ব্যক্তিগত বর্ষা
সেই সব বৃষ্টিদিন
মনে পড়ছে আমাদের ছোটবেলায় দেখা এক সপ্তাহ একটানা বৃষ্টির অভিজ্ঞতার কথা। ২০০৪-এর সেই অবাক বৃষ্টির পর তেমন করে যেন আর বর্ষা নামেই না।
ছোটবেলার বৃষ্টির দিন ছিল খুব মিষ্টি। স্কুল যাওয়া নাই, বাসায় পড়াতে স্যার আসতে পারতেন না। সারা দিন তিন ভাইবোন মিলে হুটোপুটি, আম্মুর বকা, ফুপুকে ভয় পাওয়া আর সেই সব ছেলেমেয়ের মতো বৃষ্টিতে ভিজতে বের হতে না পারার দুঃখ, যারা ছিল আমাদের থেকে সুখী। মনে মনে খুব আফসোস হতো, ইশ ওদের কত সুখের জীবন, ওদের মা-বাবারা কত ভালো।
এই একটানা কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি নেমে থাকাকে আমরা বলি কাইচ্ছে। তো, কাইচ্ছে দিনের সকাল হতো একটু দেরিতে, স্কুল যাওয়া যাচ্ছে না, তাই বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা। সকালে তো অবশ্যই খিচুড়ি নাশতা। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে আলো কম—এই অজুহাতে পড়া থেকে সাময়িক অব্যাহতি। সোফায় বসে জানালায় মুখ গলিয়ে পরিচিত-অপরিচিত যে কারো কাছ থেকে জানার চেষ্টা, সে কোথায় কতটুকু পানি জমতে দেখে এসেছে। আর আমাদের রাজ্যির আফসোস সেখানে দেখতে যেতে না পারার।
একফাঁকে হয়তো একটু ঘুমিয়ে পড়া, হকার পেপার দিয়ে গেলে হুমড়ি খেয়ে সেটা দেখা, মাঝেমাঝে মল্লযুদ্ধও হয়ে যেত সেটা নিয়ে।
বিকেলে একটু বাইরে যাওয়ার অনুমতি মিলত। তখন আর পায় কে, কলি আর বাপ্পি আমাদের দুই মার্কো পোলো এক ঘণ্টা কলেজপাড়া প্রদক্ষিণ করে দেখে আসত কোন মাঠে কতটা পানি জমেছে, রাস্তা দিয়ে রিকশা যেতে কী ভোগান্তি হচ্ছে।
পানি তো কলিকে খুবই এক্সাইটেড করে দিত, স্বাভাবিকভাবে পা সে ফেলতেই পারত না পানিতে! কাপড়-জামা ভিজিয়ে ছিটে ছিটে কাদার দাগ নিয়ে তার বাসায় ফেরা। সে জন্য বাইরে বেশি আনন্দ করে বাড়ি ফেরা মানে বেশি ময়লা কাদা মেখে বাড়ি ফেরা আর সেই দিন বকাটাও বেশি খাওয়া। সর্বোচ্চ আনন্দ করে বাড়ি ফিরলে সেদিন তার জন্য আম্মুর মাইর ফিক্সড ছিল।
বৃষ্টির দিনে আমার মজা করাটা ছিল ভিন্ন। বাড়ির গোলবারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখা, নয়তো ঘরের জানালা দিয়ে, একটু বৃষ্টি ধরে এলে পাপলি আপাদের বাড়িতে যাও। পাপলি আপা, পিয়াসী আপা আর আমি হাঁটতে বেরোতাম। পানির মধ্যে বেশিক্ষণ হাঁটা হতো না আমার।
চোখ চলে যেত নাছির মার টয়লেটের ভাঙা আংশটার দিকে, নয়তো বাসার ড্রেনের পানি বৃষ্টির পানির সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ার পথে। পানিবিলাসের ইতি টানতে দে ছুট, বারবার সাবানেও ও খেদ আমার যেত না।
কোনো কোনো দিন এমন ঘোর বৃষ্টি হতো যে বেরোনোর অনুমতি মিলত না। সেদিন বাইরের ঘরের দরজা খুলে দিয়ে কেউ দরজার সামনের সোফায়, কেউ জানালার সাথের সোফায় ঝুলে ঝুলে মানুষ দেখা। বাজারফেরত এরশাদপুর নয়তো আনন্দধামের মানুষ মুখে মুখে ছড়াতে ছড়াতে যেত—আজ ইলিশের আমদানি খুব কিংবা ইলিশ মাছ সস্তা।
মাছ কে কে কিনেছে দেখা না গেলেও দেখা যেত কারা কারা গাড়াগঞ্জের কাটোয়া ডাঁটা কিনেছে। আমরা গুনতাম, এক-দুই করে কতজন ডাঁটা নিয়ে যাছে এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই গণনাকৃত সংখ্যা কারোরটা কারো সঙ্গে মিলত না। অতঃপর তর্কযুদ্ধ, আম্মুর বকা আর আমাদের পড়তে বসা। আম্মুর বকা না শুনে বোধ হয় আমরা কেনো দিনও পড়তে বসিনি, খাইনি, ঘুমুইনি।