হুমায়ুন আজাদ স্মরণ
বাবার মৃত্যুদিবস
১৩ আগস্ট ২০০৪। খুব সকালেই সেদিন আমার ঘুম ভাঙে। সকাল থেকেই কেন যেন ভীষণ অস্বস্তি কাজ করতে থাকে আমার মধ্যে। তাই বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। চারপাশে শুনতে পাই কাকের তারস্বরে চিৎকার। বিরক্তি নিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি। হঠাৎ জানতে পারি, বাসায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির শিক্ষকদের সঙ্গে জার্মান এমবাসির কয়েকজন কর্মকর্তা আমাদের পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। শুনে আমি বেশ খুশি হই। সকালের অস্বস্তি অনেকটাই কাটে যেন। খুশি হই এই ভেবে যে, তাঁদের কাছ থেকে জার্মানিতে অবস্থানরত আব্বার কথা জানতে পারব, তাই।
পরক্ষণেই মনে খচ করে ওঠে, সবাই একসঙ্গে আমাদের বাসায় আসছেন, আবার অন্য কিছু না তো? মা-ই বৈঠকখানায় বসে তাঁদের সঙ্গে বাবার বিষয়ে নানা আলাপ করতে থাকেন। আমি অতশত না ভেবে অতিথিদের জন্য চা বানাতে রান্নাঘরে চলে যাই। চা বানাতে খুব বেশি মন দিতে পারি না। কারণ, বৈঠকখানায় আলাপেই যে আমার মন পড়ে থাকে। ঝড়ের গতিতে চা বানিয়ে ট্রে হাতে ড্রয়িংরুমের দরজার কাছে পৌঁছানোমাত্র জার্মান এমবাসির এক কর্মকর্তার কথা কানে ভেসে আসে। ‘আসলে... আসলে... স্যারের তো ২৭ ফেব্রুয়ারির রাতে অ্যাটাকের পর এটা ছিল সেকেন্ড লাইফ... তাই স্যার আর।’ তাঁর মুখে আর কোনো কথা নেই।
ড্রয়িংরুমজুড়ে কবরের নিস্তব্ধতা। শুধু মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। আমার আর চায়ের পেয়ালা হাতে বৈঠকখানায় ঢোকা হয় না। আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে যেন। নিজেন কানকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না কোনোভাবে। বারবার মনে হচ্ছিল, বোধ হয় ভুল শুনছি। কিন্তু ততক্ষণে যে পুরো বাংলাদেশে খবর হয়ে গেছে, তিনি আর নেই।
মা চিৎকার দিয়ে কেঁদে চলেছেন। আমি যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। না পারছিলাম কাঁদতে, না পারছিলাম তাঁকে সান্ত্বনা দিতে। শুধু দেখলাম, বাসা ভরে যাচ্ছে মানুষে। বেশির ভাগই দেখলাম, আমাদের তিন ভাইবোনের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। কারণ, বাবা বই ছাড়া আর কোনো বিষয়-সম্পত্তি আমাদের জন্য রেখে যাননি। কেউ কেউ তাঁর মৃত্যুরহস্য উদঘাটনেও ব্যস্ত ছিলেন সে সময়। আমাদের পুরো পরিবারটা যেন মুহূর্তেই তছনছ হয়ে যায়। এরই মধ্যে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য একবার জার্মান এমবাসির কাছে, একবার তৎকালীন সরকারের কাছে, আবার কখনো বা ঢাবির শিক্ষক সমিতির কাছে শুরু হলো আমাদের ছোটাছুটি। দেশে তাঁর লাশ যাতে না আসতে পারে, সে জন্যও বিভিন্ন দিক থেকে চলতে লাগল ষড়যন্ত্র। বুঝতে পারলাম, মৃত হুমায়ুন আজাদও অনেকের জন্য ভয়ের কারণ। জার্মানি থেকে দেশে লাশ বহনের জন্য যে অনেক টাকার দরকার। তাই বাবার ভক্তরাসহ অনেককেই দেখলাম টাকা সংগ্রহে ব্যস্ত হতে। এই প্রথম শোক ঝেড়ে মাকে উঠতে দেখলাম। মা বললেন, হুমায়ুন আজাদ অর্থ-সম্পদশালী ছিলেন না সত্য, কিন্তু তাই বলে তাঁর (মা তাঁকে লাশ বলতে পারেননি) দেশে ফিরতে ভিক্ষা করতে হবে, তা নিশ্চয়ই নয়। নিজেই এমবাসিতে টাকা পাঠালেন। ২৭ আগস্ট (মৃত্যুর ১৫ দিন পর) এক বৃষ্টিভেজা সকালে তিনি বাংলাদেশ বিমানে চেপে সুসজ্জিত কাঠের বাক্সে বন্দি হয়ে ফিরলেন। এই প্রথমবার তিনি এয়ারপোর্টে নিথরভাবে ফিরলেন। চারপাশের কোলাহল তাঁকে জাগাতে পারল না। পারলেন না সাংবাদিকদের স্বভাবসুলভ তির্যক উত্তর দিতে।
বাবার ইচ্ছা ছিল, সন্ধানীতে মরণোত্তর চোখ দান করার। কিন্তু এখানেও বিধি বাম। মৃত্যুর এত দিন পর দেশে ফিরে আসায় তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী সন্ধানীতে তাঁর চোখ দান করতে পারলাম না। সে সঙ্গে ডাক্তাররা অভিমত দিলেন, এই ডেডবডি হসপিটালের কাজেও এখন ব্যবহার যোগ্য নয়। তাঁর শেষ ইচ্ছাগুলো পূরণ না করতে পারায় এতটা অসহায় লাগছিল যে তা বলার মতো নয়। সে সময় বাবার ভক্তরা বলতে লাগলেন, ‘আমরা স্যারের সমাধি চাই।’ কারণ, যখন আমাদের তাঁকে প্রবলভাবে মনে পড়বে, তখনই ছুটে যেতে পারব তিন হাত সে জায়গাটির কাছে। ভেবে দেখলাম তাই তো?
আমরা চেয়েছিলাম, তাঁর মতো একজন বিখ্যাত লেখক ও শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের শেষ শয্যা যেন হয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটানোর স্থানে, অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। কিন্তু সে ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষ তাঁর প্রতি সদয় হলো না। তাই তাঁর শেষ শয্যার বিষয়ে আর দ্বিতীয় কোনো চিন্তা আমরা মাথায় নিইনি। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত হলো, রাড়িখাল গ্রামের সোনার মাটিই হবে তাঁর শেষ শয্যার স্থান (রাড়িখাল তাঁর বুকের ভেতর নিবিড় শ্রাবণধারার মতই যে ছিল)।
গাড়ির বহরসহ তাঁকে নিয়ে রাড়িখাল পৌঁছলাম। হাজার হাজার মানুষ শামিল হলেন তাঁর জানাজায়। জানাজার পর তাঁকে শুইয়ে দিলাম তাঁর বাড়ির আঙিনায়। মাটির নিচে চাপা পড়ে গেলেন তিনি আর জীবনে শেষবারের মতো তাঁকে দেখলাম।
একের পর এক কেবল বাবাকে নিয়ে আমার চোখের সামনে ভেসে আসছিল নানা ঘটনা। এতটা স্পষ্টভাবে সব দেখতে পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল এই তো সেদিনের ঘটনা। কিন্তু ক্যালেন্ডারের পাতা মনে করিয়ে দিল, এরই মধ্যে বয়ে গেছে একে একে ১২টি বছর। অদ্ভুত মনে হয়। জীবিত অবস্থায় তাঁর অনুপস্থিতির কথা মনে হলে চিন্তায় হয়ে যেতাম নীল, আর আজ ১২টি বছর তাঁকে ছাড়াই কাটিয়ে দিলাম এবং হয়তো এভাবেই কেটে যাবে আরো কয়েক যুগ।
আজ বারবার মনে পড়ছে তাঁরই লেখা কবিতার লাইন, ‘দুদিন ধরে দেখা নেই, দুশো বছরেও আর দেখা হবে না।’ সত্যি বাবা, আমাদের আর কখনো দেখা হবে না। তোমার ভক্ত-পাঠকদের মধ্যে তোমার লেখা বইগুলোই সারা জীবন তোমার চিন্তাধারা বয়ে নিয়ে যাবে সত্য। আমিও তাই বহন করার চেষ্টা করব। কিন্তু তোমার সন্তানরা যে তোমাকে আর দেখতে পায় না, সে কষ্ট হয়তো কেউ কোনোদিনও বুঝে উঠতে পারবে না।
তোমার মৃত্যুবার্ষিকীতে তোমার প্রতি অপরিসীম শ্রদ্ধা রইল।