সত্যজিৎ রায়
ভারতীয় ছবির ‘গডফাদার’
২০১৩ সালে ব্রিটিশ দৈনিক টেলিগ্রাফ পত্রিকায় লেখাটি লিখেছিলেন সামীর রহিম। সেখান থেকে ভাষান্তর ও সংযোজন করে তৈরি করা হয়েছে বর্তমান রচনাটি, সত্যজিৎ রায়ের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে।
১৯৪৮ সালে একজন বাঙালি হিন্দি সিনেমার দুর্দশার কথা তুলে ধরে পত্রিকায় একটি কলাম লিখেছিলেন যার শিরোনাম ছিল, ‘হিন্দি সিনেমার সমস্যাটা কী?’ (হোয়াট ইজ রং উইথ ইন্ডিয়ান ফিল্মস)। তাঁর মতামত ছিল, ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালকরা বিশ্বব্যাপী সিনেমা বানানোর রীতিতে যে পরিবর্তন এসেছে সেটা মোটেও ধরতে পারছেন না।
তিনি লিখেছিলেন, ‘সিনেমার কাঁচামাল হচ্ছে আমাদের জীবন’। ক্ষোভ ছিল তাঁর লেখায়, ‘এটা ভাবতে খুবই খারাপ লাগে, গান ও চিত্রকলায় যে দেশটা অনুপ্রেরণা দিয়েছে সে দেশটার চলচ্চিত্র নির্মাতারা সিনেমাটা ঠিকমতো বানানো শেখেননি। এটা এমন কোনো কঠিন কাজ না। নির্মাতাকে তাঁর চোখ, কান খোলা রাখতে হবে এবং সেগুলোকে কাজে লাগাতে হবে।’
এই বাঙালি কলাম লেখক ছিলেন সত্যজিৎ রায়। কলামটি ছাপা হওয়ার কয়েক বছর পরই তিনি নিজেই মাঠে নেমে দেখিয়ে দিয়েছিলেন সিনেমা কীভাবে বানাতে হয়। ভারতের প্রেক্ষাপটে গীতিধর্মী বাস্তবতা (lyrical realism) তৈরি করেছিলেন তিনি নিজের ছবিতে।
সত্যজিৎ রায়ের প্রথম কাজ ‘পথের পাঁচালী’, এটিকে অনেকেই তাঁর সেরা কাজ বলে থাকেন। তবে অপু ট্রিলোজির তিনটি ছবি- পথের পাঁচালী (১৯৫৫), অপরাজিত (১৯৫৬) এবং অপুর সংসার (১৯৫৯) এগুলোকেও একসঙ্গে সেরা ট্রিলোজি আখ্যা দেওয়া হয়। এখানে অপুর শৈশব থেকে তাঁর জীবনের যাত্রা তুলে ধরা হয়েছে।
জাপানি পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া ও মার্কিন পরিচালক মার্টিন স্করসেসি দুজনই সত্যজিতের কাজের ভক্ত ছিলেন। ৩৫টি ছবি বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ, জীবনের শেষভাগে এসে নিজের কাজের জন্য অস্কারে আজীবন সম্মাননা পেয়েছিলেন তিনি।
বাঙালি পরিচালক হিসেবে বাংলায় সত্যজিতের প্রভাব খুবই বিস্তৃত। কিন্তু সমগ্র ভারতে সেভাবে সত্যজিতের কাজের মূল্যায়ন হয়নি। নাচ-গান-মসলার বলিউডে ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারেননি সত্যজিৎ।
পশ্চিমা বিশ্বে তাঁর সিনেমা যতটা না দেখা হয়, তার চেয়ে বেশি তাঁকে এবং তাঁর ছবি নিয়ে আলোচনা হয়। কারণ ইন্টারনেট থেকে যখন সিনেমা ডাউনলোড করা যেত না সেই যুগে। পশ্চিমাদের জন্য সত্যজিতের ছবি দেখার একমাত্র মাধ্যম ছিল চ্যানেল ফোরের মধ্যরাতের চাঙ্ক। সেখানেই দেখানো হতো সত্যজিতের সিনেমাগুলো। এ ছাড়া ফিল্ম ইনস্টিটিউটগুলোতে নিয়মিত সত্যজিতের ছবির প্রদর্শনী ও আলোচনা হতো।
ছাত্রজীবনে চিত্রকলা ও সংগীতের প্রতি সত্যজিতের আগ্রহ ছিল প্রবল। শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েছিলেন চিত্রকলা নিয়ে। কিন্তু ‘কমার্শিয়াল আর্টিস্ট’ হবেন বলে লেখাপড়া শেষ না করে কলকাতা ফিরে গিয়েছিলেন কাজে নেমে পড়ার উদ্দেশ্যে।
কর্মজীবনের শুরুটা হয়েছিল বিজ্ঞাপনী সংস্থার ভিজ্যুয়ালাইজার হিসেবে। এর পাশাপাশি বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকতেন তিনি। সিনেমা দেখতে ভালোবাসতেন। আর সে কারণেই তিনি ও তাঁর বন্ধুরা মিলে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটি গঠন করেছিলেন। ফ্র্যাংক কাপরা থেকে সার্গেই আইজেনস্টাইন-সবার ছবির প্রদর্শনী হতো তাঁদের উদ্যোগে।
১৯৪৯ সালে যখন ‘দ্য রিভার’ ছবির লোকেশন দেখতে ফরাসি নির্মাতা জ্যঁ রেনোয়া কলকাতায় এলেন, তখনই সত্যজিতের জীবনের মোড় ঘুরে গেল। জ্যঁ রেনোয়াকে নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন জায়গা ঘুরেছিলেন সত্যজিৎ। রেনোয়া তাঁকে বলেছিলেন, হলিউডকে পাত্তা না দিয়ে নিজের মতো করে ছবি বানাতে। পরে সত্যজিৎ বিভিন্ন সময়ে বলেছিলেন, তাঁর সিনেমার ক্যারিয়ারের পেছনে রেনোয়ার অবদান অসামান্য।
১৯২৮ সালে প্রকাশিত বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘পথের পাঁচালী’ অবলম্বনে প্রথম ছবিটা করতে চেয়েছিলেন সত্যজিৎ। গল্পটা তিনি প্রথম পড়েছিলেন এর পুনর্মুদ্রণের সময় প্রচ্ছদ আঁকতে গিয়ে। তখন থেকেই গল্পটা তাঁর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।
যখন সিনেমা বানানোর কথা ভাবলেন, তখন অনেক খুঁজেও মনমতো গল্প পেলেন না। শেষমেশ মাথায় ঢুকে থাকা গল্পটাকেই বেছে নিয়েছিলেন তিনি। সত্যজিতের মতে, গল্পটা আগে থেকে পড়া থাকায় সেটাকেই চিত্রায়ন করা তাঁর কাছে সহজ মনে হয়েছিল।
পথের পাঁচালীর গল্পটা ছিল একদম খাঁটি গ্রামের গল্প। সত্যজিৎ বেড়ে উঠেছিলেন শহরে, কলকাতায়। গ্রাম সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর। ছবি করতে গিয়েই গ্রাম চিনেছিলেন তিনি। গ্রামের দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারের গল্প পথের পাঁচালী। ছোট্ট অপু, তার বোন দুর্গা, তাদের বাবা-মা ও দাদি ইন্দিরা ঠাকুরণ।
থুরথুরে বুড়ি দাদির চরিত্রটি করেছিলেন চুনিবালা দেবী। একসময় সিনেমায় অভিনয় করতেন তিনি। কিন্তু সত্যজিৎ যে সময় তাঁকে খুঁজে পেয়েছিলেন, তার বহু আগেই সিনেমার কাজ ছেড়ে দিয়েছিলেন চুনিবালা। অভিনয়ের প্রস্তাব দিতেই রাজি হয়ে গিয়েছিলেন চুনিবালা।
আশির বেশি বয়সী চুনিবালাকে নিয়ে সত্যজিতের শঙ্কা ছিল শুটিং শেষ করার আগেই তিনি মারা যান কি না। ছবির কাজ শেষ করে তবেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ কেরছিলেন চুনিবালা।
এর পরের কিস্তি ‘অপরাজিত’। সেখানে অপুর কৈশোর দেখানো হয়েছে। নির্মাতা হিসেবে সত্যজিতের কারিগরি জ্ঞানের উন্নতি হয় এই ছবিতে। আগের ছবিটি তিনি করেছিলেন অফিস থেকে তিন মাসের ছুটি নিয়ে। আর ‘অপরাজিত’ করার সময় তিনি পুরোপুরি চলচ্চিত্র নির্মাতা।
বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডিজে কিমারের কাজটা ছেড়ে দিয়েছেন। ১৯৫৭ সালে ভ্যানিস উৎসবে সেরা ছবির পুরস্কার জিতেছিল ‘অপরাজিত’। মা ও ছেলের যে চিরায়ত আবেগের সম্পর্ক বাংলায় আমরা দেখি, সেটাই এই ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।
মাকে ছেড়ে অপুকে চলে যেতে হয় কলকাতায়। মা তাকে চিঠি লিখতেন। কিন্তু কাজ ও লেখাপড়ার চাপে মায়ের কাছে যেতে পারত না অপু, ছুটি ছিল না। অপুর মা একা হয়ে পড়েন। আর ধীরে ধীরে মা ও ছেলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। অপুর মায়ের ভূমিকায় দুর্দান্ত অভিনয় করেছিলেন করুণা চট্টোপাধ্যায়।
অপু ট্রিলোজি নিয়ে সত্যজিতের জীবনীগ্রন্থ ‘সত্যজিৎ রায় : দ্য ইনার আই’ বইতে অ্যান্ড্রু রবিনসন বেশ বিস্তৃত পরিসরে আলোচনা করেছেন। এন্ড্রু লিখেছেন, অপুর তিনটে ছবিকে একই সুতায় গেঁথেছেন সত্যজিৎ। আর সেই সুতাটি হলো সংগীত। পথের পাঁচালীর আবহ সংগীত করেছিলেন রবিশঙ্কর। দুর্গা বা ইন্দিরা ঠাকুরণের মৃত্যুর দৃশ্যগুলো যেন সংগীতের কারণেই আলাদা ব্যঞ্জনা পেয়েছে।
‘অপুর সংসার’ ছবিতে অভিমান শেষে ছেলের কাছে ফিরে যায় অপু। বাবার কাঁধে করে ছেলে ফিরে যাচ্ছে আর সেই সময়ে সানাইয়ের মূর্ছনা যেন আমাদেরকে ছবির সাথে একাত্ম হতে বাধ্য করে। দুর্গার মৃত্যুদৃশ্যেও এই সানাইয়ের সুর আমাদের কানে বেজেছিল। গল্পটার ধারাবাহিকতা এবং সমাপ্তিকে অর্থবহ করে তোলে সংগীত।