শহীদ কাদরী
পরবাসে বাংলার জ্যোৎস্না
হে মেঘ! হে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ। তুমিও ঠকাবে নাকি
হে নিরুদ্দেশগামী?
কাউকে বিশ্বাস নেই আর এই বিরূপ বিদেশে।
তবু বলি : যদি পারো,
হে নন্দিত মেঘ তুমি নেমে এসো
ঘন ও নিবিড় হয়ে, করুণা ধারায় নেমে এসো
শ্রাবণে শ্রাবণে তুমি, হে বন্ধু স্পন্দিত করে দাও
এই অফুরান পরবাস।
(প্রবাসের পঙক্তিমালা / আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও)
সত্যি, এক অফুরান পরবাসযাপনে জীবন অতিবাহিত করছেন শহীদ কাদরী; বাংলা কবিতার বিরল কবি শহীদ কাদরী। সেই যে ১৯৭৮ সালের এক বিষণ্ণ প্রহরে তিনি স্বদেশ ছেড়েছেন; সেই থেকেই বিদেশই তাঁর দেশ হয়ে উঠেছে। মাত্র এক বছরের নির্বাসনে কালিদাসের যক্ষ বিরহকাতর হয়ে মেঘকে দূত করে পাঠিয়েছিলেন স্বভূমি অলকাপুরীতে। আর প্রায় তিরিশ পরবাসযাপনের পরে সেই মেঘকে অনুষঙ্গ করে শহীদ কাদরী লিখলেন ‘প্রবাসের পঙক্তিমালা’। ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ নামক কাব্যের মোড়কে পরবাসে থাকার কৈফিয়ত দিলেন; প্রবাসজীবনের যন্ত্রণাগুলো কবিতার মালা গেঁথে তুলে দিলেন পাঠকের হাত; এবং এ কথাও প্রকাশ করলেন যে ‘কোনো নির্বাসনই কাম্য নয়।’ বস্তুত, স্বদেশ থেকে প্রবাস যত উন্নত জায়গাই হোক না কেন, কোনো মানুষেরই তা বিশেষ কাম্য নয়; আর কবিরা তো স্বমাটির রূপ-রসে মুগ্ধ ও জারিত হয়েই তবে কবি। প্রবাস দীর্ঘ হলে কবিদের কাছে নির্বাসনই হয়। হয়তো হৃদয়বান প্রত্যেক মানুষের ক্ষেত্রেই কথাটি বিবেচ্য।
খুব তরুণ বয়সেই কবিতা লিখে শামসুর রাহমানের মতো মহান অগ্রজের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছিলেন শহীদ কাদরী। পেয়েছিলেন ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য। আরেক অগ্রজ আল মাহমুদও তাঁকে দিয়েছিলেন বন্ধুত্বের মর্যাদা। হাসান হাফিজুর রহমানের মতো পূর্বজ কবি-সমালোচকের কাছ থেকে অল্পেই আদায় করে নিয়েছিলেন কবি সম্মান। অথচ বাংলাদেশের যেকোনো কবি, অল্পকবি কিংবা অকবির তুলনায় তাঁর কবিতা ও কাব্যসংখ্যা শোচনীয়ভাবে অল্প। কবিতার সংখ্যাগত দিক থেকে কেবল তিরিশোত্তরকালের অন্যতম প্রধান কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্তের সঙ্গেই তাঁর তুলনা চলে। ১৯৬৭ সালে প্রথম কাব্য ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশের সাত বছর পর ১৯৭৪ সালে ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’; পাঁচ বছর পর তৃতীয় কাব্য ‘কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই’; এর তিন দশকের বেশি সময় পরে ২০০৯-এ মার্কিন প্রবাসে অবস্থানকালে প্রকাশিত হলো ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’। কাব্য প্রকাশে এমন দীর্ঘ বিরতি যে তুলনারহিতপ্রায়, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
২
কেবল চিত্রকরই নন, নন্দনশিল্পের সব শাখার লোকই ছবি আঁকেন। গল্পকার গল্পের মাধ্যমে, নাট্যকার নাটকের বরাত দিয়ে এবং কবি আঁকেন কবিতার পঙক্তিতে। সকলেই আসলে জীবনের ছবিই অঙ্কন করেন বা করার চেষ্টা করেন। এই ছবি আঁকার কাজে যিনি যত বেশি পারদর্শিতা বা অভিনবত্ব দেখাতে পারেন, তাঁকেই তত বড় জীবনশিল্পী হিসেবে সম্মান জানানো হয়। তবে অন্য যেকোনো শিল্পশ্রেণি অপেক্ষা কবিতায় ছবি আঁকাই সবচেয়ে অভিনব এবং আশ্চর্য অনুভূতিদায়ক। অতল গভীরতাস্পর্শীও বটে। বাংলাদেশের কবিতার এক পৌরুষদীপ্ত চরিত্র শহীদ কাদরী এ রকমই অভিনব ও আশ্চর্য অনুভূতিদায়ক কিছু কাব্যছবির স্রষ্টা; যিনি শহরে থেকেও বঙ্গ-নিসর্গকে কবিতা নির্মাণের অন্যতম অনুষঙ্গ করে তুলেছেন।
কাদরীর কবিতায় ছবির যে নান্দনিক উপস্থাপন চোখে পড়ে, মানসচক্ষে অপরূপ দোলা দেয় তার অপূর্ব রূপায়ণ গ্রন্থভুক্ত প্রথম কবিতাটিই। শহরের বুকে হঠাৎ বৃষ্টি নেমে এলে, বিদ্যুৎ চমকালে বা বজ্রপাত হলে যে চিত্র তৈরি হয়, তার অনুপম উপাখ্যান। অনিন্দ্য সব উপমা-চিত্রকল্পে ঠাসা কবিতাখানিতে দেখা যায় সন্ধ্যায় সহসা সন্ত্রাসে আক্রান্ত মানুষের মতো বৃষ্টি আক্রান্ত মানুষগুলো, কবির ভাষায় ‘ঝাঁকে ঝাঁকে লাল আরশোলার মতো দৌড়াচ্ছে’। এমন সময় সবাইকে ঘাবড়ে দিয়ে চমকে বিদ্যুৎ। কবির কলমে চিত্রায়িত হলো ভয়ংকরের নান্দনিক চিত্রকল্প, ‘সুগোল তিমির মতো আকাশের পেটে / বিদ্ধ হলো বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম’! লক্ষ লেদ মেশিনের শব্দ সৃষ্টিকারী এই বজ্রের আবির্ভাব, মেঘ, জল, হাওয়া সবকিছু মিলিয়ে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তাতে বিপদগ্রস্ত হয় ঘরদোর, ডানা মেলে দিতে চায় জানালা কপাট, শহরের প্রাচীন বাড়িটি যে টিরোনসিরসের মতোন নড়ে ওঠে! আর জল! ‘বিমর্ষ স্মৃতির ভার নিয়ে সহর্ষে সদলবলে/ বয়ে চলে জল পৌরসমিতির মিছিলের মতো নর্দমার ফোয়ারার দিকে’। বৃষ্টির জলের বয়ে চল দেখেছি আমরা, এমন মিছিলের মতো অনুভব করেছি ক’জন? আর সেই জলে, সিগারেট টিন, ভাঙা কাচ, সন্ধ্যার পত্রিকা, রঙিন বেলুন ইত্যাদি ভেসে যায় ঘুঙুরের মতো! কাদরীর কবিতায় বৃষ্টির ছবি মেলে বার বার; ভিন্ন ভিন্ন রূপে। ‘ভরা বর্ষায় : একজন লোক’ কবিতায় বৃষ্টি তার লম্বা আঙুল দিয়ে একজন লোককে হাতড়ে দেখে; তার স্বপ্নের দেয়ালে হলদে স্যাঁতসেঁতে চিত্র আঁকে। আর ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’র ‘ছুরি’ কবিতায় দেখি, ‘তীক্ষ্ণ ছুরির ফলার মতো চতুর্দিকে বৃষ্টি পড়ে’। বৃষ্টি আছে আরো দু-চারটি কবিতায়। কিন্তু বৃষ্টি নয়, শহীদ কাদরী জ্যোৎস্নারই পাঁড়ভক্ত। তাঁর বেশ কিছু কবিতায় জ্যোৎস্নারাতের তীব্র প্রভাব রয়েছে। আছে জ্যোৎস্নালোকের অপরূপ সব চিত্রমালা। ‘নশ্বর জ্যোৎস্নায়’ দেখা যায় কবি জ্যোৎস্নামুগ্ধ হয়ে চোখের বিষাদ বদলে নিয়ে, ‘হতাশারে নিঃশব্দে বকুল তলায়’ বিছিয়ে রাখতে চেয়েছেন। ভেবেছেন ভবিষ্যপ্রসারী এক অনিন্দ্য চিত্রকল্পরস, পরিত্যক্ত মূল্যবোধ, নতুন ফুলের কৌটাগুলো জ্বলজ্বলে মণির মতন সংখ্যাহীন জ্যোৎস্না ভরে নিয়ে নিঃশব্দে থাকবে ফুটে মধ্য-বিশ শতকের ক্লান্ত শিল্পের দিকে চেয়ে—
এইমতো নির্বোধ বিশ্বাস নিয়ে আমি
বসে আছি আজ রাত্রে বারান্দার হাতল-চেয়ারে
জ্যোৎস্নায় হাওয়ায়।
জ্যোৎস্নার, বিশেষত বঙ্গজ্যোৎস্না আর তার আধার চাঁদের সৌন্দর্য অপরূপ। এবং অপরূপ জ্যোৎস্না-চাঁদকে নিয়ে বাংলা কবিতায় লোফালুফিও হয়েছে অপরূপতায় অপরিমেয়। কত কবি যে তাকে কত ভঙ্গিতে রূপায়িত করেছেন, তার কোনো পরিসংখ্যান মেলানো ভার। আধুনিক কবিতায় চাঁদ তার চিরকালের নম্ররূপ পরিত্যাগ করে কখনো ‘কাস্তে’; কখনো আবার ‘ঝলসানো রুটি’রূপে ধরা দিয়েছেন। আরো পরে এসে ‘আত্মগোপনকারী রাজনৈতিক কর্মী’ কিংবা ‘ডাগর ক্ষতের মতো’ চিত্রায়িত হয়েছেন। কাদরীর কলমে এই চাঁদ ‘বাউলের একতারার মতো’ বেজে ওঠে; কখনো বাগানে ঝুলে থাকে ‘জবার মতো’ লাল হয়ে।
প্রেম নিঃসঙ্গতা ও বিষণ্ণতার কবিতা ‘সমকালীন জীবন দেবতার প্রতি’। এখানে উদ্দীষ্ট নারীটির অশ্রুর সঙ্গে সখ্য ঘটেছে চাঁদের। কবি বলেছেন, ‘এই ত’ সখ্য তোমার দিগন্তে গেঁথে দিল শুধু নির্বীজ কান্নার মতো একফোঁটা চাঁদ, অনুধ্যানে যার / জোটে না মাধুরীকণা মনে হয় নিঃশেষিত সকল গেলাস!’ এই কবিতাতেই আবার নারীকে ‘মাঝরাতের মন্ত্রে-তন্ত্রে ভরা চন্দ্রের’ মতন মনে হয়েছে। এ ছাড়া চাঁদের অনিন্দ্য অস্তিত্ব আছে বন্ধুকবি রফিক আজাদকে নিবেদিত ‘নিসর্গের নুন’ কবিতায়। তবে চাঁদ এখানে কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, ব্যতিক্রমী ঐতিহ্যেরও আধার। নিসর্গের কাছে অকপটে ঋণস্বীকারকারী কবি এই কবিতার শেষে বলেন :
ইচ্ছে ছিলো কেবল তোমার নুন খেয়ে আজীবন
গুণ গেয়ে যাবো
অথচ কদ্দিন পরে বারান্দা পেরিয়ে
দাঁড়িয়েছি ঝোপে
ধারালো বটির মতো কোপ মেরে
কেন যে, কেন যে
দ্বিখণ্ডিত করছে না
এখনও সুতীক্ষ্ণ বাঁকা
ঐ বঙ্গদেশীয় চাঁদ !
যদিও চাঁদই শেষ পর্যন্ত উক্ত কবিতায় প্রাধান্য পেয়েছে, তবু এ কথাও উল্লেখের দাবি রাখে যে, ‘নিসর্গের নুন’ কবিতাটিতে কেবল চাঁদ নয়, নিসর্গের অন্যান্য অনুষঙ্গও উঠে এসেছে অনন্য রূপময়তায়। তবে হ্যাঁ, নিসর্গের সে অনুষঙ্গসমূহ নয়, এই কবিতার আসল বিষয় কিন্তু কবিত্বের আত্মাভিমান। কাব্যময় বাংলা প্রকৃতির উদারতায় যেখানে অজস্র কবি পেয়েছেন অতুল সম্মান, এমনকি কোনো কোনো অনুজও; সেখানে অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রবাসে থাকা শহীদ কাদরী নিজেকে কিছুটা বঞ্চিত ভাবছেন; আত্মবঞ্চনাহেতু বাংলার প্রতি এক ধরনের বিদ্রূপও জেগেছে মনে।
‘চন্দ্রালোকে’ কবিতাখানি তো বিশল্যকরণীর অনিবার্যতা নিয়ে হাজির হয়েছে চাঁদ; হয়ে উঠেছে সুরলালিত প্রেম। অন্যদিকে অনন্য সৌন্দর্যনির্ভর চিত্রকল্পে ভরা কবিতা ‘নর্তকী’তে চাঁদকে দেখি নর্তকীর শরীরী সৌন্দর্যের উপমায়। তবে চাঁদকে নিয়ে অত্যন্ত রূঢ় অথচ অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যময় কবিতা ‘চন্দ্রাহত সাঙাৎ’। এর শুরুতেই কবি বলেন, ‘দ্যাখো, দ্যাখো, দ্যাখো হে সাঙাৎ/ কী ইৎরামি জানে অই চাঁদ/ অপেক্ষায় কল্কে জ্বলে গ্যালো, সাঁঝ-রাত / আইলো না উঁচু ঢিবি থেকে নেমে রূপার মোরগ’। চাঁদকে এমন অপূর্ব রুপার মোরগরূপে চিত্রায়িত করার অব্যবহিত পরে পুনরায় সেই চাঁদকে যখন কবির মনে হয়, ‘নোংরা জলে ভেসে এলে যেন পাতিহাঁস’, তখন অবাক না হয়ে পারা যায় না। কিন্তু এর ব্যাখ্যাও যেন দিয়ে দিতে চান কবি। বলেন, ‘আন্ধা যে সে বান্ধা পড়ে যায় এমন হঠাৎ/ কোকিলও মাঝেমধ্যে বনে যায় কাক’। তবু রোমান্টিক-এন্টিরোমান্টিক যেভাবেই দেখতে চান, চাঁদ ও চন্দ্রিমাই যে কবির আসল সাঙাৎ, সে কথাও স্বীকার করেন। চাঁদকে নিয়ে মাঝেমধ্যে অত্যন্ত নেতিবাচক চিত্র তৈরি করলেও চাঁদের আলো তথা জ্যোৎস্নাকে নিয়ে অত্যন্ত ইতি-আপ্লুত শহীদ কাদরী। প্রবল জ্যোৎস্নামুগ্ধ কবি ‘একবার দূর বাল্যকালে’ কবিতায় জ্যোৎস্নাকে নীরব-দূরস্থায়ী নৈসর্গিক সৌন্দর্য অপেক্ষা গৃহ ও গৃহস্থালি পরিবেশেই বেশি মানানসইরূপে অনুভব করেছেন। লিখেছেন :
জ্যোৎস্না শুধু ধ্যানমৌন পাহাড়ের চূড়ায় কোনো
ত্রিশূলদেহ একাকী দরবেশ কিম্বা হিমালয়ের পাদদেশে,
তরাই জঙ্গলের অন্ধকারে, ডোরাকাটা বাঘের হলুদ শরীর নয়,
বরং ছাদ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পোষমানা পায়রা যখন ওড়ে,
তখনও জন্মায় জ্যোৎস্না: ঝরে পড়ে গৃহস্থের সরল উদ্যানে।
দেখেছেন,
জ্যোৎস্নার জ্বলজ্বলে লাবণ্য
আজীবন খুচরো পয়সার মতো পার্কে, ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে থাকে।
কী নান্দনিক জ্যোৎস্না কাব্যচিত্রায়ণ! প্রকৃতপ্রস্তাবে, শহীদ কাদরীর কবিতায় জ্যোৎস্না সর্বপ্লাবী। ক্যাপটেনের বুটের ভেতরেও সে কুণ্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে থাকে; মানবশরীর থেকে বের হওয়া যে বর্জ্য, সেই পরিত্যক্ত প্রস্রাবও ঝলমল করে জ্যোৎস্না মেখে! কোথাও আবার শিশিরের টলটলে ফোঁটার ভেতর জ্যোৎস্না হয়ে ওঠে করোগেট শিট। কাদরী যখন বলেন, ‘রাত্রে গাছের পাতায় আর ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে / খুচরো পয়সার মতো ছড়ানো জ্যোৎস্নারাজি দেখে / ভিক্ষুকের মতো বারবার আমিও দাঁড়িয়েছি / হাতের রুক্ষ তালু প্রসারিত করে’। তখন অনুভব করা যায় কী ব্যাপক জ্যোৎস্নাবুভূক্ষু তিনি! আর যখন বলেন, ‘মেধার চেয়েও মেধাবী জেনেছি জ্যোৎস্নাকে’; তখন বুঝতে বাকি থাকে না যে, জ্যোৎস্না কবির কাছে কেবল সৌন্দর্যে সীমানায় প্রস্ফুটিত কোনো কুসুমমাত্র নয়, জ্যোৎস্নাকে কবি অন্য অনেক বস্তু বা প্রাণের প্রকৃতি স্বরূপ এবং রূপ-রহস্য আবিষ্কারের পাথেয় হিসেবে ব্যবহার করেছেন। টেলিফোনের ও প্রান্তে কোনো নারী কণ্ঠ শুনে প্রথম যৌবনে যখন কবি বলেন, ‘কী জ্যোৎস্না কণ্ঠস্বরে!’ তখন জ্যোৎস্না আর আকাশের কার্নিশে ঝুলন্ত চাঁদের আলোমাত্র থাকে না, হয়ে ওঠে একটি রোমান্টিক চেতনার নাম। এই চেতনা থেকেই তিনি জ্যোৎস্না কিংবা জ্যোৎস্নার আধার চাঁদকে অবলোকন করেন বিচিত্র মধুরতায়। এমনকি সুদূর মার্কিন মুলুকে থেকেও তিনি বিদিশার তীরে বসে চন্দ্রজ্যোৎস্নাকে উপভোগ করেন পরম আগ্রহ ভরে। অনুজ, অনুরক্ত কবি হাসান আল আবদুল্লাহর সঙ্গে কথার ফাঁকেই বলে ওঠেন, ‘টাকা জমাচ্ছি, পূর্ণিমার ওই চাঁদটা আমি কিনবোই।’ এমনকি প্রবাসে থেকে লেখা সর্বশেষ কাব্য (এখন পর্যন্ত) ‘আমার চুম্বনগুলো পেঁছে দাও’; যেখানে তিনি মূলত দীর্ঘ প্রবাসজীবনের যন্ত্রণাকেই বড় করে দেখেছেন, মা-মাটি আর শেকড়ের টানে, স্বাধীনতা ও সমাজতন্ত্রের টানে আলোড়িত হয়েছেন, সেখানেও ‘সাদা খরগোশের মতো কম্পমান’ (‘বিব্রত সংলাপ’) অবস্থায় আবির্ভূত হয়েছে চাঁদ। বৈরী সময়কে অসাধারণ নান্দনিক রূপকল্পে উপস্থাপন করেছেন কবি। বলেছেন :
অমাবস্যার পুঞ্জ পুঞ্জ অন্ধকার
একদল কালো মুখোশ পরা
ডাকাতের মতো
শিকার করতে চাইছে সাদা খরগোশের মতো কম্পমান
চাঁদটাকে।
বস্তুত, দীর্ঘ প্রবাসজীবনে থাকলেও, দীর্ঘ সময় ধরে কবিতা না লিখলেও, বাংলাদেশের মানুষ ও তার কর্মকাণ্ডকে প্রকৃতির দূর থেকেই যে অত্যন্ত নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেন, তার প্রমাণ ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’-এর কবিতাগুলো। আর হ্যাঁ, বাংলার প্রকৃতি, বিশেষত, চাঁদ-জ্যোৎস্নাকে কবি যে ভুলতে পারেন না কখনো; এমনকি সুদূর অবস্থিতিতেও এ সত্যের প্রকাশ এই কবিতা। কাদরীর চতুর্থ এবং এখন পর্যন্ত শেষ গ্রন্থ ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’তে প্রবাসজীবনের যন্ত্রণা, স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র আর শেকড়ের প্রতি আকর্ষণের তীব্রতা ব্যক্ত হয়েছে; তবে এগুলোর মাঝেই যে বঙ্গনিসর্গ আর বাঙালিকে দারুণভাবে উপলব্ধি করেছেন সে কথা বলা বাহুল্য। প্রকৃতপক্ষে, মাইকেল মধুসূদন দত্ত যেমন সুদূর ফ্রান্সে বসেও সাগরদাঁড়ি আর কপোতাক্ষ নদের কথা ভুলতে পারেননি, শহীদ কাদরীও তেমনি বিপরীত গোলার্ধ্বের আমেরিকায় দিনাতিপাত করলেও তাঁর কবিতায় ফল্গুধারার মতো বয়ে চলেছে শ্রাবণের রাঙা জল; আষাঢ়ের ঘন মেঘের এবং শাড়ি পরা বাংলার মায়েদের দীর্ঘ ছায়া পড়ে আছে তাঁর কবিতার ওপর। বাংলার বর্ষণমুখর রাত্রির কালো হাওয়া যেমন অনুভব করেন মার্কিন মুলুকে বসে, তেমনি বাংলার সোনালি খড়বাহী গরুর গাড়ির মতো মন্থর গতিতে বয়ে চলে তাঁর কবিতা। বস্তুত, যতদূরেই থাকুন কাদরী, বাংলা মায়ের শাড়ির আঁচল আর বাংলার মাটির সোঁদা গন্ধ তাকে ছেড়ে যায়নি। পশ্চিমের প্রবল শীতেও বাংলার মমতা কবিকে উষ্ণ পোষাকের মতো আবৃত করে রাখে ; কবির হৃদয়ের ক্যানভাসে ভাসে চিরায়ত বাংলার ছবি।
৩
শহীদ কাদরী নাগরিক কবি। নগরজীবনই তাঁর কবিতার প্রধান উপাদান। চাঁদ-জ্যোৎস্না ছাড়া নিসর্গের আর কোনো উপাদানই তাই বিশেষ স্থান করে নিতে পারেনি তাঁর কবিতায়। এখানে জোনাকি আছে, তারা সোনালি জরির মতো নকশা জ্বেলে দেয়, অমাবস্যার অন্ধকারে গোলাপঝাড়ের মতো পুঞ্জপুঞ্জ ভরে থাকে সে জোনাকিও আবির্ভূত হয় জ্যোৎস্না কিংবা অন্য কিছুর অনুষঙ্গ হিসেবে; বলা যায়, জোনাকির যে একটা স্বতন্ত্র ও সৌন্দর্যময় অস্তিত্ব রয়েছে, তার উপস্থিতি নেই বললেই চলে। কাদরীর কবিতায় শর্করার মতো রাশি রাশি নক্ষত্রবিন্দুর দেখা পাওয়া যায়; হীরার কৌটোর মতো শিশির টলটল করে ফুটপাতে শুয়ে থাকা ন্যাংটো ভিখিরির নাভিমূলে; কবি নিজেও ওষুধের ফোঁটার মতো বিন্দু বিন্দু গলাধঃকরণ করতে চান প্রতিশ্রুতিশীল শিশির; গাছ-মাছ-জল সহ সকল গ্রাম্য আবহই দু-একবার হাজির হয়েছে তার কবিতায় ; নিসর্গকে নিপুণ জেলে বলেও ভেবেছেন কখনো বা; নিসর্গের আকর্ষণে বারবার যেতেও চেয়েছেন গ্রামে; তবুও, নৈসর্গিক চিত্র অথবা পল্লীপ্রধান বাংলাদেশ, কোনোটাই কাদরীর কবিতার কেন্দ্রীয় বিষয় নয়; বরং নগরের বাসিন্দা বলেই হোক আর নাগরিকতার সর্বগ্রাসীরূপের প্রভাবেই হোক, নগরজীবনই তাঁর কাব্যের প্রধান উপাদান।
এমনকি তিনি যখন নৈসর্গিক কোনো উপাচারের নান্দনিক পঙক্তি উপস্থাপন করেন, তখনো নগর ও নাগরিক ভঙ্গি এবং ভাষাপ্রয়োগেও নাগরিকতা লক্ষ করা যায়। তারপরও, বঙ্গ প্রকৃতি আর বাংলার নিসর্গের যে ছবিগুলো তিনি আঁকেন, যে মমতায় আঁকেন তা কেবল কাব্য হিসেবেই নয়; স্বদেশ, স্বজাতি এবং স্বনিয়ন্ত্রিত জীবনদর্শনেরও অনিন্দ্য নান্দনিকতার অসামান্য প্রতীক। প্রকৃতপ্রস্তাবে, কাদরীর একটি বা দুটি কবিতা নয়, সমগ্র কবিতাপাঠেই রূপসী বাংলার নিসর্গকে অনিন্দ্য চিত্রময়তায় অনুভবযোগ্য করা যায়। আর হ্যাঁ, নিসর্গের অতুল্য অনুষঙ্গ জ্যোৎস্নাকে কেবল জ্যোৎস্না নয়, অনির্বচনীয় সৌন্দর্যের আধার হিসেবে দেখলে, কেবল নিসর্গঋদ্ধ কবিতা নয়, সমগ্র কবিতাপ্রসঙ্গেই শহীদ কাদরী অনন্য প্রতিভা; বাংলা কবিতার এক অনিন্দ্য জ্যোৎস্নাময় অধ্যায়। কিন্তু এই জ্যোৎস্নামুগ্ধ কবি এখনো সুদীর্ঘ পরবাসে। তাঁর দীর্ঘ পরবাস বাংলা কবিতারই জ্যোৎস্নালোকের নির্বাসন বটে।