রহস্যময় শেকসপিয়র!
অতি সম্প্রতি (২৩ এপ্রিল ২০১৬) পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকা একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কবি, নাট্যকার উইলিয়াম শেকসপিয়রের ওপর। শিরোনাম ‘শেকসপিয়র কি মহিলা ছিলেন? সমকামীও!’ প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছে- “যে অমোঘ প্রশ্ন শেকসপিয়রকে নিয়ে আজও তাড়া করে বেড়ায়, সেটা হলো, তিনি কি মহিলা ছিলেন? বক্তব্যের সমর্থনে বিভিন্ন সময় ঐতিহাসিকরা বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত শেকসপিয়র আদৌ নারী ছিলেন কি না তা প্রমাণ করা যায়নি। বরং মনে করা হয়, ‘এমিলিয়া বাসানো ল্যানিয়ার’ নামে এক নারী ছিলেন শেকসপিয়রের যাবতীয় লেখনীর নেপথ্যে। কবির হয়ে কলম ধরেছিলেন এমিলিয়া। যদিও তা প্রকাশ পেত শেকসপিয়রের নামেই।”
এরপর আসে শেকসপিয়রের সমকামিতার বিষয়টি- শেকসপিয়র কি সমকামী ছিলেন? প্রতিবেদনে প্রকাশ, ‘ইতিহাসবিদরা বলেন, তাঁর (শেকসপিয়র) নাটক বা সনেটে এই আভাস পাওয়া যায় যে, শেকসপিয়র ছেলেদের বেশি পছন্দ করতেন।’ বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শেকসপিয়র ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মাইকেল ডবসনের কথায়, “সে সময় ‘স্ট্রেট’ বা ‘গে’ সম্বন্ধে আলাদা কোনো ক্যাটাগরি ছিল না। শেকসপিয়রের সনেটে এমন অনেক ইঙ্গিত রয়েছে, যেখানে অল্পবয়সী পুরুষদের তিনি সেক্সি বলেছেন। ফলে এই প্রশ্নটা একেবারে উড়িয়েও দেওয়া যায় না।”
প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, শেকসপিয়র নারী না হলেও ছিলেন সমকামী- এমনটাই যুক্তি দাঁড় করিয়েছে আনন্দবাজার। ব্যক্তি-মানুষ হিসেবে শেকসপিয়র কেমন ছিলেন, তা ঐতিহাসিকরাই ভালো বলতে পারবেন। সাহিত্যের একজন ছাত্র হিসেবে সেই হিসাব কষার দায়িত্ব আমার নয়। আমি কেবল একজন শিল্পীর শিল্পগুণ বা লেখকের সাহিত্যরসটুকু আস্বাদন করতে পারি।
কম-বেশি আমরা সবাই জানি, ইংরেজি ভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক এবং বিশ্বের অগ্রণী নাট্যকার হিসেবে যাঁকে মনে করা হয়, তিনি হলেন উইলিয়াম শেকসপিয়র। ইংল্যান্ডের ‘জাতীয় কবি’ এবং ‘বার্ড অব অ্যাভন’ বা অ্যাভনের চারণকবি নামেও অভিহিত করা হয় তাঁকে। তাঁর যে রচনাগুলো পাওয়া গেছে এর মধ্যে রয়েছে ৩৮টি নাটক, ১৫৪টি সনেট, দুটি দীর্ঘ আখ্যান কবিতা এবং আরো কয়েকটি কবিতা। কয়েকটি লেখা অন্য লেখকদের সঙ্গে যৌথভাবেও লিখেছিলেন তিনি। তাঁর নাটক প্রভাবশালী বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং অপর যেকোনো নাট্যকারের রচনার তুলনায় মঞ্চস্থ হয়েছে অধিকবার।
শেকসপিয়রের জন্ম ও বেড়ে ওঠা স্ট্র্যাটফোর্ড অন-অ্যাভনে। তাঁর বাবা জন শেকসপিয়র ছিলেন একজন সফল গ্লোভার ও অল্ডারম্যান। তাঁর আদি নিবাস ছিল স্নিটারফিল্ডে। শেকসপিয়রের মা মেরি আরডেন ছিলেন এক ধনী কৃষক পরিবারের সন্তান। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের আট সন্তানের মধ্যে তৃতীয় এবং জীবিত সন্তানদের মধ্যে সর্বজ্যেষ্ঠ। সেই যুগের কোনো লিখিত প্রমাণ না পাওয়া গেলেও, অধিকাংশ জীবনীকার মোটামুটি একমত যে শেকসপিয়র সম্ভবত স্ট্র্যাটফোর্ডের কিংস নিউ স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৫৫৩ সালে এই মুক্ত বিদ্যালয়টি সনদ পায়। স্কুলটি শেকসপিয়রের বাড়ি থেকে ছিল পৌনে এক মাইল দূরে। এলিজাবেথীয় যুগে গ্রামার স্কুলগুলোর মান সর্বত্র সমান ছিল না। তবে স্কুলগুলোর পাঠ্যক্রম সারা ইংল্যান্ডেই আইন দ্বারা ছিল নির্দিষ্ট করা। এই কারণে মনে করা হয়, স্কুলে বিস্তারিত পাঠ দেওয়া হতো লাতিন ব্যাকরণ ও ধ্রুপদী সাহিত্যের।
মাত্র আঠারো বছর বয়সে শেকসপিয়র বিয়ে করেন অ্যানি হ্যাথাওয়েকে। বিয়ের ছয় মাস পরে অ্যানি সুজানা নামে একটি মেয়ের জন্ম হয় শেকসপিয়র দম্পতির ঘরে। এর প্রায় দুই বছর বাদে তাঁদের ঘরে জন্ম নেয় হ্যামনেট নামে এক ছেলে ও জুডিথ নামে এক মেয়ে। এরা ছিল যমজ। হ্যামনেটের মৃত্যু হয়েছিল মাত্র এগারো বছর বয়সে। তার মৃত্যুর কারণ জানা যায় না।
১৫৮৫ থেকে ১৫৯২ সাল পর্যন্ত বছরগুলোকে বিশেষজ্ঞরা শেকসপিয়রের জীবনের ‘হারানো বছর’ বলে উল্লেখ করে থাকেন। জীবনীকাররা নানা অপ্রামাণিক গল্পের ভিত্তিতে এই পর্বের এক একটি বিবরণ প্রস্তুত করেছেন। শেকসপিয়রের প্রথম জীবনীকার তথা নাট্যকার নিকোলাস রো স্ট্র্যাটফোর্ডের একটি কিংবদন্তির উল্লেখ করে বলেছেন, ‘হরিণ রান্না করার অপরাধে বিচারের হাত থেকে বাঁচতে শহর ছেড়ে লন্ডনে পালিয়ে গিয়েছিলেন শেকসপিয়র।’
অষ্টাদশ শতাব্দীতে প্রচলিত আরেকটি গল্প হলো, লন্ডনের থিয়েটার পৃষ্ঠপোষকদের ঘোড়ার রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে নাট্যশালায় কাজ করতে শুরু করেন শেকসপিয়র। জন অব্রে লিখেছেন, শেকসপিয়র গ্রামে স্কুলশিক্ষকের চাকরি করতেন। বিংশ শতাব্দীর কয়েকজন গবেষকের মতে, ল্যাংকাশায়ারের আলেকজান্ডার হঘটন নামে এক ক্যাথলিক ভূস্বামী তাঁকে স্কুলশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এই ব্যক্তি তাঁর উইলে উল্লেখ করেছিলেন, ‘উইলিয়াম শেকশ্যাফট’ নামে এক ব্যক্তির নাম। তবে এসব গল্পের সমর্থনে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এসবই প্রচলিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর। অন্যদিকে ল্যাংকাশায়ার অঞ্চলে শেকশ্যাফট একটি সাধারণ নাম মাত্র।
১৫৮৫ থেকে ১৫৯২ সালের মধ্যবর্তী সময়ে অভিনেতা ও নাট্যকার হিসেবে লন্ডনে যথেষ্ট খ্যাতি লাভ করেন শেকসপিয়র। লর্ড চেম্বারলেইনস ম্যান নামে একটি নাট্য কোম্পানির তিনি ছিলেন সহ-স্বত্বাধিকারী। এই কোম্পানিটিই পরবর্তীকালে কিংস মেন নামে পরিচিত হয়। ১৬১৩ সালে তিনি নাট্যজগৎ থেকে সরে আসেন এবং ফিরে যান স্ট্র্যাটফোর্ডে। তিন বছর বাদে সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর।
শেকসপিয়রের পরিচিত রচনাগুলোর অধিকাংশই মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৫৮৯ থেকে ১৬১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে। তাঁর প্রথম দিকের রচনাগুলো ছিল মূলত মিলনান্তক ও ঐতিহাসিক নাটক। ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে তাঁর দক্ষতায় এই দুটি ধারা শিল্পসৌকর্য ও আভিজাত্যের মধ্যগগনে ওঠে। এরপর ১৬০৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রধানত কয়েকটি বিয়োগান্ত নাটক রচনা করেন। এই ধারায় রচিত তাঁর হ্যামলেট, কিং লিয়ার ও ম্যাকবেথ ইংরেজি ভাষার কয়েকটি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি। জীবনের শেষ পর্বে তিনি ট্র্যাজিক-কমেডি রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। এই রচনাগুলো রোম্যান্স নামেও পরিচিত। এই সময় অন্য নাট্যকারদের সঙ্গে যৌথভাবেও কয়েকটি নাটকে কাজ করেন তিনি। প্রকৃত পক্ষে, তাঁর জীবদ্দশায় প্রকাশিত নাটকগুলোর প্রকাশনার মান ও প্রামাণ্যতা সর্বত্র সমান ছিল না। ১৬২৩ সালে তাঁর দুই প্রাক্তন নাট্যসহকর্মী দুটি নাটক বাদে শেকসপিয়রের সমগ্র নাট্যসাহিত্যের ফার্স্ট ফোলিও প্রকাশ করেন।
সম্ভবত ড. স্যামুয়েল জনসন সেই অসাধারণ মেধাসম্পন্ন মানুষ, যিনি ১৯৫৫ সালে তাঁর আ ডিকশনারি অব দ্য ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ (সঠিক অর্থে ইংরেজি ভাষার প্রথম অভিধান) প্রকাশ করেছিলেন, সর্বপ্রথম উপলব্ধি করেছিলেন উইলিয়াম শেকসপিয়রের একটি শুদ্ধ পাঠোদ্ধার অত্যন্ত প্রয়োজন। কারণ, শেকসপিয়র যা কিছু লিখেছিলেন তা তাৎক্ষণিকভাবে নাটকের কলাকুশলীদের হাতে হাতে পৌঁছে তাদের ইচ্ছামতো বিকৃতির শিকার হয়েছে। এর একটি অন্যতম কারণ, তারা শেকসপিয়রের শব্দচয়ন ও কল্পনার বিন্যাস বুঝতে না পেরে মূল বা আদি পাঠকে নিজেদের মতো সহজ করে নিয়েছিল। এ কারণেই ড. জনসন ‘দ্য প্লেইজ অব উইলিয়াম শেকসপিয়র’ গ্রন্থটি রচনা করেন। এই গ্রন্থে ড. জনসন একটি দীর্ঘ ভূমিকাও সংযোজন করেছিলেন, যেখানে তিনি মন্তব্য করেছেন শেকসপিয়রের চরিত্রগুলো কোনো ভৌগোলিক অবস্থানে আবদ্ধ নয়, তাঁর চরিত্ররা কথা বলে সেই প্রাকৃতিক প্রবল অনুরাগে, যার দ্বারা বিশ্বের সব মানুষের চিন্তাভঙ্গি আলোড়িত হয় এবং মানবজীবন তারই অভিঘাতে সচল হয়। জনসন আরো বলেছেন, অন্য সবার চরিত্র সৃষ্টি যখন সহজেই হয়ে যায়, শুধু একজন ব্যক্তিসত্তা, শেকসপিয়রের চরিত্ররা তখন পরিণত হয় একটি সম্পূর্ণ মানব প্রজাতিতে। ফলে এ কথা সত্য যে, শেকসপিয়রের নাট্যকারসত্তা একান্তই শেকসপিয়রীয়।
শেকসপিয়র ছিলেন তাঁর সমকালে একজন সম্মানিত কবি ও নাট্যকার। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর খ্যাতি হ্রাস পায়। অবশেষে ঊনবিংশ শতাব্দীতে খ্যাতির শীর্ষে ওঠেন তিনি। রোমান্টিকরা তাঁর রচনার ছিলেন গুণগ্রাহী। ভিক্টোরিয়ানরা রীতিমতো তাঁকে পূজা করতেন; জর্জ বার্নার্ড শ’র ভাষায় যা ছিল ‘bardolatry’। একবিংশ শতাব্দীতেও গবেষণা ও নাট্য উপস্থাপনার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে তাঁর রচনাকে পুনরাবিষ্কার করার চেষ্টা করা হয়। তাঁর নাটক আজও অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুচর্চিত। সারা বিশ্বের নানা স্থানের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নানা আঙ্গিকে মঞ্চস্থ ও ব্যাখ্যাত হয়ে আসছে এই নাটকগুলো।