তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠল বহুগাছ ও গভীর নদী। যখন সে উঠল, কিছুটা সে ঝুঁকে ছিল, আর আঁচল দিয়ে মুখটা না ঢেকেই, নাক না ঝেড়ে, আর চোখে জল এনেই সে আমাদের উদ্দেশ্যে বলল, আমি আর কখনো হাসব না।
আমরা উঠোনে চলে গেলাম। আমরা তিনজনই তখন চুপচাপ। হয়তো আমরা ভেবেছিলাম আমরা একই চিন্তায় আচ্ছন্ন। হয়তো আমরা ভেবেছিলাম বাড়ির আলোগুলো না জ্বালানোই হবে একদন সঠিক কাজ। সে একা থাকতে চেয়েছিল, হয়তো সেই অন্ধকার কোণে, যেখানে বসে চুলের বিনুনি পাকাতে পাকাতে তাঁর মনে হয়েছিল পশুতে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়ায় একমাত্র এই বিনুনিটিই টিকে থাকবে।
বাইরে উঠোনে পোকামাকড়ের ঘন গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে বসে থেকে আমরা তার সম্পর্কে ভাবতে লাগলাম। এর আগেও ঢের বার আমরা এসব করেছিলাম। যেন আমরা বলতে পারতাম জীবনের প্রতিটা দিনই এই কাজটা করেছি। তবুও সেই রাতটা একেবারে অন্যরকম ছিল। সে বলেছিল সে আর কখনো হাসবে না। আর আমরা যারা তাকে ভালোভাবে চিনতাম, নিশ্চিত হলাম যে আমাদের তার দুঃস্বপ্নটা সত্যি হয়েছে। একটা ত্রিভুজের মতোই আমরা বসেছিলাম। কল্পনা করলাম সে এর মাঝখানে আছে। অবাস্তব, অক্ষম সে কল্পনা। অন্তঃস্থলের যে ঘড়িগুলো তার ধুলোয় পরিণত হওয়ার ছন্দের খুঁটিনাটি হিসাব রাখছিল আমরা তার আওয়াজ শুনতে পাইনি। সমবেতভাবে আমরা ভাবছিলাম, সাহস থাকলে আমরা তার মৃত্যু কামনা করতাম। কিন্তু আমরা তাকে এমন এক কুৎসিত, হিমশীতল চেহারায় চেয়েছিলাম, যা আমাদের গোপন ত্রুটিগুলো নিয়েই গড়ে উঠেছে।
অনেকদিন আগে থেকেই আমরা প্রাপ্তবয়স্ক। আর সে ভাগ্যচক্রে এ-বাড়ির জ্যেষ্ঠা। সেই রাতে সে আমাদের সঙ্গে সেখানে বসতে পারত। হৃষ্টপুষ্ট ছেলেরা তাকে ঘিরে রাখতে পারত আর সে তারাদের হিসাবমতো মিটমিট জ্বলা-নেভা অনুভব করতে পারত। কোনো সঠিক নাগরিকের স্ত্রী কিংবা কোনো শিষ্টাচারপূর্ণ পুরুষের রক্ষিতা হতে পারলে সে এ বাড়ির শ্রদ্ধেয় নারীর মর্যাদা পেত। কিন্তু সরলরেখার মতোই সে একমাত্রিক জীবনের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে গেল, হয়তো এই কারণে তার জীবনের ভালো-মন্দ দিকগুলো কারো চোখে পড়েনি। বহুদিন ধরেই আমরা ব্যাপারটা জানতাম। এমনকি একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তাকে পরমানন্দে উঠোনের মাটি কামরায় দেখে আমরা অবাক হয়নি। তখন সে হেসে উঠল। আবার আমাদের দিকে চোখ তুলে চাইল। সে দোতলার জানালা থেকে উঠোনের শক্ত মাটিতে পড়েছে। সেখানেই কিছুক্ষণ পড়ে রইল। কঠিন ও দৃঢ় হয়ে। মুখটা ভেজা মাটির দিকে ফেরানো। কিন্তু আমরা পরে জানতে পেরেছিলাম যে দূরত্ব বিষয়ক আতঙ্ক অথবা শূন্যতার মুখোমুখি হওয়া নিয়ে ভয় একমাত্র তখনো তার মধ্যে ছিল। আমরা কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম তাকে। প্রথমে তাকে যতটা শক্ত মনে হয়েছিল, ততটা শক্ত সে ছিল না। বরং তার শিথিল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আর ইচ্ছের বিরুদ্ধে শিথিল হয়ে এসেছিল, মনে হচ্ছিল যেন এক কবোষ্ণ মৃতদেহ যা তখনো শক্ত হয়ে ওঠেনি।
তার চোখ দুটি খোলাই ছিল। মাটি মেখে যাওয়ায় মুখটা ময়লা হয়ে ছিল, যেন ইতিমধ্যে কবরের মধ্যেকার স্বাদচাখা হয়ে গেছে। যখন তাকে রোদের দিকে ফেরালাম, মনে হলো তাকে এক আয়নার দিকে ফিরিয়েছি। সে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়েছিল। আমার হাতের ওপর রাখা তার কামনা শূন্য চাউনি তার অনুপস্থিতি বুঝিয়ে দিল। কেউ একজন বলল, সে মারা গেছে। কিন্তু তারপরেই তার মুখে ফুটে উঠল সেই শীতল ও শান্ত হাসি যা রাতের বেলায় বাড়িটিকে জাগিয়ে রাখার জন্য তার মুখে লেগে থাকত। সে বলল যে সে জানেই না কীভাবে সে উঠোনে গেল। তবে সে জানাল যে সে নিজেকে উষ্ণ অনুভব করছে। একটা ঝিঁঝিপোকা এত তীক্ষ্ণভাবে ডাকছিল যে তার মনে হলো তার ঘরের দেয়ালটা ভেঙে পড়ে যাবে। ঠিক সে সময়ে সিমেন্টের মেঝেতে গাল ঠেকিয়ে রোবারের প্রার্থনা তার মনে পড়ে গেল।
ঘটনাক্রমে আমরা জানতে পেরেছিলাম যে, সে কোনো প্রার্থনাই মনে করতে পারে না, কারণ আমরা পরে দেখেছিলাম বাইরে থেকে ঝিঁঝিপোকার ধাক্কায় দেয়াল পড়ে যেতে পারে এরকম ধারণায় ভেতর থেকে সে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়ায় হারিয়ে গেছে তার সকল সময়জ্ঞান; আর তখন নাকি কেউ দেয়ালটা পাশে সরিয়ে রাখে আর তাকে কাঁধ ধরে বাইরে নিয়ে এসে রোদের দিকে মুখ করে শুইয়ে দেয়।
ওই রাতে উঠনে বসেই আমরা জেনেছিলাম সে আর কখনো হাসবে না। হয়তো তার এক কোনায় আঁধারে ঘেরা ও স্বেচ্ছাকৃত যাপনে ভাবলেশহীন গাম্ভীর্য আমাদের পূর্বানুমানে কষ্ট দিয়েছিল। এটা আমাদের গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল, যেভাবে ঘরের সেই কোণে তাকে সারা দিন বসে থাকতে দেখেছিলাম, যেখানে এখন সে বসে আছে। আর আমরা তাকে বলতে শুনলাম সে বাড়িতে আর কখনো ঘুরে বেড়াবে না। প্রথমে তাকে বিশ্বাস করিনি। প্রথম কয়েক মাস সব সময় তাকে মাথা উঁচু করে সারাটা ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে দেখেছিলাম, যদিও তার কাঁধটা ঝুঁকে পড়েছিল। সে কখনো থামেনি, কখনো ক্লান্ত হয়ে পড়েনি। রাতের বেলা দুই অন্ধকার কোনার মধ্যে তার ভারী শরীরের চলাফেরার শব্দ আমরা শুনতে পেতাম। আর আমরা বহুবার বিছানায় জেগে থাকতাম, শুনতাম তার চুপিসারে হাঁটার শব্দ, আমাদের কানগুলো তাকে সারাটা বাড়িময় অনুসরণ করে চলত। একবার সে আমাদের বলেছিল যে সে আয়নার ভেতরে একটি ঝিঁঝিপোকাকে কঠিন স্বচ্ছতায় নিমজ্জিত অবস্থায় দেখেছিল, আর সেটা তাকে ধরার জন্য আয়নাকে ভেদ করেছিল। আমরা সত্যিই বুঝতে পারিনি সে প্রকৃতপক্ষে কী বলতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা সবাই দেখতে পেয়েছিলাম যে ভিজে পোশাক তার গায়ের সঙ্গে লেপ্টে গিয়েছিল, যেন সে সবে কোনো চৌবাচ্চা থেকে উঠে এসেছে। এই প্রপঞ্চকে ব্যাখ্যার মধ্যে না গিয়ে আমরা ঠিক করে ফেললাম বাড়ি থেকে পোকাগুলোকে দূর করতে হবে, যেগুলো তাকে আচ্ছন্ন কররে রেখেছে।
আমরা দেয়ালগুলো একে একে পরিষ্কার করলাম। উঠোনের গাছগাছালি কাটার ব্যবস্থা করা হলো। এ যেন রাতের নৈঃশব্দ্য দূর করতেই আবর্জনা সাফ করলাম। কিন্তু আমরা আর তার হাঁটার শব্দ পেলাম না, কিংবা ঝিঁঝিপোকা নিয়ে সে আর একটি কথাও বলত না। সেদিন পর্যন্ত এরকমই ঘটে, যেদিন খাওয়ার পর সে সিমেন্টের মেঝের ওপর বসে আমাদের দিকে তাকাল, আর বলল, এই মেঝেতেই আমি বসে থাকব। আমরা শুনে কেঁপে উঠেছিলাম। কারণ আমরা দেখলাম যে তাঁকে এরই মধ্যে সম্পূর্ণ এক শবের মতো দেখাচ্ছে।
এ অনেকদিন আগের ঘটনা। এভাবেই আমরা এখানে বসে তাঁকে আধবোনা বিনুনিতে দেখতে দেখতে বেড়ে উঠেছি। দেখে মনে হতো একাকিত্বে ডুব দিয়ে সে যেন আত্ম-অস্তিত্ব বেমালুম হারিয়ে ফেলেছে। আর এ জন্যই আমরা বুঝেছিলাম সে কখনো আর হাসবে না। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সে একথা আমাদের বলেছিল। আর তার সঙ্গে এও বলেছিলসে আর হাঁটাচলা করবে না। ঠিক সেই মুহূর্তে আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই যে এভাবে সে একদিন বলে উঠবে, আর কোনোদিন আমি চোখে দেখতে পাব না’, অথবা ‘কখনো আমি আর শুনতে পাব না।’ আমরা বুঝেছিলাম সে এমনই এক মহিলা যে স্বেচ্ছায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের কাজকর্ম ত্যাগ করতে পারে। আর এভাবেই মুক্তচিত্তে সে নিজেকে শেষ করার দিকে নিয়ে চলে যেতে পারে। একেক করে সকল বোধভাষ্যি হারিয়ে সে সেই দিন পর্যন্ত যেতে পারে, যে দিন আমরা দেখব তার মাথা দেয়ালে ঠেকে গেছে। মনে হবে যেন জীবনে এই প্রথমবারের জন্য সে ঘুমিয়ে পড়েছে। এসব কিছু ঘটার জন্য হয়তো তখনও অনেক সময় বাকি ছিল। কিন্তু উঠোনে বসে আমরা তিনজন শুনতে চাইছিলাম অকস্মাৎ ওই রাতের কাচভাঙা তার তীক্ষ্ণ কান্না। অন্ততপক্ষে আমাদের মধ্যে এক মায়াজালের জন্ম দিতে একটি শিশু… বলতে গেলে একটি মেয়েশিশু বাড়িটিতে জন্ম নিয়েছে, যেন বিশ্বাস করতে পারি তার নবজন্ম হয়েছে।
(মূল গল্প : Amargura Para tres sonambulos. গল্পটি গ্রেগরি রাবাস্যা ও জে এস বের্নস্টেইনের স্প্যানিশ থেকে অনূদিত ইংরেজি গল্প ‘Bitterness fort Three Sleepwalkers’ থেকে বাংলায় অনুবাদ করা হয়েছে।)