গদ্য
কবিতার বর্ষা, বর্ষার কবিতা
ষঢ়ঋতুর এই বাংলাদেশে বর্ষা ঋতু প্রকৃতির মাঠে যেভাবে কিশোরী অবয়বসম লাবন্য নিয়ে জেগে ওঠে বার মাসের ষড়ঋতুর আর কোনোটিতেই এমনটি দেখা যায় না। যেমন দেখা যায় না বসন্তে তেমনি দেখে যায় না বর্ষায়। বসন্ত ও বর্ষা নিয়ে বাংলা সাহিত্যের লেখকরা যত রূপে লিখেছেন তা আর কোনো ঋতু নিয়ে ততটা লেখেননি। তার মধ্যে বর্ষা-ঋতু বাংলার কবিদের মন ও মননকে আন্দোলিত করেছে অনন্য এক আলোড়নে। যদিও বাংলা ভাষার কবিরা ‘গ্রীষ্ম বর্ষা শরৎ হেমন্ত শীত বসন্ত’ সব ঋতুর সব মাসের বিভা নিয়েই কবিতা লিখেছেন দুর্দম গতিতে তবু বর্ষার আবেদন নিবেদন অন্য যে কোনো ঋতুর চেয়ে অন্যরকম।
বর্ষায় কবি যেন নেচে ওঠেন ময়ূরীর মতো। কবি যেন পেখম মেলে লিখতে বসেন বর্ষার বৃষ্টি, মেঘ, আলো, অন্ধকার, জল, কাদা, মেঠোপথ, নদীর থৈ থৈ, নৌকোর ঘাট, বাড়ন্ত জল, মৃদু মৃদু ঢেউ। বাংলার কবি যেন বর্ষার আবেশ পেলে যুগের ঘুম ভেঙে জেগে ওঠেন অদম্য এক যৌবনে। দিনের পর দিন, রাতের পর জেগে প্রতিটি অণুক্ষণ ধারণ করেন মনের কোণে কোণে। দৃষ্টির কোটরে। তারপর শব্দে বাক্যে পয়ারে-নানা ছন্দ তালে-রূপ রস গন্ধ মিলিয়ে ব্যক্ত করেন দৃষ্টিগত রূপের বৈচিত্র্য। বর্ষার রূপ যেন কবিকে মাতিয়ে তোলে শব্দের এক অনন্য নৃত্যকলায়।
বর্ষা তার রিনিঝিনি শব্দে প্রকৃতির মনকে কখনো আনন্দে সিক্ত করে, কখনো বেদনা রিক্ত করে আবার কখনো বিরহকাতরতায় মূক করে তোলে অনায়াসে। প্রকৃতির সে ভাব কবি অবলোকন করেন একচোখে, তারপর সে ভাব ভর করে কবির সরল মানসপটে। সেখান থেকে কবি তা তুলে আনেন কলমের কালিতে। প্রকৃতি কবিকে যেভাবে প্রেরণ করে তার গন্ধ কবি সেভাবেই তা ছড়িয়ে দেন কালো অক্ষরে। আনন্দ যেন আর ধরে না! কবি এ-বেলা বৃষ্টির ফুল কুড়ান তো ও-বেলা মেঘের মালা গাঁথেন। ও-বেলা মেঘের মালা তো পরের বেলা ঝড়ের তোড়ে ছিন্ন মালার বেদনায় নীল হয়ে কুঁকড়ে হাঁটেন। সামান্য পরই আবার উঁকি দেওয়া সূর্য কবিকে নিয়ে চলে যায় ঝিলের কাছে, বিলের কাছে, ঘাঁটের কাছে, গ্রাম্য বধূয়ার কলসির কাছে, কবি যেন সে রূপে বিমোহিত হয়ে ফেটে পড়েন অট্ট হাস্যে, ভুলে যান ঘরদোর, বিগত বেদনার লেন-দেন। আর তাকেই উপমা করে কবি রচনা করেন মনের অমৃত সুধা।
বর্ষা ঘিরে এ সুধা রচনার আনন্দ থেকে ফিরে থাকতে পারেননি আদিযুগ থেকে মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক, আধুনিক থেকে সময়ের কোনো কবিই। সব যুগে সব সময়ে বর্ষা তার অপরূপ রূপের ছুরি নিয়ে হানা দিয়েছে প্রেমিক কবির মনে। কবিরাও অপরূপ রূপের দেবী বর্ষার ছুরিতে খুন হতে চেয়েছেন বারবার।
কালিদাস ‘মেঘদূত’ কবিতায় পর্বতের ওপারে নির্বাসিত শূন্য ও একাকী জীবনে ‘মেঘ’কে দূত করে পাঠিয়েছেন প্রিয়ার কাছে। চণ্ডিদাস বর্ষাকে হিসাব করেছেন প্রেমোবহ্নিতে ঘৃত হৃদয়ের পোড়া ছাইয়ের অনুষঙ্গ করে। বিরহ কাতরতা প্রকাশ করেছেন মেঘের ঘনকালো রূপের সঙ্গে তুলনা করে। তিনি লিখেছেন :
‘এঘোর রজনী মেঘের ঘটা কেমনে আইল বাটে
আঙিনার মাঝে বধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরাণ ফাটে।’
চণ্ডিদাসের এ বিরহবিধূরতা বর্ষার ঘন মেঘের মতো বেজে উঠেছে তার হৃদয়মমে। প্রেমিকার জন্য হাহাকার করা অন্তর কেঁদে কেঁদে অস্থির যখন তখন কবি আর কিছুর সঙ্গে তুলনা করে তা প্রকাশের অবকাশ খুঁজে পাননি। প্রখর দৃষ্টি দিয়ে দেখা বর্ষার কৃষ্ণ মেঘকেই তার মনে হয়েছে উপযুক্ত ভাবসঙ্গ। বর্ষায় যখন আকাশে মেঘ জমে, মেঘে মেঘে ছেয়ে যায় দিক দিগন্ত, কালো অন্ধকার হয়ে নেমে আসে আঙিনায়, তখন ঠিক যেন বেদনার মতো বিমূঢ় হয়ে থাকে প্রকৃতি। আর তার মতোই প্রেয়সীর জন্য ভারাক্রান্ত মনও বিমূঢ় হয়ে থাকে বেলা-অবেলা। বর্ষার রূপ আর মানবের মন যেন পরিপূরক। চণ্ডিদাসের মতো পঞ্চদশ শতকের মৈথলী কবি বিদ্যাপতির রচনায়ও বিরহ বেদনা কম নয়। বিদ্যাপতিও যেন বর্ষার মেঘের মাঝেই পেয়েছেন মনের খোরাক। পেয়েছেন বেদনাকে উজাড় করার মতো সঙ্গ। বুকের ভেতরে আগলে রাখা যাতনাকে তাই প্রকাশ করেছেন ভরা ভাদরের বেদনার্ত রূপের সঙ্গে মিল করে :
‘এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর- এ ভরা ভাদর মাহ বাদর
শূন্য মন্দিরও মোর।’
মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় বর্ষা আবার ধরা দিয়েছে প্রকৃতির অপরূপ শক্তি হিসেবে। তাঁর কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তার সঙ্গে দেবতারাও ঘোষণা করেছেন একাত্মতা। ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বর্ষার রূপকে ভাবনার তুলিতে বর্ণনা করেছেন এভাবে :
‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর উথলিল নদ-নদী ধরনীর উপর
রমণী রমন লয়ে সুখে কেলি করে দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অনন্তরে।’
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বর্ষাকে আর একবাঁকে দেখেননি। বহুবাঁকে বহুপাকে বর্ষা দেখেছেন তিনি। উপস্থাপন করেছেন বিভিন্ন আঙ্গিকে। রবীন্দ্রনাথই যেন কবিতার মাধ্যমে বর্ষাকে পূর্ণতা দিলেন। তাই তাঁর কবিতায় বর্ষার বিচিত্র রূপ প্রকাশ পায় বন্দনারূপে। আকাশ ঘনকালো করে গুরুগুরু গর্জনে বৃষ্টির অবিরাম ধারা নেমে এলে কবি যেন ফিরে যান তাঁর শৈশব-কৈশোরের দিনগুলোতে। তখনই তাঁর কবিতায় (বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর) ঝরে পড়ে স্মৃতিকাতরতার বৃষ্টি :
‘দিনের আলো নিবে এল,
সুয্যি ডোবে-ডোবে।
আকাশ ঘিরে মেঘ জুটেছে
চাঁদের লোভে লোভে।
মেঘের উপর মেঘ করেছে
রঙের উপর রঙ,
মন্দিরেতে কাঁসর ঘণ্টা
বাজল ঠঙ ঠঙ।
ওপারেতে বৃষ্টি এল,
ঝাপসা গাছপালা
এ পারেতে মেঘের মাথায়
একশ মানিক জ্বালা।
বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে
ছেলে বেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদে এল বান।’
আবার তিনি এ বর্ষাকেই বেছে নিয়েছেন প্রেমিকাকে প্রেম সম্বোধনের উত্তম সময় হিসেবে। বর্ষার বারিধারায় অধিক ব্যাকুল হয়ে আবেগতাড়িত কবি-মন (‘বর্ষার দিনে’ কবিতায়) বলেছেন :
‘এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘোর বরিষায়-
এমন মেঘস্বরে বাদল-ঝরঝরে
তপনহীন ঘন তমসায়।
সে কথা শুনিবে না কেহ আর,
নিভৃত নির্জন চারিধার।
দুজনে মুখোমুখো গভীর দুখে দুখি,
আকাশে জল ঝরে অনিবার-
জগতে কেহ যেন নাহি আর।
সমাজ সংসার মিছে সব,
মিছে এ জীবনের কলরব।
কেবল আঁখি দিয়ে আঁখির সুধা পিয়ে
হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব-
আঁধারে মিশে গেছে আর সব।’
বর্ষার ঘনঘটায় কবি রবীন্দ্রনাথ যুগপৎ আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছেন। বৃষ্টি দেখে তিনি যেমন পুলকিত হয়েছেন তেমনি মেঘের ঘনঘোর দেখে শঙ্কিত হয়েছে। এ কারণেই রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় বর্ষা ফিরে এসেছে বারবার- বহু কবিতায় বিভিন্ন আঙ্গিকে, সৌন্দর্যে-সৌকর্যে। তাই অনেকেই রবীন্দ্রনাথকে বর্ষার কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তাই বলে বিদ্রোহী খ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলাম আগুনের কবিতাই লেখেননি তাঁকেও প্রভাবিত করেছে বর্ষা। তাঁর কবিতায়ও বর্ষা ধরা দিয়েছে নানা প্রতীকী ব্যঞ্জনায়। ‘বর্ষা বিদায়’ কবিতায় নজরুল গেয়েছেন :
‘যেথা যাও তব মুখর পায়ের বরষা নূপুর খুলি
চলিতে চলিতে চমকে ওঠ না কবরী ওঠে না দুলি
যেথা রবে তুমি ধেয়ানমগ্ন তাপসিদী অচপল
তোমায় আশায় কাঁদিবে ধরায়, তেমনি ফটিক জল।’
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি, প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বর্ষাকে এড়িয়ে যাননি। বাংলা ভাষার শুদ্ধতম এ কবির কবিতায় বর্ষা এসেছে আরো কাছ ঘেঁষে। ‘এ জল ভালো লাগে’ কবিতায় কবি বলেছেন :
‘এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে
ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল- চোখের উপরে
তার শান-স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, আবেগের ভরে
ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে;
এই জল ভালো লাগে; নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে
ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে- বনের ভিতর
বার বার উড়ে যায়, তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে
আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে...’
পল্লী কবি জসিমউদ্দীনের কবিতায় বর্ষা এসেছে আরেক রকম ব্যঞ্জনা হয়ে। তিনি উদাস হয়ে দেখেছেন বর্ষার রূপ। সে রূপে এমনই ব্যাকুল হয়েছেন যে তিনি কোনো পথ আর খুঁজে পান না, সব পথই আনন্দে ভরপুর :
‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে
বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলো কেশ, মন যেন চায় কারে।’
‘পল্লী-বর্ষা’ কবিতায় কবি বর্ষার অবিশ্রান্ত বর্ষণমুখর গ্রাম-বাংলার ঘরে ঘরে যে আড্ডার আসর বসে, ফাঁকে ফাঁকে পল্লী বাংলার শ্রমজীবী মানুষের অসমাপ্ত কাজগুলোও যে আড্ডার ছলে সারা হয়ে যায় সেই কিচ্ছা কাহিনী শোনার যে লোকায়ত চিত্র তা তুলে ধরা হয়েছে উক্ত কবিতায়-
‘গাঁয়ের চাষীরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়
গল্প গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!
কেউ বসে বসে কাখারী চাঁচিছে, কেউ পাকাইছে রশি;
কেফবা নতুন দোয়াড়ীর গায়ে চাকা বাঁধে কষি কষি।
মাঝখানে বসে গাঁয়ের বৃদ্ধ, করুণ ভাটীর সুরে
আমির সাধুর কাহিনী কহিছে সারাটি দলিজা জুড়ে।
বাহিরে নাচিছে ঝর ঝর জল, গুরু মেঘ ডাকে,
এসবের মাঝে রূপ-কথা যেন আর রূপ আঁকে।’
‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ ফররুখ আহমদ অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অনুপ্রেরণায় ইসলামী ভাবধারার বাহক হলেও তাঁর কবিতায়ও বর্ষার দোল লেগেছে। বৃষ্টির ছন্দ তাঁকে নাচিয়েছে। মনে আনন্দের ঢেউ খেলিয়েছে। তিনি আনন্দে তবলার ছন্দের মতো ‘বৃষ্টির গান’-এ গেঁথেছেন :
‘বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথায় রে
লুকিয়ে গেলো বাঁশবনে।
নদীতে নাই খেয়া যে
ডাকলো দূরে দেয়া যে
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটলো আবার কেয়া যে।’
এদিকে কবি শামসুর রাহমানের কবিতায় শুধু যুদ্ধ, স্বাধীনতা, বিজয়, প্রেমই আসেনি, বর্ষাও এসেছে। তাঁর মানসপটে রাইফেল, বেয়োনেট, জলপাই রঙের ট্যাংকই খেলা করেনি কেবল। কবিকেও বুদ করেছে বৃষ্টি। বৃষ্টির জন্য কবি অপেক্ষায় থেকেছেন যেমন মানবহৃদয় অপেক্ষায় থাকে প্রেমিকার জন্য। বর্ষাকে কবি দেখতে চেয়েছেন সবকিছু ছেড়ে ভালোলাগার স্পর্শ করে। তাই তো চাষির মতোই তিনিও বর্ষাকে প্রার্থনা করেছেন :
টেবিলে রয়েছি ঝুঁকে, আমিও চাষীর মতো বড়
ব্যগ্র হয়ে চেয়ে আছি খাতার পাতায়, যদি জড়ো
হয় মেঘ, যদি ঝরে ফুল, বৃষ্টি। অলস পেন্সিল
হাতে, বকমার্কা। পাতা জোড়া আকাশের খাঁ খাঁ নীল।’ (কবিতা : অনাবৃষ্টি)
কবি আল মাহমুদ বর্ষাকে দেখেছেন অন্য এক দৃষ্টিতে। তাঁর কবিতায় বর্ষা-প্রকৃতি অন্যমাত্রার এক কথা বলে। ‘আষাঢ়ের রাত্রে’ তিনি ব্যক্ত করেছেন :
‘শুধু দিগন্ত বিস্তৃত বৃষ্টি ঝরে যায়, শেওলা পিছল
আমাদের গরিয়ান গ্রহটির গায়।’’
নির্মলেন্দু গুণ বর্ষার মেঘ আর বৃষ্টি দুটিকেই ধারণ করেছেন বোধের ভেতর। চাকুর এপিঠ ওপিঠের মতো ব্যবহার করেছেন জাগ্রত প্রতিবাদে, অন্যানের শাই শাই চাবুক রূপে। বর্ষাকে উপমা করেছেন রক্তকণ্ঠের প্রতিনিধি হিসেবে :
‘আমি কতো ভালোবাসা দু’পায়ে মাড়িয়ে অবশেষে,
কল্পনা মেঘোলোক ছেড়ে পৌঁছেছি বাস্তব মেঘে।
আজ রাত বৃষ্টি হবে মানুষের চিরকাম্য দাবির ভিতরে।’ (কবিতা : বউ)
সৈয়দ শামসুল হক বর্ষার বৃষ্টিকে পবিত্র এক জলফোয়ারা রূপে দেখেছেন। বৃষ্টিতে ধৌত হলে পৃথিবীর আর কোনো জলে ধৌত হওয়ার প্রয়োজন নেই বলেই বর্ষার এ বৃষ্টিতে ভেজা ঘরে প্রাণের স্বদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন।
‘তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ,
তুমি ফিরে এসেছ তোমার বৃষ্টিভেজা খড়ের কুটিরে
যার ছায়ায় কত দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে সন্তান এবং স্বপ্ন;’ (কবিতা : তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ)
হুমায়ূন আহমেদের বর্ষা লোভের কথা কে না জানে। সমুদ্রের কাছে গেলে এই গীতকবি যেমন হুলুস্থূল মার্কা পাগল হয়ে যেতেন তেমন মাতাল হয়ে যেতেন বর্ষার বৃষ্টি দেখে। আকাশ ডাক দিয়ে বৃষ্টি নামতে দেরি হতো- বাড়ির উঠোনে নামতে দেরি হতো না বিন্দু মাত্র তাঁর। যে প্রিয়াকে ভালোবাসতেন প্রাণধিক সে প্রিয়তমাকে তাই তিনি অন্য কোনো ঋতুতে নয়, বর্ষা ঋতুতেই আসতে বলেছেন, যদি তাঁকে মনে পরে-
‘যদি মন কাঁদে
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে
জল ভরা দৃষ্টিতে
এসো কোমল শ্যামল ছায়।
যদিও তখন আকাশ রবে বৈরী
কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি।
উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো
ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আলো।
তুমি চলে এসো, চলে এসো
এক বরষায়।’ (গীতকবিতা : যদি মন কাঁদে)
ঘন মেঘ যখন দলবেঁধে আকাশে উড়ে বেড়ায়, সে মেঘের সাথে কবির ভাবপ্রবণ মনও কল্পনার জগতে উড়তে থাকে। তখন সরল মানুষের মতো কবির মনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনাগুলো যেন মনের জলছবি হয়ে ওঠে মেঘের শরীরে। সত্তর দশকের প্রথিতযশা কবি মোহাম্মদ নূরুল হুদা তাঁর ‘বৃষ্টি পড়ে’ কবিতায় বর্ষাকে প্রকাশ করেছেন নানা আঙ্গিকে।
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে মনে মনে বৃষ্টি পড়ে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে বনে বনে বৃষ্টি পড়ে
মনের ঘরে চরের বনে নিখিল নিঝুম গাঁও গেরামে
বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে বৃষ্টি পড়ে।’
কান্নার কবি মহাদেব সাহা। বর্ষা যেমন আষাঢ় শ্রাবণ শুধু কাঁদে আর কাঁদে। পাঁচটি ঋতুর সমস্ত বেদনা নিয়ে যেমন বর্ষা এসে হাজির হয় প্রকৃতির উঠোনে। তেমনি কবি মহাদেব সাহা বর্ষার বৃষ্টি কান্নাকে সারা জীবন যেন ধরে রাখলেন তাঁর ভাবের মলাটে। বর্ষা না থাকলে কবি কী করে তাঁর কান্নাকে উপমা করতেন তাই বড় প্রশ্ন হয়ে বাজে। একটা জীবন কবির কাছে পুরোটাই যেন বর্ষার মেঘের মতো :
‘এই যে জীবন উজাড় করে বর্ষার মেঘের মতো
তোমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছি
তুমি কখনোই তার কিছু অনুভব করলে না;
তুমি বুঝলে না এই সহস্র সহস্র চুম্বনের ব্যাকুলতা নিয়ে
আমি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি,
তোমাকে ভিজিয়ে দেওয়ার জন্য হাজার বছর ধরে
আমি মেঘ হয়েছি সমুদ্রে,
লক্ষ লক্ষ শীতরাত্রি ভেদ করে তোমার জন্য ফুটেছি গোলাপ;
তুমি বুঝলে না আমি কতকাল এই বর্ষা হয়ে আছি,
মেঘে মেঘে মল্লার হয়ে আছি তোমার জন্য
একবিন্দু অশ্রু হয়ে আছি সমস্ত প্রেমিকের চোখে।’ (আমার বর্ষাকে উপমা করে)
বৃষ্টিকে আনন্দ বা বেদনার রূপে না দেখে কবি অসীম সাহা দেখেছেন করুণ রূপে। ভয়ের চোখে তাকিয়েছেন বর্ষার এই ধারার দিকে। প্রিয় নারী মাধবীকে তাই বারণ করা- যেন ঝরঝর দিনে বাহিরে না বেরোয়। মাধবীর জন্য কবির মনে কান্না- বর্ষার রূপ, বৃষ্টি কান্নার মতোই :
‘ঢাকার আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন, মাধবী এখন তুমি বাইরে যেও না
এই করুণ বৃষ্টিতে তুমি ভিজে গেলে বড়ো ম্লান হয়ে যাবে তোমার শরীর
মাধবী বৃষ্টিতে তুমি বাইরে যেও না। মাধবী তুষারপাতে
বাইরে যেও না।’ (শহরে, এই বৃষ্টিতে)
সুফিয়া কামাল , রফিক আজাদ, আহমদ রফিক, অমিয়সহ ওপার বাংলার বাঙালি কবি কেউই বর্ষার বন্দনা থেকে বিরত থাকতে পারেননি। পাওয়া যাবে না এমন একজন কবি যে তাঁর কবিদশায় বর্ষা নিয়ে একটি পয়ার লেখেননি, বর্ষাকে উপমা করে লেখেননি একটি ছত্র।
শেষে রবীন্দ্রনাথের কাছেই ফেরা যাক। এক বর্ষামুখর দিনে শিলাইদহে বসে রবীন্দ্রনাথ তাঁর স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে এক চিঠিতে লিখলেন- ‘সমস্ত আকাশ অন্ধকার করে নিবিড় হয়ে জমে এসে বৃষ্টি আরম্ভ হল- আমার নীচের ঘরের চারদিকে শার্সি বন্ধ করে বসে বসে ‘মেঘদূত’র উপর প্রবন্ধ লিখছি। প্রবন্ধের উপর আজকের এই নিবিড় বর্ষার দিনের বর্ষণমুখর ঘনান্ধকারটুকু যদি এঁকে রাখতে পারতুম, যদি আমার শিলাইদহের সবুজ ক্ষেতের উপরকার এই শ্যামল আবির্ভাবটিকে পাঠকদের কাছে চিরকালের জিনিস করে রাখতে পারতুম তাহলে কেমন হত! কি অনায়াসেই জল স্থল আকাশের উপর এই নির্জন মাঠের নিভৃত বর্ষার দিনটি। এই কাজকর্ম ছাড়াই মেঘে ঢাকা আষাড়ের রৌদ্র মধ্যাহ্নটুকু ঘনিয়ে এসেছে।
অথচ আমার লেখার মধ্যে তার কোন চিহ্নই রাখকে পারলুম না। কেউ জানতে পারবে না কোনদিন- কোথায় বসে বসে সুদীর্ঘ অবসরের বেলায়- লোকশূন্য বাড়ীতে এই কথাগুলো আমি আপন মনে গাঁথছিলুম।”
রবীন্দ্রনাথ লেখায় মনের মতো করে বর্ষার রূপ আঁকতে, তাকে চিরকালের ‘জিনিস’ করতে পারলেন না বলে চিঠিতে স্ত্রীর কাছে দুঃখ করেছেন। আক্ষেপের এই চিঠিতেই বর্ষার কী গভীর রূপ তাড়না করেছে কবিকে তা অনুমান করা যায়।
রবীন্দ্রনাথের মতো সব যুগের সব কবির বর্ষা বিষয়ক কবিতা, বর্ষাকে বিষয় করে কবিতা, বর্ষাকে উপমা করে কবিতাই প্রকাশ করে বর্ষা ঋতু বাংলার, বাংলা ভাষার কবিদের কীভাবে প্রভাবিত করেছে। রূপে রসে কীভাবে বিমোহিত করেছে কবির ভাবনার সৃষ্টি জগৎকে। সব কালের সব কবির কাছে বাংলার বর্ষা ঋতু রবীন্দ্রনাথের মতের মতো ‘চিরকালের জিনিস’ হয়েই রইল যেন।
চিরকালই কবিদের বর্ষাবন্দনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে এই বর্ষার মোহিনী রূপ। ব্যক্ত হয়েছে অনেক- অব্যক্ত রয়ে গেছে আরো বেশি। গহন বর্ষার সজল কালো মেঘবৃষ্টি ভেজা ভুঁইচাপা, কামিনী আর দোলনচাঁপার গন্ধ মনে যে অনির্বচনীয় আনন্দ সঞ্চারণ করে- ভাষার সাধ্য কি পৌঁছায় সেখানে! মেঘমেদুর বর্ষার রং রূপ রস গন্ধ মানুষ ভালোবেসেছে অনন্ত কাল। আর যুগে যুগে কবিরা সে ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন তাঁদের কবিতায়। বর্ষা বন্দনায়।