বিদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করেন কারা?
আমাদের দেশের সাহিত্যের মূলধারা বলতে আমরা কী বোঝাতে চাই? মূলধারা হচ্ছে সেটাই, যা আবহমান বাংলা সাহিত্যের উত্তরাধিকার বহন করে চলে, তাকে আরো বিকশিত করার কাজ করে চলে, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধারণ করে, অসাম্প্রদায়িকতা-ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধারণ করে সব ধরনের সংখ্যালঘু ও বিপন্ন মানুষের পাশে দাঁড়াতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তাকে উৎসাহিত করে, পরমতসহিষ্ণুতার পরিচয় দেয়, সাহিত্যে নতুন চিন্তা ও নতুন সৃষ্টির আগমনকে স্বাগত জানায়, গোষ্ঠীতন্ত্রকে অগ্রাহ্য করে সাহিত্যের শিল্পমানকে সর্বোচ্চে স্থান দেয়।
দুর্ভাগ্য যে, আমাদের দেশের মূলধারার সাহিত্যের মোড়ল ও কর্ণধাররা এই শর্তগুলো পূর্ণ না করে নিজেরাই বেশি বেশি ভঙ্গ করে চলেছেন। কেউ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, কেউ রাষ্ট্রীয় চাপে বাধ্য হয়ে আপস করেন।
আমাদের দেশে সাহিত্যের মোড়লরা আসেন প্রধানত তিনটি জায়গা থেকে—বাংলা একাডেমি, বিশ্ববিদ্যালয় ও মিডিয়া। কেবল দেশের অভ্যন্তরে ছড়ি ঘোরানোতেই নয়, বিদেশেও বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষেত্রেও পুরো সুযোগটি তাঁরাই পান এবং গ্রহণ করেন। প্রধানত বিদেশ থেকে যে আমন্ত্রণগুলো আসে, তা মূলত আসে দূতাবাসের মাধ্যমে। দূতাবাসের কর্তারা যোগাযোগ করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আমলাদের সঙ্গে। আর আমলারা নিজেরা দেশের সাহিত্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না থাকায় দায়িত্বটি ন্যস্ত করেন উপরোক্ত তিন ধরনের প্রতিষ্ঠানের কাছে। আর এই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধাররা নিজেদের মধ্যে বাটোয়ারা করে নেন এসব আমন্ত্রণ। এই আমন্ত্রণ আবার একাধিক ধরনের। প্রধানত দুই ধরনের। একটি হচ্ছে বিদেশে কোনো আন্তর্জাতিক প্রকাশনার জন্য বাংলাদেশের লেখক-কবি-প্রাবন্ধিকের লেখা চাওয়া। বই প্রকাশ করা। আর দ্বিতীয়টি হচ্ছে, সাহিত্যের আন্তর্জাতিক উৎসব-সেমিনারে আমন্ত্রিত হওয়া।
আমরা সেই পাকিস্তান আমল থেকে যদি ধারাবাহিক তথ্য সংগ্রহ করতে থাকি, তাহলে দেখব উপরোক্ত তিন প্রতিষ্ঠানের বাইরে থেকে অন্য কোনো কবি-লেখকের অংশগ্রহণের সুযোগ কোনো ক্ষেত্রেই ঘটে না। বাইরের যে দু-একজন এ রকম সুযোগ পান, খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাঁদের সরকারি দলের সঙ্গে সম্পর্ক খুব নিবিড়।
এভাবেই চলে আসছে দশকের পর দশক।
এই চলে আসাটা আমাদের কোনো মাথাব্যথার কারণ হতো না, যদি সত্যি সত্যিই এ দেশের প্রেরিত রচনা এবং প্রতিনিধিরা আমাদের সাহিত্যের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্য হতো। কিন্তু যেহেতু তা হচ্ছে না, সে কারণেই এই লেখার অবতারণা।
প্রথমত, যেসব লেখক-কবি-প্রাবন্ধিকের রচনা বিদেশের সংকলনে-পত্রিকায় পাঠানো হয়ে থাকে, সেগুলো গুণগত উৎকর্ষে বাংলাদেশের সাহিত্যের সঠিক প্রতিনিধি নয়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, প্রেরিত রচনাগুলোর চেয়ে গুণগতভাবে বহুগুণে এগিয়ে থাকা লেখা বিদেশে পৌঁছাচ্ছে না। ব্যাপারটি অগ্রহণযোগ্য এ কারণে যে, এর ফলে বাংলাদেশের সাহিত্য সম্পর্কে ভুল বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের দরবারে। ‘ও বাংলাদেশের সাহিত্যের সর্বোচ্চ মান তাহলে এই-ই’ এমন দৃষ্টিভঙ্গির সৃষ্টি হচ্ছে, হয়ে আসছে। এ কারণে নোবেলসহ কোনো আন্তর্জাতিক পুরস্কারের মানদণ্ডে ধর্তব্যের মধ্যেই আনা হচ্ছে না বাংলাদেশের সাহিত্যকে। আমরা অহরহ দুঃখ প্রকাশ করে থাকি এই বলে যে, ইংরেজি-ফ্রেঞ্চ-স্প্যানিশে অনূদিত না হওয়ায় আমাদের সাহিত্য অন্য ভাষার পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পারছে না। কিন্তু কোন কোন কারণে আমাদের সাহিত্য অন্য ভাষায় অনূদিত করে নিতে বিদেশিদের অনীহা, তা বোধ হয় আমরা সূক্ষভাবে ভেবে দেখিনি।
কোনো সংকলনে জায়গা পাওয়া বাংলাদেশি রচনাগুলোর মান দেখে বিদেশি বোদ্ধা-পাঠক যে আগ্রহ হারাবেন, সে তো জানা কথাই। এ কারণে প্রতিবেশী কলকাতায় বিদেশি প্রকাশনীর স্কাউট থাকলেও বাংলাদেশে তাঁরা আসেন না। আসবেন কেন? আমরা তো আমাদের লেখার মান(!) গত ৬০ বছর দেখিয়ে চলেছি বিদেশিদের। আমরা অনেকের মুখেই এ কথা শুনে থাকি যে, তাঁর বই বিদেশের কোনো এক বা একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পঠিত হয়ে থাকে। হয়তো সত্যিই সেসব বই পঠিত হচ্ছে। অন্তত রেফারেন্স বই হিসেবে জায়গা পেয়েছে। এ জায়গা পাওয়াটা কিন্তু যোগ্যতার মাপকাঠিতে নয়; বরং ব্যক্তিগত চিন-পরিচয় ও দেন-দরবারের ফসল। একটু চিন্তা করলেই এর সত্যতা উপলব্ধি করা যায়। সেসব বিখ্যাত(!) গ্রন্থগুলোর অধিকাংশই আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় বা বোদ্ধাপাঠকের কাছে তেমনভাবে সমাদর পায় না।
দ্বিতীয়ত, যেসব কবি-লেখককে বিদেশের সাহিত্য অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনারে পাঠানো হয়, তাঁরা কি সত্যিকারভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল লেখক? বাংলাদেশের বিশাল সাহিত্যের সারাৎসার উপস্থাপনের যোগ্যতা কি তাঁদের থাকে বা আছে? তাঁদের কি এই মানসিক উদারতা আছে যে নিজেদের গোষ্ঠীর বাইরের যোগ্য লেখক-কবিদের উন্নত রচনাগুলোর পরিচয় তাঁরা তুলে ধরতে পারবেন? এযাবৎ যে পারেননি, তার উদাহরণ আছে ভূরি ভূরি। কারা কারা কোন কোন সময় গেছেন, তার তালিকা খুঁজে বের করলেই এই উক্তির যথার্থতা প্রমাণিত হবে।
আমরা এখন এ অবস্থার অবসান চাই। চাই বাংলাদেশের সাহিত্যের স্বার্থে, বাংলাদেশের মান-মর্যাদার স্বার্থে। বাংলা একাডেমিতে চাকরি করা কোনো লেখকের যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যপনার সঙ্গে সৃষ্টিশীলতার কোনো সম্পর্ক নেই। মিডিয়াব্যক্তিত্ব আর ভালো লেখক মোটেই সমানুপাতিক নয়।
বিদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব যাঁরা করবেন, তাঁদের অন্তত তিনটি গুণ থাকতে হবে। প্রথমত, তাঁদের রচনার উৎকর্ষতা। তিনি বা তাঁরা হবেন সময়ের শ্রেষ্ঠ লেখক-কবি। সম সময়কে ধারণ করে তাঁরা মহাকালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, এমন মূল্যবান রচনার জনক হতে হবে।
দ্বিতীয়ত, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস-বর্তমান সম্পর্কে তাঁদের থাকতে হবে গভীর জ্ঞান। তাঁরা কেবল জাতীয় দৈনিক আর ভদ্র সাহিত্যপত্রিকার পাঠক নন, বরং দেশের প্রত্যন্ত থেকে প্রকাশিত ছোট-বড়-মাঝারি সব ধরনের পত্রিকা ও সেগুলোর লেখক সম্পর্কে ধারণাসংবলিত মানুষ।
তৃতীয়ত, তাঁদের থাকতে হবে বিশ্বসাহিত্য পাঠের অভিজ্ঞতা। ধ্রুপদি এবং সমকালীন বিশ্বসাহিত্য পাঠ করেছেন তাঁরা গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেসব রচনা সমকালীন সাহিত্যবিশ্বে আলোড়ন তুলেছে বা আলোচিত হচ্ছে, সেগুলোর সঙ্গে পরিচয় সব সময় নবায়িত করে রাখতে হবে তাঁদের।
এমন লেখক-কবির সংখ্যা বাংলাদেশে খুব বেশি নেই। কিন্তু আছে। যেমন কোনো দেশেই খুব বেশি থাকে না। তবে অন্য দেশের ক্ষেত্রে যেভাবে যোগ্যতমরা প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ পান, আমাদের দেশের ক্ষেত্রে তা ব্যতিক্রমী ঘটনা।
বাংলাদেশের সাহিত্যজগতে এই নীরব দুর্বৃত্তপনার অবসান ঘটাতে হবে। কাজটা খুব কঠিন। কিন্তু প্রকৃত ও যোগ্য লেখকদের এ কাজটাও করতে হবে দেশের স্বার্থে।
সংযোজন : কয়েক বছর ধরে এ দেশের কিছু লেখক ইংরেজি ভাষায় লিখছেন। তাঁরা বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিদেশি লেখক-প্রকাশক-পত্রিকার সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তুলছেন। কারো কারো বই প্রকাশিত হচ্ছে বিদেশি প্রকাশনালয় থেকে। সম্ভবত তাঁরা বেশ ভালো লেখক। তবে বাংলাদেশের সাহিত্যের মূলধারার প্রতিনিধি তাঁরা নন। আমাদের এই আলোচনায় তাই তাঁদের নিয়ে বিস্তারিত বলার কারণ নেই।