বাংলা সিনেমায় সত্যজিতের প্রভাব
২৩ এপ্রিল, প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের প্রয়াণদিবস। এ উপলক্ষ্যেই পেশ করা হয়েছে বর্তমান রচনাটি। এ সময়কার ভারতীয় ইনডিপেনডেন্ট সিনেমার সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁদের উদ্যোগে ডিয়ার সিনেমা ডটকম নামে একটি ওয়েবসাইট চালু আছে। সেখানে ইংরেজিতে মূল লেখাটা লিখেছিলেন অমিতাভ নাগ। ডিয়ার সিনেমায় ছাপার আগে লেখাটি কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিল। মূল লেখাটি থেকে এই রচনা ভাষান্তর করা হয়েছে এবং কোথাও কোথাও যোগও করা হয়েছে।
২০০৩ থেকে ২০১৩। পুরো একটা দশক কলকাতার বাংলা ছবির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। একটা বদল ঘটেছে এই সময়টাতে। বাংলা ছবি সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একটা ধারায় চলা শুরু করেছে এবং নির্মাণে একটা নিজস্বতা এসেছে।
এ সময়কার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছবি—গৌতম ঘোষের ‘আবার অরণ্যে’ (২০০৩), অঞ্জন দত্তের ‘চলো, লেটস গো’ (২০০৮), অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরীর ‘অন্তহীন’ (২০০৯), ২০১০ সালের ‘আবহমান’ (ঋতুপর্ণ ঘোষ), ‘অটোগ্রাফ’ (শ্রীজিত মুখার্জি), অগ্নিদেব চ্যাটার্জির ‘চারুলতা’ (২০১১), ‘তিন কন্যা’ (২০১২), ২০১৩ সালের ‘আবর্ত’ (অরিন্দম শীল), ‘মহাপুরুষ ও কাপুরুষ’ (অনিকেত চট্টোপাধ্যায়)।
ছবিগুলো কমবেশি সবারই দেখা। এই ছবিগুলোর কথা উঠল সত্যজিৎ রায় প্রসঙ্গেই। কারণ, ‘আবার অরণ্যে’ ছবিটি ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির চারটি চরিত্রের মধ্য থেকে তিনটি নিয়ে করা। ‘চলো, লেটস গো’ ছবিতে ‘অরণ্যের দিনরাত্রির’ চারটি চরিত্রই উঠে এসেছে। এটাকে ‘চরিত্রের রিমেক’ বলা যায়।
‘অন্তহীনে’ অপর্ণা সেন এবং শর্মিলা ঠাকুর একসঙ্গে অভিনয় করেন। তাঁরা সর্বশেষ একত্রে অভিনয় করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবিতে। অপর্ণা ও শর্মিলাকে আবার একসঙ্গে পর্দায় দেখানোর ব্যাপারে পরিচালকের মনে সত্যজিতের ‘কাস্টিং’-এর প্রভাব রয়ে গিয়েছিল।
‘আবহমান’—এক অভিনেত্রীর সঙ্গে পরিচালকের ডুবো প্রেমের গল্প। সেখানে সত্যজিতের স্ক্যান্ডালকে কনটেন্ট করা হয়েছে।
‘অটোগ্রাফে’ সত্যজিৎ-উত্তম জুটির ‘নায়ক’ ছবির ছায়া অনুসরণ করা হয়েছে। সৃজিত মুখার্জির ‘অটোগ্রাফ’ ছবির গল্পে যে ছবিটা বানানোর কথা বলা হয়েছে, সেটি সত্যজিতের ‘নায়ক’ এবং ইঙ্গমার বার্গম্যানের ‘ওয়াইল্ড স্ট্রবেরিজের’ ছায়া অবলম্বনে নির্মিত হবে বলে ছবির সংলাপেই বলা হয়।
অগ্নিদেব চ্যাটার্জির ‘চারুলতা’তে রবীন্দ্রনাথ থেকে নেওয়া সত্যজিতের ‘চারুলতা’কে তুলে ধরা হয়েছে, তবে যৌনতার খোলসে। ‘তিন কন্যা’তেও সত্যজিৎ-রবিঠাকুরের যুগলবন্দীকে ধার করেছেন পরিচালক। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকীতে তাঁর তৈরি নারী চরিত্রগুলোকে নিয়ে তিনটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বানিয়েছিলেন সত্যজিৎ। সেটাকেই আবারো জোড়াতালি মেরেছেন অগ্নিদেব চ্যাটার্জি।
বাংলাদেশি অভিনেত্রী জয়া আহসান অভিনীত ‘আবর্ত’ ছবির সব চরিত্রের নাম দেওয়া হয়েছে সত্যজিতের বিখ্যাত সব চরিত্রের নামে। ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ নামে সত্যজিৎ একটা ছবি বানিয়েছিলেন, সেই নামটাই এদিক-ওদিক করে দিয়ে ‘মহাপুরুষ ও কাপুরুষ’ নামে ছবি মুক্তি দেন অনিকেত। তবে নামে গোলমাল করলেও অনিকেতের গল্প অবশ্য আলাদা ছিল।
এগুলো কোনো অপরাধ নয়। প্রতিটি সিনেমাপ্রেমী বাঙালির মনে সত্যজিৎ আছেন, ভালোমতো জায়গা করেই আছেন। ফেলুদাকে তো বাদই দেওয়া হলো। ব্যোমকেশ, ফেলুদা নিয়ে তো আরো কতশত সিনেমা হয়েছে। এত উদাহরণের মোদ্দাকথা হচ্ছে, এ প্রজন্মের সব বাঙালি পরিচালকই সত্যজিৎকে তাদের সঙ্গে রাখতে চান।
নেতিবাচকভাবে বললে সত্যজিৎকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে পরিচালক হিসেবে দাঁড়িয়ে যেতে চান। কলকাতার বাংলা সিনেমায় এ বিষয়টি খুব স্পষ্ট। ঋত্বিক বা মৃণালের চেয়ে সত্যজিতের দ্বারাই বেশি প্রভাবিত হয়েছেন পরিচালকরা।
আর সত্যজিতের মেধা পুঁজি করে যেসব সিনেমা বানানো হয়েছে, তাতে নিজস্ব ঢঙের অভাব রয়েছে। সত্যজিতের কিছু ধার করে লাগিয়ে দিলে মানুষ আগ্রহ নিয়ে ছবি দেখে। পরিচালকের নামটাও ফোটে তাড়াতাড়ি। এই শর্টকাট ফর্মুলাকে একজন, দুজন করে কলকাতার অনেকেই কাজে লাগিয়েছেন। এতে কি এসব পরিচালকের স্বকীয়তা হারিয়ে যাচ্ছে না?
নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সাহস কি তাঁরা এভাবে সঞ্চয় করতে পারবেন? গেল বছরের আলোচিত ছবি ‘অপুর পাঁচালী’র কথাই ধরা যাক। নির্মাতা কৌশিক গাঙ্গুলী। স্বতন্ত্র নির্মাতা হিসেবে নিজের জায়গা তৈরি করেছেন ‘শব্দ’, ‘ছোটদের ছবি’ বানিয়ে। তবে ‘অপুর পাঁচালী’র ক্ষেত্রে সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’র অপুর গল্প করতে গিয়ে নামটাও ধার করেছেন। সত্যজিৎও অবশ্য বিভূতিভূষণের উপন্যাস ধার করেই নিজের প্রথম ছবিটা বানিয়েছিলেন। বাঙালির সাদাকালো মনে অপুর যে নিষ্পাপ চেহারা আছে, সেটাই ‘অপুর পাঁচালী’কে আলোচনায় নিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট ছিল।
এই ছবিতে অপু ট্রিলোজি থেকে বিভিন্ন ঘটনা ও ফুটেজ ব্যবহার করেছেন কৌশিক। অপুকে জোরালো করতে সত্যজিতের কাছে যেতেই হয়েছে। সত্যজিৎ থেকে ধার করা বা পুনর্নির্মাণ দোষের কিছু নয়। জ্যঁ লুক গদার বলেছিলেন, ‘কোথা থেকে জিনিসটা নেওয়া হলো, সেটা বিষয় নয়, কোথায় তাকে নেওয়া হলো সেটাই বিষয়!’
তবে যখন একজন পরিচালক নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যাবেন, তখনই যেন তিনি সত্যজিৎ বা পূর্বসূরিদের দিকে হাত বাড়ান। তার আগে দাঁড়ানোটা যেন নিজেই পড়তে পড়তে শিখে নেন। তাহলে আর বাংলা সিনেমা নিয়ে ভয় থাকবে না।