নিম্নবর্গীয় মানুষের অত্যুজ্জ্বল রূপকার
জীবন বাস্তবতার নিরিখে হৃদয়ের অন্তর্লীন স্পর্শে, খানাখন্দ খুঁড়ে জীবনের স্বাদ-বিস্বাদ উগড়ে যে কজন কথাসাহিত্যিক বাংলা ভাষাসাহিত্যকে শ্রীবৃদ্ধি দান করেছেন, তাঁদের মধ্যে বুলবুল চৌধুরী একজন। এই কথাসাহিত্যিক নিম্নবর্গীয় চরিত্রকে চিত্রণ করেছেন তাঁর সাহিত্য-সৃজনীতে। কথ্যভাষাকে সাহিত্যে রূপদান করেছেন তিনি। এ জন্য তিনি আমাদের কাছে হয়ে উঠেছেন একজন সত্যিকারের কথাসাহিত্যিক। মূলত তাঁর প্রথম পরিচয় তিনি ‘টুকা কাহিনী’র রূপকার । ‘টুকা কাহিনী’র জনক যাপনসূত্রে শিল্পী। তাঁর চিন্তালোকে সর্বক্ষণ খেলা করে সাহিত্য সাধনা। তার প্রমাণ যশস্বী সাহিত্যিক রাহাত খানের উদ্ধৃতি, “বুলবুল চৌধুরী যে লিখবে, লেখা ছাড়া কিছু বোঝে না, সেটা আমি জানি ওর শিক্ষক হিসেবে সেই চৌত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে থেকে। বুলবুলের লেখাই তার উড়নচণ্ডী তবে সাহিত্য-অন্ত স্বভাবটি প্রকাশ করে। তার সেই বিখ্যাত ‘টুকা কাহিনী’ গল্পটি পড়ে খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। বুলবুল জাত-লিখিয়ে, তাতে সন্দেহ কী।”
আবদুল মান্নান সৈয়দ মূল্যায়ন করেছেন একইভাবে, “‘টুকা কাহিনী’ নামে একটি গল্প লিখে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন বুলবুল চৌধুরী। তখন বাংলাদেশ অল্প কিছুকাল মাত্র স্বাধীন হয়েছে। জোয়ার চলছে কবিতার। পুরোনো কবিদের সঙ্গে নতুন অজস্র কবিও দেখা দিয়েছিল। অল্প হলেও দেখা যাচ্ছে কয়েকজন নতুন গল্প লেখককে। ওই একটিমাত্র গল্পে সবার দৃষ্টি এসে পড়ল এই নতুন লেখকের দিকে। তারপর ‘মাছ’ এবং অন্যান্য। প্রথম থেকেই বুলবুল চৌধুরীকে দেখা গেল প্রতিশ্রুতি নয়, পূর্ণ প্রতিষ্ঠিত একজন গল্পকার হিসেবে। আজ, দুই দশকের অধিককাল পরে তাকে আর ‘সত্তরের দশকের গল্পকার’ বলে খাঁচায় বন্দি করে রাখা যাবে না। এখন তিনি বৃহৎ আকাশের বিহঙ্গ।”
বরেণ্য এই গদ্যশিল্পীর হৃদয় নিংড়ানো রংতুলির আঁচড়ে কথাসাহিত্য ঋদ্ধিতা পেয়েছে। জীবনের নানান প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির বেড়াজালে বন্দিত্বদের কথ্যরূপ দিয়েছেন কালো কালির আঁচড়ে। কোথাও কোনো কার্পণ্য রাখেননি তিনি। ব্যক্তি বুলবুল চৌধুরী থেকে শুরু করে একজন কথাসাহিত্যিক বুলবুল চৌধুরী—দুজনই বাংলা সাহিত্যের জন্য প্রয়োজন ছিল। তা না হলে আমরা পেতাম না ছোট গল্প—ডিম, টুকা কাহিনী, চৈতার বউগো, থু, মাছসহ আরো অসংখ্য পাঠকপ্রিয় গল্প। বুলবুল চৌধুরী বাংলা ভাষার ছোটগল্পকার হিসেবে সর্বজনস্বীকৃত। তাঁর ছোটগল্পের বিষয়বস্তু হিসেবেও দেখতে পাই সমাজের অতি নিম্ন শ্রেণির। তাঁর গল্পের বয়ান আর ভাষ্যে তিনি স্বতন্ত্র। পাঠক পাঠ শেষে চয়নে চমকিত হয়ে ওঠেন। বুলবুল চৌধুরীর লেখার আরেকটি শক্তিশালী দিক, সেটা হলো উপমা উৎপ্রেক্ষার অসাধারণ ব্যবহার।
‘যদি আলো-আঁধারিতে সে কোথাও গাঁট মেরে বসে থাকে, তাহলে মানুষ বলে ঠাওর করা সম্ভব নয়। ঠাওর হয়, কেউ গোবর-পচা বা কোনো আবর্জনা কোদালে কুপিয়ে, পাতিতে বয়ে এনে স্তূপাকৃত ফেলে রেখেছে।’ (টুকা কাহিনী)
‘ঊর্ধ্বাকাশে সারাটা সময় জুড়ে ভাসমান মেঘের রংবদলের খেলাও কি বিরতি লয় কভু! চন্দ্রের উদয় কিংবা গ্রহণ, সূর্যোদয় কিংবা সূর্যগ্রহণ, বিদুৎ চমক, রংধনুর বর্ণিল ছটা, মেঘের গর্জন-বর্ষণ—সবই তো আকাশের অধীন। (অতলের কথকতা)
তাঁর লেখার পরতে পরতে কান পেতে শুনতে পাই একজন দক্ষ শব্দ কারিগরের উপস্থিতি। কর্মকার যেমন লোহাকে আগুনের আংড়ায় চুবিয়ে চুবিয়ে তার পর হাতুড়ি দিয়ে সঠিক অবস্থানে নিয়ে আসেন, তেমনি বুলবুল চৌধুরীও যে লেখার উপাদান জোগাড় করার জন্য জীবনকে বারবার ঠেলে দিয়েছেন একদম উপাদানের কাছে অতি নিকটে। কঠিন বিষয় তিনি অকপটে তুলে ধরেছেন উপন্যাসে। আর সে জন্যই ‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে’র মতো দারুণ উপন্যাস পাঠক পেয়েছেন । লক্ষ্মীকে একজন বেশ্যারূপে এই উপন্যাসের বাতাবরণ করেছেন। পরিস্থিতির শিকার একজন লক্ষ্মীর জীবনের করুণ ট্র্যাজেডির জন্য পাঠক হিসেবে কষ্ট পেয়েছি। একজন লেখক তাঁর সৃজনীসত্তার মাধ্যমে পাঠককে কখনো আনন্দের সাগরে ভাসাবেন, আবার কখনো বেদনার করাল গ্রাসে মর্মাহত করাবেন। এখানেই তো সৃজনশীলতার সার্থকতা।
সরল পাত্রে গড়ল মেশানোর মতো কঠিন কাজটি করেছেন সযতনে। খ্যাতিমান এই কথাশিল্পীর বহুদাবিভক্তি জীবননির্যাসের প্রতিফলন দেখেতে পাওয়া যায় তাঁর সাহিত্যে। জীবনের সবটুকুই যে শিল্পসাহিত্যের জন্য উজাড় করে দিয়েছেন। তাঁর গল্পের আড়ালে-আবডালে প্রতিফলিত হয়েছে সমাজ। শক্তিধর গদ্যশিল্পীর নিখাদ শব্দশৈলীর বর্ণনায় তুলে ধরেছেন গ্রামীণ জীবনকে। জীবনের প্রয়াস ও অন্তপ্রয়াস অনুযোজিত হয়েছে সাহিত্যে। চিত্রিত করেছেন বিচিত্র ভুবনের সব বৈচিত্র্যময় ঘটনাবলি। ‘সাধু হে আনন্দ পেতে দাও’ এই শিরোনামের তাঁর একটা আত্মজীবনীমূলক গদ্য পড়েছিলাম বহু আগে। এই গদ্য একজন অদম্য সাহসী বুলবুল চৌধুরীকে দেখতে পাই। এমন সাহস সত্যিই বিরল তবে।
শরতের কাশফুলের সাদা সাদা রেণুর মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা শব্দাকাশকে তুলে এনেছেন তাঁর স্মৃতির অতলগহ্বর থেকে। ব্যক্তি সংলাপের মনরাজ্য থেকে সমগ্র পাঠক অন্তরে ঠাঁই পাওয়া গদ্যকথনে তুলে এনেছেন তাঁর ‘অতলের কথকতা’ নামক গ্রন্থে। নির্মাণশীল এই লেখক বিড়বিড় করে হেঁটে চলেছেন সমাজ এবং সংস্কৃতির পথে। জীবনঋদ্ধতায় ভরপুর এই কথাসাহিত্যিকের উন্মেষকাল ষাটের দশকে। শুরুতেই তথাকথিত অন্তেবাসী মানুষ ও জীবন নিয়ে শৈল্পিক রঙে ও লেখায় নির্মাণ করেছেন তাঁর নিজস্ব রেখা। সেই রেখায় দেখতে পাই নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবন গাঁথা। তিনি নিজের অধিকাংশ লেখায় গ্রামীণ জীবনকে নানা আঙ্গিকে বিধৃত করেছেন। নগরায়ণের জটাজালও তাঁর লেখালেখিতে পরিস্ফুট। বুলবুল চৌধুরীর প্রকাশিত ছোটগল্পগ্রন্থগুলো হলো টুকা কাহিনী, পরমানুষ, মাছের রাত ও চৈতার বউ গো। উপন্যাসগুলোর তালিকায় আছে অপরূপ বিল ঝিল নদী, কহকামিনী, তিয়াসের লেখন, অচিনে আঁচড়ি, মরম বাখানি, এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে, ইতু বৌদির ঘর এবং দখিনা বাও, ভাওয়াল রাজার উপাখ্যান, কহতবসহ আরো অসংখ্য গ্রন্থের পরতে পরতে আমরা দেখতে পাই বাংলার নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের কথা।
তাঁর আত্মজৈবনিক দুটি গ্রন্থের নাম ‘জীবনের আঁকিবুঁকি’ ও ‘অতলের কথকথা’। তা ছাড়া গাঁওগেরামের গল্পগাথা, নেজাম ডাকাতের পালা, ভালো ভূত আর প্রাচীনগীতিকার গল্প নামক কিশোর গ্রন্থের রচয়িতাও তিনি। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন হুমায়ুন কাদির স্মৃতি পুরস্কার, জসীমউদদীন স্মৃতি পুরস্কার, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার এবং ব্র্যাক ব্যাংক ও সমকাল সাহিত্য পুরস্কার।
লেখার জন্য লেখা নয়; বরং জীবনের জন্য লেখা। এমনি ভাবনা এই বরেণ্য কথাসাহিত্যিকের মূল বক্তব্য। তাই তো এই বয়সেও তিনি নিয়মিত লিখে চলছেন। সুনিপুণ এই কথাকারের লেখার ব্যবচ্ছেদ করার দুঃসাহস বা স্পর্ধা তো আমার নেই। তবে ভালোলাগার দু-চারটি বাক্য তো উপস্থাপন করতেই পারি। পাঠ হিসেবে সর্বশেষ যে উপন্যাসটি পড়ে শেষ করলাম, সেটি ‘বনতলার পাঁচালি’। কী আছে এই ‘বনতলার পাঁচালি’তে। হুম। এই জাতীয় তাঁর অনেক উপন্যাস এবং গল্প তো পাঠক আগেও পড়েছেন। তাহলে নতুন করে কেন ‘বনতলার পাঁচালি।’ হ্যাঁ। কথা থেকে যায়। সাহিত্য সমাজের দর্পণ। সাহিত্যের মধ্যে একটি সমাজের বিচিত্ররূপ থাকতে হয়। তা না হলে সেটা কেন সমাজ ধারণ করবে যুগের পর যুগ। সময় পরিবর্তনের সঙ্গে যেমন প্রকৃতি বদলায়, বুলবুল চৌধুরীর আগের উপন্যাসের মধ্যে পাঠক যেমন খুঁজে পায় জৈবিক গন্ধ, এই উপন্যাসেও তাই। ব্যত্যয় ঘটেনি তেমন কিছু। তবে সমাজের অপরাধীদের অপরাধ প্রবণতার ধরনটাও পরিবর্তন হয়েছে। সেই বিষয়টাই লেখক কালো কালির কারিশমায় তুলে ধরেছেন।
শুরুতে আমরা দেখতে পাই খাতম্মী নামের এক পতিতার মৃত্যুর রহস্য উন্মোচনের জন্য হাসনাইন ইমতিয়াজ নামের এক সাংবাদিক উপস্থিত হয়েছেন নিষিদ্ধ পল্লীতে। সেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক পাঠককে পরিচয় করে দিয়েছেন আরো অনেক ঘটনার সঙ্গে। বদচরিত্রের পাইন্না নামের এক চরিত্রকে উপস্থাপন করা হয়েছে। যে পাইন্না শিউলি বাড়ির মালিক হয়েছেন নানা কৌশলে। সমাজে এ রকম চতুর মানুষ খুব কম নেই। সে বিষয়টি তিনি তুলে ধরেছেন। আমাদের সমাজে নারীদের অবমূল্যায়ন করা হয় বিভিন্ন পদে পদে। সেদিকগুলো উঠে এসেছে। আমরা ঔপন্যাসিকের লেখায় দেখতে পাই, ‘সবারই এক কাহিনী থাকে।’ বিনুর ভাষায়, ‘জীবন বাঁচাতে বোরকায় ঢাকা শরীর বিকিয়ে যাচ্ছি কবির ভাই।’ কী সরল ভঙ্গিমায় কঠিন বক্তব্যই না তুলে ধরেছেন! আমাদের সমাজের নারীদের অবদলিত এবং বঞ্চিত হওয়ার পেছনের কারণটি তিনি অবলোকন করেছেন নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে। আসি এবার এই উপন্যাসের বর্ণনায়। সরল রৈখিকতার আলোকে উপন্যাসের শুরু হলেও শেষে দেখা যায় সংযোজিত হয়েছে অনেক ঘটনা। যার দরুণ স্বল্পদৈর্ঘ্যের উপন্যাস হলেও এর পেছনের কাহিনী অনেক বিস্তৃত। মূলত লেখক হাসনাইন ইমতিয়াজ নামক সাংবাদিকের মাধ্যমে উপন্যাসটি তুলে ধরেছেন। আর এর বিষয়বস্তু হলো শিউলি বাড়িকে ঘিরে। সেই শিউলি বাড়িতে একের পর এক মেয়ে আসার বর্ণনা বা তাদের কাহিনী উপস্থাপন করা হয়েছে।
এমনকি শিউলি বাড়ির সর্দারনীর ইতিহাসটিও তুলে ধরেছেন লেখক। এবং সর্দারনীদের মনের অতলে জমানো গাঢ় বেদনাকেও পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন। কাহিনীর শেষে যে চমকিত হয়েছি। মাকিদ খান একজন অভিনেতা। খাতম্মী হত্যাকাণ্ডের তথ্য উদ্ধারের জন্য হাসনাইনের বন্ধু মাকিদ খানকে পাঠনো হয়। হিতে বিপরীত ঘটে যায় যখন মাকিদ খান শিউলি বাড়ির মধ্যে ঢুকে। এবং নিজ চোখে যখন দেখতে পান তাকে ছেড়ে আসা তার অনিন্দনীয় সুন্দরী বউ এখন শিউলি বাড়ির রূপোপজীবিনী হওয়ার অপেক্ষায়। শেষে অভিনেতার মনের ভেতরেও জমাকৃত কষ্টের ভাগিদার হয়ে ওঠে পাঠক। একটি রহস্য উন্মোচনের জন্য হাজারও কঠিন বাস্তবতাকে উল্লেখ করেছেন। যা পাঠক কোনো সময়ই কল্পনা করেনি। এভাবে বুলবুল চৌধুরী বিস্মিত করেন পাঠকদের।