হুমায়ুন আজাদের জন্মদিন
বাবাকে মেয়ের শুভেচ্ছা
এক যুগ পেরিয়ে গেছে, তুমি নেই। তোমার শারীরিক অস্তিত্ব নেই বটে, কিন্তু বহুমাত্রিক লেখক ছিলে বলে তোমার ব্যতিক্রমী চিন্তাধারাগুলো আজও তোমার বহু ভক্ত-পাঠকের মধ্যে প্রবহমান। তোমার জীবনযাপন আর দশটা সাধারণ শিক্ষকের মতো নাকি একটু অন্য রকম ছিল, তা নিয়ে এখনো রয়েছে অনেকের কৌতূহল।
আমাদের মতো অতি সাধারণ হলে মৃত্তিকার সঙ্গে মিশে যাওয়া মাত্রই তুমি বিস্মৃত হতে। কিন্তু তুমি তো সাধারণ নও। তুমি ছিলে অলোকসামান্য। তাই বছর ঘুরে দেয়ালে থাকা ক্যালেন্ডারে তোমার জন্মদিনটি (২৮ এপ্রিল) ঠিকই এসে হাজির হয় এবং অনেককে ভাবায়। তোমার মেয়ে বলে, তোমাকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলাম বলেই হয়তো বিভিন্ন পত্রিকা থেকে তোমার জন্মদিনের স্মৃতিচারণ বিষয়ে লেখার অনুরোধ পাই।
তোমার মুখ থেকে শুনেছি, বাল্যকালে কখনই জন্মদিন পালন করোনি। জন্মদিনের রেওয়াজ ছিল না তোমাদের বাড়িতে। কবে জন্মদিন এলো বা গেল, তা মনে রাখার তাগিদ ছিল না কারো। বাল্যকাল পেরিয়ে রাড়িখাল গ্রাম ছেড়ে পড়তে এসেছিলে ঢাকা কলেজে ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুনিনি কখনো সেখানে বন্ধুরা মিলে জন্মদিন উদযাপন করেছিলে কি না?
যখন আমি বুঝতে শিখেছি, অর্থাৎ ধীরে ধীরে বড় হচ্ছিলাম আর তুমিও বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলে, তখন পারিবারিকভাবে মাঝেমধ্যে তোমার জন্মদিন হতো, তাই না? এ জন্য তোমার যে খুব বেশি ইচ্ছা ছিল, তা-ও দেখেনি। পারিবারিকভাবে তোমার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাসায় বেশ ঘটা করেই জন্মদিন হয়েছিল, যার মূল ক্রেডিট ছিল আমাদের মায়ের। মা তোমার জন্য ৫০ নম্বর অঙ্কিত কেক এনেছিলেন, তোমার পছন্দমতো বিভিন্ন পদের রান্নাও করেছিলেন নিজ হাতে। কোনো এক ভক্তের দেওয়া সোনালি কালারের সুতার কাজ করা চমৎকার ফতুয়া পরেছিলে তুমি। অতিথি যে খুব বেশি হয়েছিল, তা নয়। তুমি তো আসলে খুব বেশি মানুষ পছন্দও করতে না। পরিবারের আমরা কয়জন, তোমার প্রকাশক আর তোমার কিছু ভ্ক্ত। কী যে আনন্দ হয়েছিল সেবার! তোমার জন্মদিন, কিন্তু আজও চোখে ভাসে আমরা সবাই সাজগোজ করে তোমার চারপাশে ঘিরে ছিলাম। জন্মদিনে ফুল আর উপহার পেতে ভক্তদের কাছে। আমাদের ড্রয়িংরুমটি ফুলে ফুলে ভরে যেত তোমার জন্মদিনে। ল্যান্ডফোনে বিভিন্ন পত্রিকা অফিস থেকে ক্রমাগত ফোন আসত, তুমি শুভেচ্ছা শুনে মৃদু হাসতে। তোমার ৫০তম জন্মদিনে চ্যানেল আই তোমাকে নিয়ে একটি অসাধারণ ডকুমেন্টারি করেছিল।
সে সময় অনেকে বলেছিলেন, এই ডকুমেন্টারি হুমায়ুন আজাদ এত তাড়াতাড়ি না করলেও পারতেন। এসব ডকুমেন্টারি আরো বেশি বয়সেই হলে ভালো হয়। কিন্তু তুমি কারো কথা শোননি। তুমি তোমার প্রিয় গ্রাম রাড়িখালে গিয়ে ডকুমেন্টারি করেছিলে। আজ যখন ডকুমেন্টারিটি দেখি (কারণ এখন তোমাকে দেখার সেটাই আমার একমাত্র উপায়) তখন মনে হয়, তুমি কি ভেতরে ভেতরে টের পেয়েছিলে তোমার আর খুব বেশি সময় বাকি নেই?
তোমার ৫০তম জন্মদিনে বের হয়েছিল তোমার বেশ কিছু লেখা নিয়ে সংকলিত বই ‘বহুমাত্রিক জ্যোতির্ময়’। বইয়ের কভারেই ছিলে তুমি। বইয়ের ভূমিকাটা তোমারই লেখা। প্রায়ই ভূমিকাটি আমি পড়ি, কারণ কিছু কথা আমার বেশ লাগে।
তুমি লিখেছ, ‘আমি জানি মরে যাওয়াই নিয়তি; একটি নিয়তিতেই বিশ্বাস করি আমি। ৫০ পূর্ণ হতে যাচ্ছে আমার, এটা বিস্ময়কর মনে হয়, অনেক আগেই তো মরে যেতে পারতাম। আমি বেঁচে থাকতে চেয়েছি, কিন্তু বেঁচে থাকার জন্য কোনো প্রার্থনা করিনি। আমি ৫০ হচ্ছি, তবে আমার শরীর ৫০-কে অনুভব করে না, যেমন ছিলাম একুশে, তেমনই তো আছি। চুল সাদা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে, কিন্তু ভেতরে কোনো ৫০ নেই। শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক বা গণ্যমান্যদের মতো আচরণ করতে পারতাম আমি, এ অধিকার ছিল আমার, পরতে পারতাম তাদের মতো সম্ভ্রান্ত পোশাক, সবকিছুকে শ্রদ্ধা করে নিজেকে করে তুলতে পারতাম শ্রদ্ধেয়, কিন্তু আমি তা করিনি, তাই হয়তো ৫০-এর মহিমা অনুভব করতে পারছি না। প্রতিবছরই জন্মদিন এসে নীরবে চলে যায়, তারিখ মনে পড়ে না। সে হিসেবে আমার বয়স হয়তো ৫০ নয়, আমার বয়স দীর্ঘ এক বছর, যা সম্পূর্ণ হবে যখন অন্ধকার নামবে।’
তোমার এ কথাগুলো আমার এত ভালো লাগে যা বলে বোঝাতে পারব না। যতবার পড়ি মনে হয়, তুমি সবার চেয়ে আলাদা।
৫০-এর পর তোমার বাকি জন্মদিনগুলো (মাত্র সাতটি জন্মদিন পেয়েছিলে এরপর) মূলত ঘরোয়াভাবেই পালন হতো। বহু লেখকের জন্মদিন ঘটা করে আয়োজনের ব্যবস্থা করেছিলে তুমি, কিন্তু জীবিত অবস্থায় তোমার জন্মদিন নিয়ে কারো কোনো উদ্যোগ কখনো আমার চোখে পড়েনি।
২০০২ সাল। সে বছর তুমি প্রথমবার আমাদের ছাড়া জন্মদিন করেছিল মার্কিন মুলুকে। মুক্তধারার আয়োজনে সেখানে বইমেলায় গিয়েছিলে। প্রবাসীদের সঙ্গে বেশ জাঁকজমকভাবেই করেছিলে জন্মদিন। যখন তুমি ফোনে সুদূর আমেরিকা থেকে জন্মদিন উদযাপনের কথা আমাকে ফোনে বলছিলে, মনে হচ্ছিল বেশ সুখবোধ করছো।
এরপর ২০০৪ সাল। তোমার এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার বছর। ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তায় আক্রান্ত হয়ে অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলে। চিকিৎসার জন্য গেলে ব্যাংককের এক হাসপাতালে। কাকতালীয়ভাবে সে সময় এসে গেল ২৮ এপ্রিল। রাত ১২টার সময় ডাক্তার ও নার্সরা কেক নিয়ে এসে তোমাকে উইশ করল। ‘হ্যাপি বার্থডে প্রফেসর’ লেখা কেক দেখে বিস্মিত হলে বৈকি। এত অল্প সময়ে বিদেশের ডাক্তারদের মন তুমি জয় করে ফেললে কীভাবে, ভেবেছ নিশ্চয়। সম্ভব ছিল তোমার পক্ষে, আমি জানি। তোমার নানা বিষয়ে জ্ঞান, অসাধারণ কথা বলার ক্ষমতা তোমাকে নিয়ে যেত পারত অনেকের খুব কাছে।
সেই ছিল তোমার শেষ জন্মদিন এ পৃথিবীতে। তুমি নেই পারিবারিকভাবে আর তাই কিছু করি না আমরা। বেশ কিছু সংগঠন নিজ উদ্যোগে এখন তোমার জন্মদিন করে, বিভিন্ন পত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের করে, এই যা। অবশ্য এখন তোমার কাছে আদৌ এসবের মূল্য আছে কি? তুমি তো তোমার বইয়ে লিখেই গেছ, ‘আমি জানি, ভালো করেই জানি, কিছু অপেক্ষা করে নেই আমার জন্য, কোন বিস্মৃতির বিষণ্ণ জলধারা, কোন প্রেতলোক, কোন পুনরুত্থান, কোন বিচারক, কোন স্বর্গ, কোন নরক। আমি আছি, একদিন থাকব না, মিশে যাব, অপরিচিত হয়ে যাব, জানব না আমি ছিলাম। নিরর্থক সব পুণ্যশ্লোক, তাৎপর্যহীন প্রার্থনা, হাস্যকর উদ্ধত সমাধি। মৃত্যুর পর যেকোনো জায়গাতেই আমি পড়ে থাকতে পারি, জলে, জলাভূমিতে, পথের পাশে পাহাড়ের চূড়ায়, নদীতে...।’
যা লিখে গেছ, এর পরে আমার আর কিছু বলার থাকে কি? তার পরও ২৮ এপ্রিল এলে বৈশাখের পুড়ে যাওয়া গরমের এ দিনে জানাতে ইচ্ছা হয় তোমাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।
শুভ জন্মদিন বাবা, তোমাকে।
লেখক : হুমায়ুন আজাদের মেয়ে।