ঢাকার কথা ৫০
নিমতলী দেউড়ি
বর্তমান ঢাকার বঙ্গবাজারের কাছে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির অভ্যন্তরে নিমতলী দেউড়ির অবস্থান। দেউড়ি শব্দের অর্থ প্রবেশদ্বার বা তোরণ। এককালের নিমতলী মহল্লায় এই তোরণটি নির্মিত হয়েছিল বলে সাধারণের কাছে নিমতলী দেউড়ি নামে পরিচিত। প্রকৃতপক্ষে মোগল আমলের শেষ দিকে ঢাকায় নির্মিত একটি সরকারি প্রসাদের প্রবেশদ্বার ছিল এই দেউড়ি। নবাবী আমলে নায়েব এ নাজিম বা সহকারী সুবাদারের সরকারি বাসস্থান ছিল এই নিমতলী প্যালেস। ইংরেজ শাসনামলেও এই প্রাসাদের নব রূপায়ণ ঘটে। এই সরকারি প্রাসাদের কোনো চিহ্ন এখন আর অবশিষ্ট নেই। থাকার মধ্যে শুধু এই দেউড়িটি রয়েছে।
১৬১০ সালে পূর্ব বাংলা মোগলদের অধিকারে আসার পর ঢাকা মোগল সুবার রাজধানী হয়। এক শতকেরও বেশি সময় ধরে রাজধানী ঢাকার বিস্তার ঘটতে থাকে। এই ধারাবাহিকতার অবসান ঘটে ১৭১৫ সালের দিকে। এখানে একটু ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন শেষ শক্তিমান মোগল সম্রাট। পরবর্তী মোগল সম্রাটরা ছিলেন দুর্বল প্রকৃতির। তাঁদের দুর্বল শাসনের সময়কালে মোগল সাম্রারাজ্য ক্রমে ক্ষয়িষ্ণু হতে থাকে। আওরঙ্গজেবের শাসনকালে সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকাতে সুবাদার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন মুর্শীদ কুলী খান। এই দক্ষ সুবাদার আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে সরিয়ে নেন পশ্চিম বাংলার কর্ণসুবর্ণে। তাঁর নাম থেকে এই অঞ্চলের নতুন নাম হয় মুর্শিদাবাদ। তিনি এ সময় থেকে ঢাকার প্রশাসনিক দপ্তরের দায়িত্ব দেন একজন সহকারী সুবাদারকে। তার উপাধি ছিল নায়েব এ নাজিম। এই সময়ই সুবা বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা তখন একজন নায়েব নাজিমের অধীনে প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে টিকে থাকে। ১৭৬৬ সালে নায়েব নাজিমের জন্য নিমতলী প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। প্রাসাদের প্রবেশদ্বার হিসেবে নির্মিত হয় এই এই দেউড়িটি। এটি ছিল একটি দৃষ্টি নন্দন তোরণ। নির্মাণকালের জৌলুস না থাকলেও এখনো দর্শককে বিমোহিত করে। তোরণটি তিনতলা বিশিষ্ট। ত্রিতলের উন্মুক্ত গ্যালারিটিকে নহবত খানা বলা হতো। এখান থেকে বাদ্য বাজিয়ে নায়েব নাজিমের আগমন ঘোষণা করা হতো।
নিমতলী প্রাসাদ আর দেউড়ি নির্মাণের একটি পটভূমি রয়েছে। পলাশীর যুদ্ধের আগে থেকে ঢাকায় নিযুক্ত নায়েব নাজিম মোগলদের রেখে যাওয়া ইমারত বর্তমান কেন্দ্রীয় কারাগার এলাকায় অবস্থিত ঢাকা দুর্গ বা বড় কাটরাকে বাসস্থান হিসেবে ব্যবহার করতেন। পলাশীর যুদ্ধের পর নবাবের অনুগতদের দমন করার জন্য ইংরেজ সেনা অফিসার লেফট্যান্যান্ট সুইটনট ঢাকা আক্রমণ করেন। এ সময় ঢাকার নায়েব নাজিম জসরত খান ঢাকায় ছিলেন না। ছিলেন বিহারে। তিনি ছিলেন ইংরেজদের অনুগত। ইংরেজদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণাকারী নবাব মীর কাশিম সেখানে জসরত খানকে বন্দি করেন। লে. সুইটনট ঢাকায় এসে অবস্থান নেন এবং ঢাকা দুর্গে বসবাস করতে থাকেন। লর্ড ক্লাইভের হাতে বাংলার শাসন ক্ষমতা চলে যাওয়ার পর ক্লাইভ জসরত খানকে মুক্ত করে ১৭৬৫ সালে ঢাকার নায়েব নাজিম হিসেবে পুনরায় নিয়োগ দেন।
জসরত খান ঢাকায় ফিরে আসার পর বাসস্থান সংকটে পড়েন। কারণ ইতিমধ্য ঢাকার বেশির ভাগ সরকারি বাসভবন ইংরেজদের দখলে। তখন তিনি সাময়িকভাবে বসবাস করতে থাকেন বড় কাটরায়। বিষয়টি কলকাতা পরিষদের নজরে আসে। পরিষদ যথাশিগগির নায়েব নাজিমের প্রসাদ নির্মাণের জন্য লে. সুইটনটকে নির্দেশ দেয়। জায়গা পছন্দ করা হয় নিমতলী মহল্লা থেকে উত্তরে বর্তমান পুরাতন হাইকোর্ট ভবনের কাছাকাছি পর্যন্ত এলাকাটি। এভাবেই নির্মিত হয় নিমতলী প্রাসাদ। বর্তমানে শুধু নিমতলী দেউড়িটি টিকে থাকলেও এককালে এখানে সুরম্য অট্টালিকা তৈরি করা হয়েছিল। দেউড়ির প্রধান প্রবেশ পথটি চমৎকার খিলান আকৃতির। ইউরোপীয় স্থাপত্যের পরিচিত শৈলী গথিক রীতিতে নির্মাণ করা হয়েছে এই খিলান পথটি। দেউড়ির ইমারতটির চারদিকেই বারান্দা রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে আটকোণাকার খিলানযুক্ত জানালা। বর্তমানে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির তত্ত্বাবধানে নিমতলী দেউড়ির সংস্কারকাজ চলছে।