ঢাকার কথা ৪৮
সুবাদার শাহসুজার কথা
ঢাকায় নিযুক্ত মোগল সুবাদারদের মধ্যে কেউ কেউ বিশেষ কৃতিত্বের দাবিদার। এই ধারার অন্যতম সুবাদার হচ্ছেন শাহ সুজা। শুধু সুবাদার নন তিনি একজন মোগল শাহজাদা। সম্রাট শাহজাহান ও সম্রাজ্ঞী মমতাজ মহলের পুত্র। সফল প্রশাসক হিসেবে সম্রাট শাহজাহানের পুত্রদের মধ্যে দুজন সবচেয়ে দক্ষতা দেখাতে পেরেছিলেন। একজন আওরঙ্গজেব আর অন্যজন শাহসুজা। শাহজাহান সুজার ওপর ভরসা করেছিলেন বলে তাঁকে একই সাথে বাংলা ও উড়িষ্যার সুবাদার হিসেবে নিয়োগ দেন। সুবাদার নিযুক্ত হয়ে সুজা ১৬৩৯ সালে ঢাকায় আসেন। মাঝখানে কিছুটা বিরতি মেনে নিলেও শাহ সুজা দীর্ঘকাল বাংলার সুবাদার ছিলেন। তাঁর সুবাদারির অবসান ঘটে ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দে। এর মধ্যে ১৬৪৭-৪৮ সালে তিনি সম্রাট শাহজাহানের সঙ্গে থেকে আফগানিস্তানে বিদ্রোহ দমনে অংশ নিয়েছিলেন। আর ১৬৫২ সালে চার মাস কাবুলে অবস্থান করেছিলেন।
শাহ সুজা যখন বাংলায় সুবাদারের দায়িত্ব নিয়ে আসেন তখন তাঁর বয়স ছিল ২৩ বছর। এর আগে শাহজাদা হিসেবে অনেক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এই পর্যায়ে তিনি সেনাপতি ও প্রশাসক হিসেবে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন।
শাহ সুজার সুবাদারির পুরো সময় ঢাকা সুবাহ বাংলার রাজধানী ছিল না। একপর্যায়ে তিনি রাজধানী রাজমহলে স্থানান্তর করেছিলেন। শাহ সুজার সময়ে বাংলায় শান্তি শৃঙ্খলা বজায় ছিল। এ সময় বাংলায় শিয়া মুসলমানদের সবচেয়ে বেশি আগমন ঘটেছিল। মোগল যুগে বাংলার সাথে ইরানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ইরানি মুসলমানদের একটি বড় অংশই ছিল শিয়া। এ কারণেই বাংলায় শিয়াদের আগমনের ধারা তৈরি হয়ে যায়। শাহ সুজার সময় শিয়া আগমন বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি কারণ ছিল। তাঁর মা মমতাজ মহল ও দুই স্ত্রী ছিলেন শিয়া। এ ছাড়া তিনি তাঁর দরবারে কবি, পণ্ডিতদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এদের বেশির ভাগই এসেছিলেন ইরান থেকে। এঁদেরও বেশির ভাগ ছিলেন শিয়া। জনশ্রুতি আছে যে, সুজা যখন সুবাদারির দায়িত্ব নিতে বাংলায় আসেন তখন তাঁর সাথে প্রায় ৩০০ শিয়া এসেছিল। এসব নানাবিধ কারণেই বলা হয় শাহ সুজার সময়েই ঢাকায় শিয়া বসতি সবচেয়ে বেশি বিস্তার লাভ করে।
শাহ সুজার পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ইমারত নির্মিত হয়েছিল। চকবাজারের কাছে বুড়িগঙ্গার তীরে তাঁর সময়ে নির্মিত হয় রাষ্ট্রীয় অতিথিশালা বড় কাটরা। শিয়াদের প্রতি সুবাদারের অনুরক্তি ছিল বলেই তিনি শিয়াদের ধর্মকেন্দ্র অর্থাৎ ইমামবাড়া নির্মাণ করিয়ে দেন। যা হোসেনি দালান নামে পরিচিত। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যমুর্খ কতিপয় মানুষ গত বছর চুরিহাট্টা মসজিদটি ভেঙে ফেলেছে। এই মসজিদটিও শাহ সুজার সময়েই নির্মিত হয়েছিল। তাঁর সময়ই ইদ্রাকপুর, সোনাকান্দা ও হাজিগঞ্জে তিনটি জলদুর্গ নির্মিত হয়।
শাহ সুজার শাসনকালে ঢাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের বিকাশ ঘটেছিল। সুবাদার ইউরোপসহ বিদেশি বণিকদের বাংলায় অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এই সময়ে পর্তুগিজ বণিকরা সুবাদারের কাছ থেকে বেশ কিছু সুবিধা আদায় করে। শাহ সুজার দক্ষ ব্যবস্থাপনায় বাংলার রাজস্ব আয় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
জীবনের শেষ অধ্যায়টি ভালো কাটেনি শাহ সুজার। ১৬৫৭ সালে সম্রাট শাহজাহান অসুস্থ হয়ে পড়লে পুত্রদের মধ্যে সিংহাসন দখলের প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এই উত্তরাধিকার সংগ্রামে এগিয়ে থাকেন আওরঙ্গজেব। বাংলার বাইরে আওরঙ্গজেবের সাথে কয়েকটি যুদ্ধ হয় সুজার। এসব যুদ্ধে পরাজিত হন তিনি। এরপর সুজা গৌড়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি শহরে এসে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু এখানে তিনি দারুণভাবে আক্রান্ত হন। অবশেষে ১৬৬০ সালের এপ্রিলে চলে আসেন ঢাকায়। এরপর শুরু হয় সুজার পলায়নপর জীবন। তিনি কুমিল্লা হয়ে নোয়াখালীতে চলে যান। তাঁর ইচ্ছে ছিল এখান থেকে জাহাজযোগে মক্কা চলে যাবেন। কিন্তু সমুদ্র উত্তাল থাকায় সে ইচ্ছে ত্যাগ করে আরাকানের সাথে যোগাযোগ করেন। আরাকান রাজার আমন্ত্রণে শাহ সুজা তাঁর পরিবার পরিজন ও সহচরদের নিয়ে আরাকানে চলে আসেন। কিন্তু এখানে সুজার অবস্থান সুখকর হয়নি। আরাকান রাজার দৃষ্টি পরে সুজার সাথে থাকা ধনসম্পদের দিকে। এ ছাড়ার সুজার সাথে আসা সুন্দরী মেয়েদের দিকেও তাঁর দৃষ্টি ছিল। এই সূত্রেই সুজা ও তাঁর পরিবার পরিজনের ওপর অত্যাচার নেমে আসে। শেষ পর্যন্ত এই নির্যাতনেই আরাকানে শাহ সুজার মৃত্যু ঘটে।